ETV Bharat / opinion

হিমবাহী হ্রদে বিস্ফোরণের জেরে হিমালয়ে ঝুঁকি বাড়ছে - Glacial Lake Outbursts

author img

By C P Rajendran

Published : Sep 4, 2024, 5:27 PM IST

Glacial Lake Outbursts: হিমবাহী হ্রদে বিস্ফোরণের জেরে বন্যার ফলে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়, তা অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে হওয়া বন্যার চেয়ে বেশি ক্ষতি ও ধ্বংস করে । লেখক জোর দিয়ে বলেছেন যে হিমালয়ের হ্রদ বিস্ফোরণ ওই অঞ্চলে ঝুঁকি বাড়ছে ৷ তাই হিমালয় সংলগ্ন রাজ্যগুলির বর্তমান উন্নয়ন মডেলগুলিকে গুরুত্ব দিয়ে নতুন করে বিবেচনা করা উচিত ।

Himalayas
হিমালয় (এএনআই)

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অথরিটি (এনডিএমএ) হিমালয়ের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিমবাহের হ্রদগুলি পর্যবেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । হিমালয়ের হ্রদে বিস্ফোরণ এখন সেখানে একটি বড় ঝুঁকির কারণ হয়ে উঠছে৷ সেই কারণে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ৷ হিমালয় পাঁচ হাজারের বেশি হিমবাহী হ্রদ এবং প্রায় দু’শোটি হ্রদ এখন উপচে পড়ার মতো পরিস্থিতিতে রয়েছে ৷ জলবায়ু পরিবর্তন ও মানুষ বেশি যাওয়ায় বায়ুমণ্ডলীয় উষ্ণায়ন বাড়ছে ওই এলাকায় ৷ সেই কারণে ‘গল্ফ’ (জিওএলএফ)-এর ঝুঁকিও বাড়ছে ৷

হিমবাহী হ্রদ বিস্ফোরণের জেরে বন্যা (গ্লেসিয়াল লেক আউটব্রাস্ট ফ্লাড), বৈজ্ঞানিকভাবে একে জিওএলএফ বা ‘গল্ফ’ বলা হয় ৷ অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে হওয়া বন্যার চেয়ে বেশি ক্ষতি ও ধ্বংস হয় এই ‘গল্ফ’-এর জেরে । সাম্প্রতিক অতীতে বেশ কিছু ‘গল্ফ’ বিপর্যয় ঘটেছে । 2013 সালের কেদারনাথ বিপর্যয়টি ছিল ‘গল্ফ’-এর সবচেয়ে বিধ্বংসী উদাহরণগুলির মধ্যে একটি, যা পাহাড়ে উপচে পড়া হিমবাহী হ্রদ থেকে হয়েছিল ৷ যেখানে ছ’হাজার জন নিহত হয়েছিল ।

2014 সালের 6 অগস্ট মধ্যরাতে লাদাখের গিয়া গ্রামে আঘাত হানে একটি ‘গল্ফ’ ৷ এর জেরে সেতু, বাড়িঘর ও খামার ধ্বংস হয়ে যায় । এটি তুষারপাত বা ভূমিধসের কারণে ঘটেনি ৷ বরং বরফের কোরগুলি গলে যাওয়ার কারণে ঘটেছিল ৷ যার ফলে ভূ-পৃষ্ঠের চ্যানেলগুলির মাধ্যমে জল নিষ্কাশন হয়েছিল । 2021-এর 7 ফেব্রুয়ারি উত্তরাখণ্ডের চামোলিতে ঋষিগঙ্গা এবং ধৌলিগঙ্গা উপত্যকায় কিছুটা অনুরূপভাবে প্রচুর পরিমাণে জলপ্রবাহ নেমে আসে, যার ফলে দু’শো জনেরও বেশি লোক মারা যায় এবং দু’টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ক্ষতি হয় ।

2013 সালের কেদারনাথে হড়পা বানের ক্ষেত্রে যেমন পাহাড়ের শীর্ষে একটি হিমবাহী হ্রদ উপচে পড়েছিল, লাদাখ ও চামোলির ঘটনায় কিন্তু তেমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি ৷ তবুও, এই সমস্ত ঘটনাগুলি ঘটনার নেপথ্য কারণ একটি মৌলিক স্তরের সঙ্গে সম্পর্কিত, তা হল স্থায়ী বরফের অসময়ে গলে যাওয়া ৷ না হলে এটাকে পারমাফ্রস্ট (ভূগর্ভস্থ চিরহিমায়িত অঞ্চল) বলা হতো । মাউন্টেন পারমাফ্রস্ট হল শিলার মধ্যে ফাটল এবং ফাটলের মধ্যে থাকা বরফ, যা তাদের একসঙ্গে ধরে রাখে এবং খাড়া ঢালগুলিকে স্থিতিশীল করতে সহায়তা করে ।

