তৃতীয় ইন্দো-জাপান 2+2 বৈঠক (প্রতিরক্ষা ও বিদেশমন্ত্রক পর্যায়ের) নয়াদিল্লিতে অগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হয়েছিল । সেই বৈঠকের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, দুই দেশ 'আরও একবার নিশ্চিত করেছে যে রাষ্ট্রসংঘ সনদের নীতিমালা অনুযায়ী যে নিয়ম-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা রয়েছে,তা বজায় রাখা ও শক্তিশালী করার বিষয়টি মেনে চলা হবে ৷ ওই শৃঙ্খলায় জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি সম্মান এবং হুমকি বা বাহিনী ব্যবহার ছাড়াই যেকোনও বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির কথা বলা আছে ৷ সেখানে আরও বলা আছে যে প্রতিটি দেশই একতরফা ভাবে স্থিতাবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা করবে না ৷’
চিন, এই উভয় দেশেরই প্রতিবেশী ৷ চিন এই দুই দেশ-সহ অন্যদেরও ক্ষেত্রেও ক্রমবর্ধমান হুমকির কারণ দাঁড়াচ্ছে ৷ কারণ, তারা অসৎ উপায়ে বিভিন্ন দেশের এলাকায় ঢুকে পড়তে চাইছে ৷ সেই কারণে ভারত ও জাপানের মধ্যে সহযোগিতা সম্প্রসারিত হয়েছে । এই দুই দেশের উদ্বেগের একটি প্রধান ক্ষেত্র হল ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল । রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত-সহ অন্যান্য বৈশ্বিক বিষয়গুলি নিয়ে ভারত ও জাপানের এই 2+2 বৈঠকে আলোচনা হয়েছে ৷ এর মধ্যে দক্ষিণ ও পূর্ব চিন সাগরে ক্রমবর্ধমান চিনা আগ্রাসনের বিষয়েও আলোচনা হয় । রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে জাপান ।
চিনা গ্লোবাল টাইমস এই 2+2 বৈঠকের বিষয়ে টুইট করেছে ৷ সেখানে লেখা হয়েছে, ‘‘ভারত ও জাপান সাম্প্রতিক বছরগুলিতে তাদের সম্পর্ককে আরও গভীর করে চলেছে, চিনের প্রভাব প্রতিহত করার এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাদের নিজ নিজ ভূমিকা বাড়াতে তাদের প্রচেষ্টাকে একত্রিত করার দিকে মনোনিবেশ করছে ।’’ 2022 সালের সেপ্টেম্বরে শেষবার এই 2+2 বৈঠক হয় ৷ তখন গ্লোবাল টাইমস বলেছিল, ‘‘প্রতিরক্ষা বিষয়ে জাপান এবং ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, যার উপর চিন নজরে রাখে, তার উপর এই অঞ্চলে নিরাপত্তা নিয়ে অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগ বাড়াবে ।’’ চিন জানে যে এরা তার শত্রু ।
জাপান 2014 সালে তাদের সংবিধান পরিবর্তন করে ৷ সেখানে তার 'সম্মিলিত আত্মরক্ষার' অধিকার প্রয়োগ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে । 2022 সালে জাপান তার সামরিক বাহিনীকে পালটা আক্রমণ করার সক্ষমতা বৃদ্ধি করার আইন পাশ করে ৷ এই দেশ তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি এবং সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করে ৷ চিনা হুমকির প্রেক্ষিতেই এই সিদ্ধান্ত নেয় তারা ৷ এই পদক্ষেপ যা নিয়ে চিন আপত্তি জানায় । জাপান তাদের সামরিক শক্তি দ্রুত বৃদ্ধি করছে ।
