ETV Bharat / opinion

বিএনএস, বিএনএসএস ও বিএসএ - কেমন এই তিন নয়া আইন ? জানতে পড়ুন... - Three New Laws

author img

By Justice Madan Lokur

Published : Jul 29, 2024, 6:34 PM IST

Three New Laws: 1 জুলাই 2024 থেকে চালু হয়েছে তিনটি নতুন ফৌজদারি আইন ৷ এই তিনটি আইন ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে মুক্তি পেতেই এই আইন তৈরি করা হয় বলে জানানো হয়েছিল ৷ সত্যিই কি তাই ? এই আইনের ভালো দিক কোনগুলি, কোথায় কোথায় পরিবর্তন প্রয়োজন, আইনের অদ্ভুত দিকগুলিই বা কী, সেই নিয়েই লিখেছেন বিচারপতি মদন লোকুর ৷

Three New Laws
তিনটি নতুন ফৌজদারি আইনের রেফারেন্স বুক (এএনআই)

চলতি বছরের জুলাই মাসের প্রথম দিন থেকে লাগু হয়েছে তিনটি নতুন ফৌজদারি আইন - ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (বিএনএস), ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা (বিএনএসএস) ও ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম (বিএসএ) ৷ ইন্ডিয়ান পিনাল কোড (আইপিসি), কোড অফ ক্রিমিনাল প্রসিডিয়োর ও ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্টের বদলে এই তিন আইন আনা হয়েছে ৷ এই নিয়ে বেশ কিছু সময় ধরে অনেক আলোচনা এবং লেখালেখি হয়েছে ৷ একটি ছোট্ট প্রতিবেদনে এই আইনগুলির প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব নয় ৷ তাই আমি এই আইনগুলির কয়েকটি দিক তুলে ধরছি ৷ যার মধ্যে কিছু অদ্ভুত অংশ রয়েছে ৷ কিছু ভালো অংশ রয়েছে ৷ আবার কিছুক্ষেত্রে কঠোর পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে ।

অদ্ভুত বিষয়: ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে মুক্তি পেতেই এই আইন চালু করা হতে চলেছে বলে জানানো হয়েছিল ৷ কিন্তু 90 শতাংশ ক্ষেত্রে পুরনো আইন থেকে হুবহু নকল করা হয়েছে ৷ আইপিসির মৌলিক কাঠামো বজায় রেখে প্রয়োজনীয় সংশোধনও করা যেত । ঔপনিবেশিক আইন হিসাবে যা অব্যাহত রয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা পুনরায় কার্যকর করার দরকার ছিল না । বিএনএস একটি নতুন বোতলে পুরনো মদ ছাড়া আর কিছুই নয় ।

আইপিসির সবচেয়ে অপব্যবহৃত ধারাগুলির মধ্যে একটি ছিল রাষ্ট্রদ্রোহ । নির্দোষ টুইট করার জন্য যুবক-যুবতীদের গ্রেফতার করার ঘটনা ঘটেছে । এর আগে সুপ্রিম কোর্ট ও সারা দেশকে এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে এই ঔপনিবেশিক বিধান বাতিল করা হবে । কিন্তু এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি উল্টোটা হয়েছে । নতুন বিধানে (ধারা 152 বিএনএস) রাষ্ট্রদ্রোহকে যুক্ত করা হয়েছে ৷ এখন আরও কঠোর শাস্তি দিয়ে এই বিধানের অপব্যবহারের আরও সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে । কয়েকদিন আগে প্যালেস্তাইনের পতাকা ওড়ানোর অভিযোগে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয় । এখন তাদের বিরুদ্ধে বিএএনস-এর 152 নম্বর ধারা ব্যবহার করে নাশকতামূলক কার্যকলাপের জন্য অনির্ধারিত উত্তেজনা তৈরির অভিযোগ আনা যেতে পারে ।

একই ভাবে, আইপিসির আরও একটি অপব্যবহৃত ধারা ছিল 153-এ (বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা তৈরিতে প্রচার) ৷ তা পুনরায় প্রণয়ন করা হয়েছে এবং এখন সেটা বিএনএস-এর 196 নম্বর ধারা হিসেবে উল্লেখিত হচ্ছে ৷ এই ধারার অধীনে জামিন অযোগ্য অপরাধের জন্য একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করার অধিকার পুলিশকে দেওয়া হয়েছে ৷ কিন্তু অতীতের মতো এটি বিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার সম্ভাবনা কম ।