মাউন্টেন পারমাফ্রস্ট যখন গলে যায়, তখন যে আঠা ভাঙা শিলাকে পৃষ্ঠের বরফের সঙ্গে আবদ্ধ করে রাখে, তা পাহাড়ের ঢালের ক্ষয়কে বৃদ্ধিতে সাহায্য করে ৷ গত কয়েক দশকের উষ্ণ তাপমাত্রা অবশ্যই এই পারমাফ্রস্ট গলে যাওয়ার কারণে হয়েছে ৷

‘গল্ফ’ সম্পর্কিত একটি বিপর্যয় 2023 সালের 4 অক্টোবর (বুধবার) ভোররাতে সিকিমে আঘাত হানে ৷ সেই ঘটনায় অন্তত 40 জনের মৃত্যু হয়েছিল এবং আরও অনেক লোক নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল ৷ প্রবল বৃষ্টির কারণে সিকিমের হিমবাহী দক্ষিণ লোনাক হ্রদ বিস্ফোরিত হয়ে নিম্নধারার অঞ্চলে বিধ্বংসী বন্যা হয় ৷ লাচেন উপত্যকায় তিস্তা নদীতে প্রবাহিত বন্যার জলের ঢেউ এতটাই তীব্র ছিল যে বেশ কয়েকটি সেতু ও রাস্তা ভেসে যায় এবং সিকিমের চুংথাং-এ তিস্তা-তিন বাঁধে সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পেরও কিছুটা অংশ জলের তোড়ে ভেসে যায় ৷

Glacial Lake Outbursts
হিমবাহী হ্রদে বিস্ফোরণের জেরে হিমালয়ে ঝুঁকি বাড়ছে (ইটিভি ভারত)

আকস্মিক এই বন্যা মেঘ বিস্ফোরণের ফলে ঘটেছিল ৷ যার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে 5200 মিটার উপরে অবস্থিত লোনাক হিমবাহী হ্রদটি আবদ্ধ মোরাইনকেও ছাপিয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত এটি একটি আউটলেট তৈরি করতে ক্ষয় শুরু করে । সিকিমে এই বিপর্যয়কে হিমালয়ে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি বলা যেতে পারে ৷ বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ও পর্বত হিমবাহ এবং পারমাফ্রস্ট দীর্ঘস্থায়ীভাবে গলে যাওয়ার কারণে ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছে । অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং নৃতাত্ত্বিক ক্রিয়াকলাপের কারণে ব্যাপক বিপর্যয় হচ্ছে ৷

মেরু অঞ্চলের বাইরে হিমালয়ে তুষার ও বরফের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি । তাই এটাকে 'তৃতীয় মেরু'ও বলা হয় ৷ এখানে হিমবাহের একটি বিশাল ভাণ্ডার রয়েছে৷ হিমালয় এশিয়ার কয়েকটি প্রধান নদীর উৎপত্তিস্থল । এটি এশিয়ার সাধারণ বৈশ্বিক জলবায়ুর একটি প্রধান নিয়ন্ত্রক । চিন, ভারত, পাকিস্তান এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলিতে বিভিন্ন নদীর তীরে বসবাসকারী এক বিলিয়ন মানুষ তাদের জলের চাহিদা মেটাতে হিমালয় ও তিব্বত মালভূমির উপর নির্ভর করে । বৈজ্ঞানিক গবেষণা আমাদের জানায় যে এই তৃতীয় ধরনের শক্তি, যা এখন বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রধান চালক হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে, তা প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে প্রভাবিত করে ও পর্বতশ্রেণীতে পরিবেশগত পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে ।

চিন, ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ জলের জন্য হিমালয় এবং তিব্বত মালভূমির উপর নির্ভরশীল । সাম্প্রতিক অনুমানগুলি ইঙ্গিত দেয় যে মাউন্ট এভারেস্টের আশেপাশের অঞ্চলে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের জেরে উষ্ণায়নের কারণে 2100 সালের মধ্যে হিমবাহের আয়তনের 70-99 শতাংশ হারাতে পারে । তীর্থযাত্রী পর্যটনের কারণে ভারী যানবাহন থেকে ধোঁয়া নির্গমন ও কালো কার্বন বা কাঁচের বৃদ্ধির ফলে হিমবাহ গলে যেতে পারে এবং পরিবেশগত অবনতি ঘটতে পারে ।

গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে কালো কার্বন একাই হিমালয়ের মোট হিমবাহের অন্তত 30 শতাংশ গলিয়ে দেয় । এই ফলাফল খুব উদ্বেগজনক পরিস্থিতির ইঙ্গিত দেয় । গবেষণাগুলি দেখায় যে দীর্ঘমেয়াদে হিমবাহ গলে যাওয়ার ফলে হিমালয়ের হিমবাহ হ্রদ তৈরি হয়, যা সম্ভাব্য অস্থির মোরেইন দ্বারা বাঁধা রয়েছে ৷ হিমবাহ দ্বারা পরিবাহিত আলগা ধ্বংসাবশেষই হল এই মোরাইন । বরফ বা ধ্বংসাবশেষের পতন, ভূমিকম্প বা তীব্র বৃষ্টিপাতের ফলে তৈরি হওয়া তরঙ্গের জেরে এই হ্রদগুলিতে বিস্ফোরণ হওয়ার ঝুঁকি থাকে ৷ এই বিপর্যয় এক মিনিট বা এক ঘণ্টার মধ্যে ঘটতে পারে ৷ তখন পলি-বোঝাই জল নীচের দিকে ছুটে যায় এবং এর জেরে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায় ।

গবেষণা আরও ইঙ্গিত করে যে হিমবাহের হ্রদগুলি সংখ্যায় অনেক বেশি এবং পর্বতশ্রেণীর অন্যান্য অংশের তুলনায় 1990 সাল থেকে মধ্য ও পূর্ব হিমালয়ে এই হ্রদগুলি বেশি দেখা দিয়েছে । শিলা তুষারপাত উচ্চতর উচ্চতায় শুরু হয়, যেখানে পর্বতের ঢালগুলিতে দীর্ঘমেয়াদী তাপমাত্রার পরিবর্তনের জন্য বেশি মাউন্টেন পারমাফ্রস্ট থাকে ।

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ইঙ্গিত করে, গত 25 জুলাই কেন্দ্রীয় সরকার যে ন্যাশনাল গ্লাসিয়াল লেক আউটবার্স্ট ফ্লাডস রিস্ক মিটিগেশন প্রোগ্রামের অনুমোদন দিয়েছে, তা উচ্চ-ঝুঁকি হিসাবে চিহ্নিত সিকিমের ছয়টি হ্রদের আয়তন, গভীরতা ও অনুদৈর্ঘ্য প্রোফাইলের মূল্যায়ন করবে । বৈদ্যুতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা টমোগ্রাফি জরিপ এবং গ্রাউন্ড পেনিট্রেটিং রাডার সার্ভে ব্যবহার করে তাদের স্থিতিশীলতা ও ঝুঁকির কারণগুলি মূল্যায়ন করতে এই সমীক্ষাটি করা হবে ৷ এর ফলে এই মোরাইন বাঁধগুলির একটি ভূ-পদার্থগত মূল্যায়ন করা যাবে ।

হিমবাহী হ্রদে জলের পরিমাণ কমানোর উপায় খুঁজে বের করা হল, ‘গল্ফ’-এর ঝুঁকি কমানোর একটি উপায় । যদিও হিমবাহী হ্রদের উন্নত তালিকা এখন উপলব্ধ ৷ তবে ঝুঁকি বিশ্লেষণের জন্য হ্রদের আয়তনের আরও সুনির্দিষ্ট অনুমান করতে বাথিমেট্রিক ডেটা প্রয়োজন ।

সম্ভাব্য বিপজ্জনক হিমবাহী হ্রদের ম্যাপিং এবং তাদের ‘গল্ফ’ বিপদের মূল্যায়নের মাধ্যমে এলাকায় এই ধরনের দুর্যোগের প্রভাব প্রশমিত করার জন্য উপযুক্ত প্রশমন পদ্ধতি তৈরি করা উচিত । মানুষের বাসস্থানের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা এবং হিমালয়ে হাইড্রো-ইলেকট্রিকাল প্রকল্প, সেতু, টানেল ও রাস্তার মতো পরিকাঠামো নির্মাণে মানুষের উপস্থিতি বৃদ্ধি পেলে ক্রায়োস্ফিয়ারে বিপদ বাড়ে ৷ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে অনিয়ন্ত্রিত তীর্থযাত্রী পর্যটন, বর্ধিত দুর্যোগের সম্ভাবনা এবং দুর্বলতা-সহ হিমালয় সংলগ্ন রাজ্যগুলির জন্য বর্তমান উন্নয়নমূলক মডেলগুলিকে গুরুত্ব দিয়ে পুনর্বিবেচনা করা উচিত ।

(এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামতগুলি লেখকের । এখানে প্রকাশিত তথ্য এবং মতামত ইটিভি ভারত-এর মতামতকে প্রতিফলিত করে না ৷)

