ভারত সরকারের এক সিনিয়র আধিকারিকের দাবি, "আমরা হাসিনা সরকারের ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার কথা ভাবিনি বলে মনে করবেন না । আমরা এতটা অজ্ঞাত নই, যতটা আমাদের মিডিয়ায় প্রজেক্ট করা হয়েছে ?" স্বাভাবিকভাবেই তাই প্রশ্ন উঠছে, ভারত সরকার যদি সত্যিই ঢাকার আসন্ন পরিবর্তন সম্পর্কে জানত, তাহলে নয়াদিল্লি আসলে কী করেছিল ?
ওই আধিকারিক বলেন, "পরিবর্তন ঘটতে দেওয়া ছাড়া আমাদের কিছুই করার নেই ৷" তিনি তাঁর মন্তব্যের কোনও ব্যাখ্যা দেননি ৷ তবে এক বন্ধুকে হিংসাত্মক উপায়ে উৎখাত করার পরে নয়াদিল্লিতে দৃশ্যত কোনও আতঙ্ক নেই । এর বদলে দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দে বিশ্বাস রয়েছে যে বাংলাদেশ সত্যিই ভারত থেকে দূরে সরে যেতে পারবে না । এই আগ্রাসী মনোভাব দেখা দেয়, যখন তারা দাবি করে, "ভারত ছাড়া ঢাকা আসলে কী করতে পারবে ? এদের মাথাপিছু জিডিপি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা ভারতের চেয়ে বেশি, কিন্তু তা সরবরাহের ক্ষেত্রে ভারতের জরুরি সহায়তা ছাড়া সম্ভব ছিল না ।"
এই ব্যাখ্যা শুধু বাংলাদেশেই নয়, শ্রীলঙ্কা ও নেপালেও চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে, যেখানে তাদের সরকার অর্থনৈতিক কাজে আদানির অন্তর্ভুক্তিকে চ্যালেঞ্জ করছে ।
এই ধরনের আপত্তি সত্ত্বেও হাসিনার পতনকে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ভারতের প্রভাবের জন্য একটি ধাক্কা হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে । আশেপাশের দেশগুলি সত্যিই এই বিশ্বাসের সঙ্গে সহমত নয় যে ভারতই এই অঞ্চলে এখনও ছড়ি ঘোরাচ্ছে । উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কাঠমাণ্ডু 2015 সালের আগে পর্যন্ত ভারতের সঙ্গেই ছিল ৷ ওই বছর সেখানকার প্রধানমন্ত্রী ওলির সরকারকে শেখানোর প্রচেষ্টায় ভারত তাদের ব্লক করে দেয়, যার বিরোধিতা করেছিল সাধারণ নেপালিরা ৷
এরপর আর আগের মতো সম্পর্ক তৈরি হয়নি । একজন নেপালি, যিনি নিজেদের দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি নির্দ্ধিধায় বলবেন যে ওই দেশে প্রভাব বিস্তারের নিরিখে ভারত পিছিয়ে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের চেয়ে ৷ সাম্প্রতিক সময়ে যদিও চিনও তার আগ্রাসী কূটনীতি প্রদর্শন করছে না ৷ আয়োজক দেশকে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করছে না ৷ তবুও, নেপাল অনেক কিছুর জন্য বেজিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে ।
সবচেয়ে খারাপ হল মাওবাদীরা, যারা ওই দেশের রাজতন্ত্র উৎখাত হওয়ার পর থেকে ক্ষমতায় রয়েছে, তারা এখনও বিশ্বাস করে যে নয়াদিল্লি অতীতের এই হিমালয় রাজত্বকে একটি হিন্দু দেশে পরিণত করার চেষ্টা করছে । এই কারণে অনেকের বিশ্বাস ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এখানে খুব সক্রিয় । অনেক সূত্র দাবি করে যে সমস্ত তহবিল ভারতীয় সরকারি সংস্থাগুলি আরএসএস-এর মাধ্যমে নেপালে পাঠায় ।
অনেকে বিশ্বাস করেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরএসএসের প্রতি বিরূপ নয়, কারণ এই সংগঠন কমিউনিস্টদের লাগাম টেনে ধরার বৃহত্তর লক্ষ্যে সহায়তা করে । যদিও নেপালি মাওবাদীরা চিন বা ভারতের সাহায্যে ক্ষমতায় থাকার প্রচেষ্টায় তাদের রং ও শক্তি হারিয়েছে ৷ তবুও তারা বেজিংয়ের কমিউনিস্ট পার্টির ঘনিষ্ঠ বলে মনে করা হয় । কাঠমাণ্ডুতে একটি অভিযোগ শোনা যায় যে, নেপালের লুম্বিনি ও পোখারা বিমানবন্দর, যা চিন তৈরি করেছে, সেগুলিকে দখলের জন্য আদানি গোষ্ঠীকে দিয়ে চাপ তৈরি করছে ভারত সরকার৷ ওই বিমানবন্দর থেকে ওড়া বিমানগুলিকে ভারত আকাশ দিয়ে চলাচল নিষিদ্ধ করে দেওয়ার পর সেখানে আন্তর্জাতিক উড়ান বন্ধ হয়ে গিয়েছে ৷ নেপাল সরকার মনে করে যে একবার আদানি দায়িত্ব গ্রহণ করলে বিমান চলাচলের ক্ষেত্রটি সক্রিয় করতে সমস্যা কমবে ৷ কারণ, তখন লুম্বিনি ও পোখারা দিয়ে অনেক তীর্থযাত্রী যাতায়াত শুরু করবেন ৷