ভালোদিক: বিএনএসএস-এর কিছু ভালো বিধানও রয়েছে ৷ তার মধ্যে রয়েছে তল্লাশি অভিযানের সময় মোবাইল ফোনে ভিডিয়োগ্রাফি (ধারা 185)৷ আশা করি, এর ফলে পুলিশ আধিকারিকদের অতিসক্রিয়তা দূর হবে ৷ কিন্তু মনে হচ্ছে ভিডিয়োগ্রাফির কোনও স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিয়োর বা এসওপি নেই । আইনে এখন একটি থানায় গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের তালিকা বাধ্যতামূলকভাবে প্রদর্শন করা প্রয়োজন (ধারা 37) । ভালো, কিন্তু গ্রেফতার দেখানো না হলে কী হবে ? পুলিশ এই খেলাটি খেলতে জানে ।

3 বছরের কম শাস্তি হতে পারে এমন অপরাধের ক্ষেত্রে 60 বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিদের গ্রেফতারের উপরও বিধিনিষেধ রয়েছে (ধারা 35) । বয়স কিভাবে যাচাই করা হবে ? তবে এই ধরনের বেশিরভাগ অপরাধই জামিনযোগ্য । তাই এটা সত্যিই একটি উন্নতি ৷ বিএনএসএস অপরাধের শিকার হওয়াদের ক্ষেত্রে সুবিধা প্রদান করছে ।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, 193 ধারায় বলা হয়েছে যে যৌন অপরাধের ক্ষেত্রে দুই মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে ৷ এই বিধানটি ভালো ৷ তবে দুই মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ না হলে সময় বাড়ানোর জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন তদন্তকারীরা । কেন একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা দেওয়া হল ? এছাড়াও একটি শর্ত রয়েছে যে যৌন অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশকে 90 দিনের মধ্যে তদন্তে অগ্রগতির বিষয়ে আক্রান্তকে জানাতে হবে । তথ্য না দেওয়া হলে, এটা কোনও ব্যাপার বলে মনে হয় না । পুলিশ কি আসলেই এই বিধানকে সম্মান করবে ? আশ্চর্যজনকভাবে, 90 দিনের পরে তথ্য সরবরাহ করার কোনও প্রয়োজন নেই । এমন অনেক ফাঁক রয়েছে, যা বাধ্যতামূলক ফলো-আপ ছাড়াই ভালো বিধানকেও অর্থহীন করে তোলে ।

পরিবর্তন প্রয়োজন: বিএনএস কঠোর বিধান চালু করেছে । উদাহরণ হিসবে বলা যায়, সন্ত্রাসবাদী কাজের সঙ্গে যুক্ত সংগঠনের সদস্য হওয়ার প্রমাণ মিললে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে (ধারা 113) । এর অর্থ হল, কোনও সংগঠনের কিছু সদস্য সন্ত্রাসবাদী কাজে লিপ্ত হলে ওই সংগঠনের নির্দোষ সদস্যদের এই আইনে গ্রেফতার করা যেতে পারে ৷

পুলিশ দায় এড়িয়ে গ্রেফতারের ক্ষমতার অপব্যবহার করার জন্য পরিচিত ৷ বর্তমান সময়ে দায় নেওয়ার বিষয়টি একান্ত অপরিহার্য । আমরা আইনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে পুলিশকে তা থেকে সরে যেতে দেখেছি । জবাবদিহি দেওয়া বাধ্যতামূলক না থাকা স্বাধীনতার আগে একটি অভিশাপের মতো ছিল ৷ আর তা এখনও অব্যাহত রয়েছে । নতুন আইন এই ব্যবস্থা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে । মিথ্যা গ্রেফতার ও ভুয়ো এনকাউন্টারের জন্য পুলিশের অবশ্যই জবাবদিহি করা উচিত ৷

জামিনের বিষয়টি অস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে (ধারা 480 বিএনএসএস) । খুনে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জামিন দেওয়া যাবে না, বিষয়টিকে এমনভাবে দেখা যেতে পারে । এছাড়া গ্রেফতারের প্রথম 40 দিনের মধ্যে যেকোনও সময় ও এই সময়ের মধ্যে একাধিকবার পুলিশ একজন অভিযুক্তকে হেফাজত পেতে পারে । এর ফলে একজন অভিযুক্তকে জামিন দিতে বিচারকরা নিরুৎসাহিত হবেন ৷ যার ফলস্বরূপ, কিছু ক্ষেত্রে 40 দিনের জন্য কারাদণ্ড কমবেশি নিশ্চিত বলা যেতেই পারে ।