যৌথ বিবৃতিতে অক্টোবর 2008-এ স্বাক্ষরিত নিরাপত্তা সহযোগিতা যৌথ ঘোষণার সংশোধন ও আপডেট করার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করা হয়েছে ৷ সমসাময়িক অগ্রাধিকার প্রতিফলিত করতে ও সমসাময়িক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে দুই দেশ, তা নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল হতেই এই প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয় ৷ এই বছরের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রী মোদি যখন টোকিও সফর করবেন, সেই সময় এই বিষয়টি সাক্ষরিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে ৷ স্পষ্টতই, উভয় দেশই উপলব্ধি করেছে যে প্রধানত চিনের হুমকির জন্য নিজেদের মধ্যে আরও সমন্বয় প্রয়োজন ।
অন্যান্য আলোচনার মধ্যে রয়েছে নৌ-রাডার সরঞ্জাম প্রযুক্তি ভাগাভাগি করার পাশাপাশি নৌযানের জন্য ইউনিকর্ন (ইউনিফাইড কমপ্লেক্স রেডিও অ্যান্টেনা), সর্বশেষ প্রযুক্তি যোগাযোগের জন্য তৈরি অ্যান্টেনা বিক্রি । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো, জাপানও ভারতীয় বন্দরে নৌযান রক্ষণাবেক্ষণ এবং মেরামত করার জন্য একটি চুক্তির বিষয়ে বিবেচনা করছে । দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রের গুরুত্বও বেড়েছে । রাজনাথ সিং মন্তব্য করেছেন, ‘‘ভারত-জাপান সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে ।’’ উদ্দেশ্য হল চিনকে মোকাবিলা করা ৷
জাপানের বিমান বাহিনী ভারতে চলমান তরঙ্গ শক্তি মহড়ায় অংশ নিচ্ছে ৷ এখন তার দ্বিতীয় পর্ব চলছে । তিনটি পরিষেবার সঙ্গে জড়িত এই যৌথ মহড়া গত বছর অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যা উভয় দেশ নিয়মিতভাবে চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । উভয়ই কোয়াড-এর সদস্য এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতে চিনা প্রভাব কমাতে অবদান রাখছে দুই দেশ ।
চিনের আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ডকে প্রতিহত করার জন্য ভারত যখন তার সশস্ত্র বাহিনীকে শক্তিশালী করছে, তখন একটি অতিরিক্ত প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে তার কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিও বাড়াতে হবে । চিন বিরোধী কূটনৈতিক গোষ্ঠী যত শক্তিশালী হবে, ততই ভালো । এশিয়ায় একটি শক্তিশালী অর্থনীতি ও ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তির দেশ জাপানের চেয়ে ভারতের জন্যই এক্ষেত্রে ভালো বেশি হবে ।
পূর্ব চিন সাগরে জনবসতিহীন সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে চিনের সঙ্গে জাপানের বিরোধ রয়েছে । তাইওয়ান থেকে মাত্র 170 কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই দ্বীপগুলির কৌশলগত মূল্য অপরিসীম । এই বিরোধে হেরে গেলে জাপানের বাণিজ্য রুদ্ধ হতে পারে ৷ আর চিনের জন্য সুবিধা হতে পারে । চিন দাবি করে যে এই দ্বীপগুলো তাইওয়ানের এবং তাই তাদের । গত সপ্তাহে জাপান জানিয়েছে যে একটি চিনা জরিপ জাহাজ তার জলসীমায় প্রবেশ করে । তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে দশম বার এমন ঘটনা ঘটল ।
2022 সালের অগস্টে যখন চিন তাইওয়ানের উপকূলে মহড়া চালায়, মার্কিন হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইপেই সফরের প্রতিক্রিয়া হিসাবে, তার পাঁচটি ক্ষেপণাস্ত্র জাপানের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনে অবতরণ করে । এই নিয়ে চিনের কাছে প্রতিবাদ জানায় জাপান ।
জবাবে চিনা মুখপাত্র উল্লেখ করেন, ‘‘চিন ও জাপান প্রাসঙ্গিক জলসীমায় সামুদ্রিক সীমানা নির্ধারণ করেনি ৷ তাই জাপানের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনে চিনের সামরিক তৎপরতা অনুষ্ঠিত বা প্রবেশ করার মতো কিছু নেই ।’’