যদিও কাঠমাণ্ডু বিমানবন্দরটি ভারতীয় ব্যবসায়িক গোষ্ঠী দখলে নিলে তার পরিস্থিতি আরও ভালো হবে ৷ তবে কীভাবে আদানিরা ভারতের প্রতিবেশী নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠেছে, তা নিয়ে সারা উপমহাদেশে ক্ষোভ বাড়ছে । শ্রীলঙ্কায় ধাক্কা দেখা যাচ্ছে, যেখানে স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো একটি নতুন মার্ক্সবাদী সরকার ক্ষমতায় এসেছে ।
শ্রীলঙ্কার নতুন এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্ট এ কে দিসানায়েকে আদানির বায়ু শক্তি প্রকল্পটি ফেলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন । তিনি জনতা বিমুক্তি পেরুমেনা (জেভিপি)-র প্রতিনিধিত্ব করেন৷ এই দল ভারতের বিরোধী ছিল এবং কুচকাওয়াজের সময় প্রয়াত রাজীব গান্ধিকে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করার জন্য নেভাল রেটিংকে প্ররোচিত করার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে । শ্রীলঙ্কা সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয়ে যাঁরা আত্মহনন করেছিলেন, সেই বিষয়গুলিকে সামনে আনার অভিযোগও অতীতে তাদের বিরুদ্ধে উঠেছিল ৷ সাম্প্রতিক সময়ে দিসানায়েকে ভারত সফর করেছেন ৷ সাউথ ব্লককে আশ্বস্ত করেছেন যে তিনি আগের মার্কসবাদী নন এবং তিনি নেপালের প্রচণ্ড বা ওলির মতো হতে পারেন, যাঁরা ভারত ও গণতন্ত্রকে শত্রু হিসাবে গ্রহণ করেন না । তাঁর নাস্তিকতা শ্রীলঙ্কার জাতীয় রাজনীতির উপর বৌদ্ধ ধর্মযাজকদের যে নিয়ন্ত্রণকে ক্ষুণ্ন করতে পারে বলে মনে করেন অনেকে ৷ তবে দিসানায়েকের বৌদ্ধ মন্দির দর্শন সেই মনোভাবকে প্রশমিত করতে পারে ৷
বাংলাদেশের মতো শ্রীলঙ্কাও ভারতের সমর্থন ছাড়া তার বিশাল অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে সত্যিই খুব বেশি কিছু করতে পারবে না । কয়েক বছর আগে যখন এই দেশে বিপর্যয় তৈরি হয়েছিল, তখন ভারত সরকার এই দ্বীপরাষ্ট্রকে উদ্ধার করতে এগিয়ে যায় ৷ ভারতের সেই সাহায্য হয়তো তারা ভুলে যায়নি ৷ কিন্তু শ্রীলঙ্কানরা অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে তাঁদের সার্বভৌমত্ব হারাতে চান না । প্রকৃতপক্ষে, মাহিন্দা রাজাপাকসের সরকার চিন থেকে নেওয়া ঋণ শোধ করতে না পারায় শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক সমস্যা শুরু হয় । কলম্বো কঠিন বাহ্যিক পরিবেশের কারণে ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি, যা দ্বীপরাষ্ট্রের পর্যটনে প্রভাব ফেলেছে । দিসানায়েকে সঙ্কটে থাকা দেশকে সাহায্য করার জন্য একটি হিতৈষী ভারত চান ৷ তবে তাঁর সরকারের কাছে যে দাবিগুলি করা হতে পারে, তার সঙ্গে তিনি একমত নাও হতে পারেন ৷
ভারত যেভাবে তার সমস্যায় পড়া প্রতিবেশীদের পরিস্থিতি মোকাবিলা করে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার থেকে বোঝা যায় যে নয়াদিল্লি পাকিস্তান থেকে তৈরি হওয়া নিরাপত্তাহীনতার ঊর্ধ্বে উঠতে সক্ষম হয়েছে কি না ৷ আগামী সপ্তাহে ভারত সরকারকে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷ কারণ, 15-16 অক্টোবর পাকিস্তানের ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে সাংহাই কো-অপারেশন (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে ৷ সেখানে ভারত যোগ দেবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে নয়াদিল্লিকে ।
ভারত যদি ইসলামাবাদ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেয়, তবে এটি শুধুমাত্র তার প্রতিবেশীদের প্রতি নয়াদিল্লির মনোভাবের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হবে না, বরং মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোয়াড সম্মেলনে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইলমিংটনে অনুষ্ঠিত হয়) অংশগ্রহণের পর চিন-রাশিয়া কেন্দ্রিক এসসিও-তে অংশগ্রহণের মাধ্যমে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন অনুশীলন করার ক্ষমতাও দেখানো সম্ভব হবে ৷
(এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ৷ এখানে প্রকাশিত তথ্য ও মতামত ইটিভি ভারত-এর মতামতকে প্রতিফলিত করে না ৷)