জিরো এফআইআর এখন আইনের অংশ (ধারা 173 বিএনএসএস) । এই বিষয়টি আগে থেকেই প্রচলিত ছিল ৷ কিন্তু এখন এটাকে এবার বিধিবদ্ধ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে । এফআইআর তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাটি যেখানে ঘটেছে, সেখানকার থানায় স্থানান্তরের কোনও বিধান নেই । উল্লেখ্য, যখন মণিপুরে দুই মহিলাকে নগ্ন করে প্যারেড করানো হয়েছিল, তখন একটি শূন্য এফআইআর নথিভুক্ত করা হয়েছিল ৷ কিন্তু প্রায় দুই সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় ধরে সংশ্লিষ্ট থানায় স্থানান্তর করা হয়নি । এই বিলম্বের পরিণতি আমরা সবাই জানি ।

এই ধরনের বেশ কয়েকটি বিধানের উল্লেখ অস্পষ্টভাবে রয়েছে, যা নিয়ে আইনজীবীরা নানা যুক্তি সাজাতে পারবেন ৷ এতে বোঝা বাড়বে ট্রায়াল কোর্ট ও হাইকোর্টে বিচারকদের উপর ৷ তাঁদের কিছু মামলার শুনানি করতে হবে পুরনো আইনের অধীনে এবং কিছু নতুন আইনের অধীনে ৷ এটা সহজ কাজ নয় । এর ফলে সর্বত্র বিভ্রান্তি ছড়াবে এবং মামলা নিষ্পত্তি কমবে । এর দ্বারা কারা লাভবান হবে ?

এই সমস্যার সমাধান কী ? আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি যে জবাবদিহি করার বিষয়টি অবশ্যই জুড়তে হবে ৷ তা সে একজন সাধারণ নাগরিক হোক বা একজন সিনিয়র আমলা বা পুলিশ অফিসার হোক, প্রত্যেককে জবাবদিহি করার আওতায় আনতে হবে । আইন বাস্তবায়নে সমতা না থাকলে আমরা দু’টি আইনি ব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত হতে থাকব, একটি ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য ও অন্যটি সাধারণ নাগরিকদের জন্য । আমরা যদি ঔপনিবেশিক হ্যাংওভার ছুঁড়ে ফেলার বিষয়ে গুরুত্ব দিই, তাহলে আসুন ন্যায়বিচার প্রদানে ওয়াশিং মেশিন সিন্ড্রোমকে চালিয়ে না দিয়ে সবার জন্য আইনের শাসন বাস্তবায়নের মাধ্যমে তা শুরু করি ।

(বিচারপতি মদন লোকুর: বিচারপতি লোকুর একজন ভারতীয় আইনবিদ। তিনি ফিজির সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি।তিনি ভারতের সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি ছিলেন। তিনি অন্ধ্রপ্রদেশ হাইকোর্ট এবং গুয়াহাটি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে তিনি দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন।)

এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব । এখানে প্রকাশিত তথ্য ও মতামত ইটিভি ভারত-এর মতামতকে প্রতিফলিত করে না ।

চলতি বছরের জুলাই মাসের প্রথম দিন থেকে লাগু হয়েছে তিনটি নতুন ফৌজদারি আইন - ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (বিএনএস), ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা (বিএনএসএস) ও ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম (বিএসএ) ৷ ইন্ডিয়ান পিনাল কোড (আইপিসি), কোড অফ ক্রিমিনাল প্রসিডিয়োর ও ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্টের বদলে এই তিন আইন আনা হয়েছে ৷ এই নিয়ে বেশ কিছু সময় ধরে অনেক আলোচনা এবং লেখালেখি হয়েছে ৷ একটি ছোট্ট প্রতিবেদনে এই আইনগুলির প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব নয় ৷ তাই আমি এই আইনগুলির কয়েকটি দিক তুলে ধরছি ৷ যার মধ্যে কিছু অদ্ভুত অংশ রয়েছে ৷ কিছু ভালো অংশ রয়েছে ৷ আবার কিছুক্ষেত্রে কঠোর পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে ।

অদ্ভুত বিষয়: ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে মুক্তি পেতেই এই আইন চালু করা হতে চলেছে বলে জানানো হয়েছিল ৷ কিন্তু 90 শতাংশ ক্ষেত্রে পুরনো আইন থেকে হুবহু নকল করা হয়েছে ৷ আইপিসির মৌলিক কাঠামো বজায় রেখে প্রয়োজনীয় সংশোধনও করা যেত । ঔপনিবেশিক আইন হিসাবে যা অব্যাহত রয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা পুনরায় কার্যকর করার দরকার ছিল না । বিএনএস একটি নতুন বোতলে পুরনো মদ ছাড়া আর কিছুই নয় ।