জাপান, ফিলিপিন্স ও ভারতের বিরুদ্ধে স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার অনুরূপ নীতি গ্রহণ করছে চিন । এর ক্রিয়াগুলি সালামি কাটার মতোই, তা স্থলে হোক বা সমুদ্রে । জাপানের আবার চিনের পারমাণবিক শক্তিধর বন্ধু উত্তর কোরিয়ার থেকে অতিরিক্ত হুমকি রয়েছে ।
এর ফলে ভারত, জাপান ও ফিলিপিন্স - তিনটি দেশ কাছাকাছি চলে আসছে । জাপান ও ফিলিপিন্স এই বছরের জুলাই মাসে যৌথ মহড়া-সহ প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়াতে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে । জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়োকো কামিকাওয়া বলেন, ‘‘আইনের শাসনের উপর ভিত্তি করে একটি অবাধ ও উন্মুক্ত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা আঞ্চলিক শান্তি ও সমৃদ্ধির ভিত্তি ।’’
দক্ষিণ চিন সাগরে সর্বশেষ চিন-ফিলিপিন্সের উপকূলরক্ষীদের বোটে ধাক্কাধাক্কির ঘটনার পরে ফিলিপিন্স ও জাপানের নিরাপত্তার গ্যারান্টার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সতর্কতা জারি করেছে । তারা একটি বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে, ‘‘দক্ষিণ চিন সাগরের যে কোনও জায়গায় ফিলিপিন্সের সশস্ত্র বাহিনী, পাবলিক ভেসেল বা বিমান, এর উপকূলরক্ষীদের উপর সশস্ত্র আক্রমণের বিষয় নিয়ে 1951 সালের ইউএস-ফিলিপিন্স পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তির চার নম্বর ধারার কথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবার মনে করিয়ে দিতে চায় ৷’’
ভারত ও ফিলিপিন্সের মধ্যেও ঘনিষ্ঠ প্রতিরক্ষা সহযোগিতা রয়েছে । ভারতে ফিলিপিন্সের রাষ্ট্রদূত জোসেল ফ্রান্সিসকো ইগনাসিও একটি সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন, ‘‘ভারত থেকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম অধিগ্রহণ একটি বৃহত্তর প্রতিরক্ষা সম্পর্কের একটি দিক মাত্র ।’’
প্রতিরক্ষা থেকে প্রতিরক্ষা এবং সামরিক থেকে সামরিক আলোচনা, সাধারণ উদ্বেগের বিষয়গুলিতে মতামত বিনিময়ও এই সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । ফিলিপিন্সের ক্যাডেটদের ভারতীয় অ্য়াকাডেমিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে । ভারত থেকে ব্রহ্মোস মিসাইলও কিনেছে তারা ।
জাপান এবং ফিলিপিন্সের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত অংশীদারিত্ব রয়েছে ৷ এটি ভারতের নিকটতম কৌশলগত বন্ধু । আশা করা যায় যে এই তিনটি দেশ একটি অভিন্ন শত্রু চিনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একে অপরের সহযোগিতা করবে । ভারত-জাপান 2+2 আলোচনা ঠিক তেমনই, চিনা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে হাত মেলানো । ফিলিপিন্সের সঙ্গে উভয় দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায়, এটি কেবল সময়ের ব্যাপার যখন তিনটি দেশ চিনের বিরুদ্ধে এক গোষ্ঠীতে পরিণত হয় । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি, এটি একটি শক্তিশালী কূটনৈতিক এবং সামরিক গোষ্ঠী হতে পারে ।
(এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামতগুলি লেখকের । এখানে প্রকাশিত তথ্য এবং মতামত ইটিভি ভারত-এর মতামতকে প্রতিফলিত করে না ৷)