আইপিসির সবচেয়ে অপব্যবহৃত ধারাগুলির মধ্যে একটি ছিল রাষ্ট্রদ্রোহ । নির্দোষ টুইট করার জন্য যুবক-যুবতীদের গ্রেফতার করার ঘটনা ঘটেছে । এর আগে সুপ্রিম কোর্ট ও সারা দেশকে এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে এই ঔপনিবেশিক বিধান বাতিল করা হবে । কিন্তু এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি উল্টোটা হয়েছে । নতুন বিধানে (ধারা 152 বিএনএস) রাষ্ট্রদ্রোহকে যুক্ত করা হয়েছে ৷ এখন আরও কঠোর শাস্তি দিয়ে এই বিধানের অপব্যবহারের আরও সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে । কয়েকদিন আগে প্যালেস্তাইনের পতাকা ওড়ানোর অভিযোগে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয় । এখন তাদের বিরুদ্ধে বিএএনস-এর 152 নম্বর ধারা ব্যবহার করে নাশকতামূলক কার্যকলাপের জন্য অনির্ধারিত উত্তেজনা তৈরির অভিযোগ আনা যেতে পারে ।

একই ভাবে, আইপিসির আরও একটি অপব্যবহৃত ধারা ছিল 153-এ (বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা তৈরিতে প্রচার) ৷ তা পুনরায় প্রণয়ন করা হয়েছে এবং এখন সেটা বিএনএস-এর 196 নম্বর ধারা হিসেবে উল্লেখিত হচ্ছে ৷ এই ধারার অধীনে জামিন অযোগ্য অপরাধের জন্য একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করার অধিকার পুলিশকে দেওয়া হয়েছে ৷ কিন্তু অতীতের মতো এটি বিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার সম্ভাবনা কম ।

ভালোদিক: বিএনএসএস-এর কিছু ভালো বিধানও রয়েছে ৷ তার মধ্যে রয়েছে তল্লাশি অভিযানের সময় মোবাইল ফোনে ভিডিয়োগ্রাফি (ধারা 185)৷ আশা করি, এর ফলে পুলিশ আধিকারিকদের অতিসক্রিয়তা দূর হবে ৷ কিন্তু মনে হচ্ছে ভিডিয়োগ্রাফির কোনও স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিয়োর বা এসওপি নেই । আইনে এখন একটি থানায় গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের তালিকা বাধ্যতামূলকভাবে প্রদর্শন করা প্রয়োজন (ধারা 37) । ভালো, কিন্তু গ্রেফতার দেখানো না হলে কী হবে ? পুলিশ এই খেলাটি খেলতে জানে ।

3 বছরের কম শাস্তি হতে পারে এমন অপরাধের ক্ষেত্রে 60 বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিদের গ্রেফতারের উপরও বিধিনিষেধ রয়েছে (ধারা 35) । বয়স কিভাবে যাচাই করা হবে ? তবে এই ধরনের বেশিরভাগ অপরাধই জামিনযোগ্য । তাই এটা সত্যিই একটি উন্নতি ৷ বিএনএসএস অপরাধের শিকার হওয়াদের ক্ষেত্রে সুবিধা প্রদান করছে ।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, 193 ধারায় বলা হয়েছে যে যৌন অপরাধের ক্ষেত্রে দুই মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে ৷ এই বিধানটি ভালো ৷ তবে দুই মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ না হলে সময় বাড়ানোর জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন তদন্তকারীরা । কেন একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা দেওয়া হল ? এছাড়াও একটি শর্ত রয়েছে যে যৌন অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশকে 90 দিনের মধ্যে তদন্তে অগ্রগতির বিষয়ে আক্রান্তকে জানাতে হবে । তথ্য না দেওয়া হলে, এটা কোনও ব্যাপার বলে মনে হয় না । পুলিশ কি আসলেই এই বিধানকে সম্মান করবে ? আশ্চর্যজনকভাবে, 90 দিনের পরে তথ্য সরবরাহ করার কোনও প্রয়োজন নেই । এমন অনেক ফাঁক রয়েছে, যা বাধ্যতামূলক ফলো-আপ ছাড়াই ভালো বিধানকেও অর্থহীন করে তোলে ।

পরিবর্তন প্রয়োজন: বিএনএস কঠোর বিধান চালু করেছে । উদাহরণ হিসবে বলা যায়, সন্ত্রাসবাদী কাজের সঙ্গে যুক্ত সংগঠনের সদস্য হওয়ার প্রমাণ মিললে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে (ধারা 113) । এর অর্থ হল, কোনও সংগঠনের কিছু সদস্য সন্ত্রাসবাদী কাজে লিপ্ত হলে ওই সংগঠনের নির্দোষ সদস্যদের এই আইনে গ্রেফতার করা যেতে পারে ৷

পুলিশ দায় এড়িয়ে গ্রেফতারের ক্ষমতার অপব্যবহার করার জন্য পরিচিত ৷ বর্তমান সময়ে দায় নেওয়ার বিষয়টি একান্ত অপরিহার্য । আমরা আইনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে পুলিশকে তা থেকে সরে যেতে দেখেছি । জবাবদিহি দেওয়া বাধ্যতামূলক না থাকা স্বাধীনতার আগে একটি অভিশাপের মতো ছিল ৷ আর তা এখনও অব্যাহত রয়েছে । নতুন আইন এই ব্যবস্থা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে । মিথ্যা গ্রেফতার ও ভুয়ো এনকাউন্টারের জন্য পুলিশের অবশ্যই জবাবদিহি করা উচিত ৷

জামিনের বিষয়টি অস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে (ধারা 480 বিএনএসএস) । খুনে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জামিন দেওয়া যাবে না, বিষয়টিকে এমনভাবে দেখা যেতে পারে । এছাড়া গ্রেফতারের প্রথম 40 দিনের মধ্যে যেকোনও সময় ও এই সময়ের মধ্যে একাধিকবার পুলিশ একজন অভিযুক্তকে হেফাজত পেতে পারে । এর ফলে একজন অভিযুক্তকে জামিন দিতে বিচারকরা নিরুৎসাহিত হবেন ৷ যার ফলস্বরূপ, কিছু ক্ষেত্রে 40 দিনের জন্য কারাদণ্ড কমবেশি নিশ্চিত বলা যেতেই পারে ।

জিরো এফআইআর এখন আইনের অংশ (ধারা 173 বিএনএসএস) । এই বিষয়টি আগে থেকেই প্রচলিত ছিল ৷ কিন্তু এখন এটাকে এবার বিধিবদ্ধ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে । এফআইআর তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাটি যেখানে ঘটেছে, সেখানকার থানায় স্থানান্তরের কোনও বিধান নেই । উল্লেখ্য, যখন মণিপুরে দুই মহিলাকে নগ্ন করে প্যারেড করানো হয়েছিল, তখন একটি শূন্য এফআইআর নথিভুক্ত করা হয়েছিল ৷ কিন্তু প্রায় দুই সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় ধরে সংশ্লিষ্ট থানায় স্থানান্তর করা হয়নি । এই বিলম্বের পরিণতি আমরা সবাই জানি ।

এই ধরনের বেশ কয়েকটি বিধানের উল্লেখ অস্পষ্টভাবে রয়েছে, যা নিয়ে আইনজীবীরা নানা যুক্তি সাজাতে পারবেন ৷ এতে বোঝা বাড়বে ট্রায়াল কোর্ট ও হাইকোর্টে বিচারকদের উপর ৷ তাঁদের কিছু মামলার শুনানি করতে হবে পুরনো আইনের অধীনে এবং কিছু নতুন আইনের অধীনে ৷ এটা সহজ কাজ নয় । এর ফলে সর্বত্র বিভ্রান্তি ছড়াবে এবং মামলা নিষ্পত্তি কমবে । এর দ্বারা কারা লাভবান হবে ?

এই সমস্যার সমাধান কী ? আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি যে জবাবদিহি করার বিষয়টি অবশ্যই জুড়তে হবে ৷ তা সে একজন সাধারণ নাগরিক হোক বা একজন সিনিয়র আমলা বা পুলিশ অফিসার হোক, প্রত্যেককে জবাবদিহি করার আওতায় আনতে হবে । আইন বাস্তবায়নে সমতা না থাকলে আমরা দু’টি আইনি ব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত হতে থাকব, একটি ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য ও অন্যটি সাধারণ নাগরিকদের জন্য । আমরা যদি ঔপনিবেশিক হ্যাংওভার ছুঁড়ে ফেলার বিষয়ে গুরুত্ব দিই, তাহলে আসুন ন্যায়বিচার প্রদানে ওয়াশিং মেশিন সিন্ড্রোমকে চালিয়ে না দিয়ে সবার জন্য আইনের শাসন বাস্তবায়নের মাধ্যমে তা শুরু করি ।

(বিচারপতি মদন লোকুর: বিচারপতি লোকুর একজন ভারতীয় আইনবিদ। তিনি ফিজির সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি।তিনি ভারতের সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি ছিলেন। তিনি অন্ধ্রপ্রদেশ হাইকোর্ট এবং গুয়াহাটি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে তিনি দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন।)

এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব । এখানে প্রকাশিত তথ্য ও মতামত ইটিভি ভারত-এর মতামতকে প্রতিফলিত করে না ।

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.