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অথরিটি (এনডিএমএ) হিমালয়ের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিমবাহের হ্রদগুলি পর্যবেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । হিমালয়ের হ্রদে বিস্ফোরণ এখন সেখানে একটি বড় ঝুঁকির কারণ হয়ে উঠছে৷ সেই কারণে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ৷ হিমালয় পাঁচ হাজারের বেশি হিমবাহী হ্রদ এবং প্রায় দু’শোটি হ্রদ এখন উপচে পড়ার মতো পরিস্থিতিতে রয়েছে ৷ জলবায়ু পরিবর্তন ও মানুষ বেশি যাওয়ায় বায়ুমণ্ডলীয় উষ্ণায়ন বাড়ছে ওই এলাকায় ৷ সেই কারণে ‘গল্ফ’ (জিওএলএফ)-এর ঝুঁকিও বাড়ছে ৷

হিমবাহী হ্রদ বিস্ফোরণের জেরে বন্যা (গ্লেসিয়াল লেক আউটব্রাস্ট ফ্লাড), বৈজ্ঞানিকভাবে একে জিওএলএফ বা ‘গল্ফ’ বলা হয় ৷ অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে হওয়া বন্যার চেয়ে বেশি ক্ষতি ও ধ্বংস হয় এই ‘গল্ফ’-এর জেরে । সাম্প্রতিক অতীতে বেশ কিছু ‘গল্ফ’ বিপর্যয় ঘটেছে । 2013 সালের কেদারনাথ বিপর্যয়টি ছিল ‘গল্ফ’-এর সবচেয়ে বিধ্বংসী উদাহরণগুলির মধ্যে একটি, যা পাহাড়ে উপচে পড়া হিমবাহী হ্রদ থেকে হয়েছিল ৷ যেখানে ছ’হাজার জন নিহত হয়েছিল ।

2014 সালের 6 অগস্ট মধ্যরাতে লাদাখের গিয়া গ্রামে আঘাত হানে একটি ‘গল্ফ’ ৷ এর জেরে সেতু, বাড়িঘর ও খামার ধ্বংস হয়ে যায় । এটি তুষারপাত বা ভূমিধসের কারণে ঘটেনি ৷ বরং বরফের কোরগুলি গলে যাওয়ার কারণে ঘটেছিল ৷ যার ফলে ভূ-পৃষ্ঠের চ্যানেলগুলির মাধ্যমে জল নিষ্কাশন হয়েছিল । 2021-এর 7 ফেব্রুয়ারি উত্তরাখণ্ডের চামোলিতে ঋষিগঙ্গা এবং ধৌলিগঙ্গা উপত্যকায় কিছুটা অনুরূপভাবে প্রচুর পরিমাণে জলপ্রবাহ নেমে আসে, যার ফলে দু’শো জনেরও বেশি লোক মারা যায় এবং দু’টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ক্ষতি হয় ।

2013 সালের কেদারনাথে হড়পা বানের ক্ষেত্রে যেমন পাহাড়ের শীর্ষে একটি হিমবাহী হ্রদ উপচে পড়েছিল, লাদাখ ও চামোলির ঘটনায় কিন্তু তেমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি ৷ তবুও, এই সমস্ত ঘটনাগুলি ঘটনার নেপথ্য কারণ একটি মৌলিক স্তরের সঙ্গে সম্পর্কিত, তা হল স্থায়ী বরফের অসময়ে গলে যাওয়া ৷ না হলে এটাকে পারমাফ্রস্ট (ভূগর্ভস্থ চিরহিমায়িত অঞ্চল) বলা হতো । মাউন্টেন পারমাফ্রস্ট হল শিলার মধ্যে ফাটল এবং ফাটলের মধ্যে থাকা বরফ, যা তাদের একসঙ্গে ধরে রাখে এবং খাড়া ঢালগুলিকে স্থিতিশীল করতে সহায়তা করে ।

মাউন্টেন পারমাফ্রস্ট যখন গলে যায়, তখন যে আঠা ভাঙা শিলাকে পৃষ্ঠের বরফের সঙ্গে আবদ্ধ করে রাখে, তা পাহাড়ের ঢালের ক্ষয়কে বৃদ্ধিতে সাহায্য করে ৷ গত কয়েক দশকের উষ্ণ তাপমাত্রা অবশ্যই এই পারমাফ্রস্ট গলে যাওয়ার কারণে হয়েছে ৷

‘গল্ফ’ সম্পর্কিত একটি বিপর্যয় 2023 সালের 4 অক্টোবর (বুধবার) ভোররাতে সিকিমে আঘাত হানে ৷ সেই ঘটনায় অন্তত 40 জনের মৃত্যু হয়েছিল এবং আরও অনেক লোক নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল ৷ প্রবল বৃষ্টির কারণে সিকিমের হিমবাহী দক্ষিণ লোনাক হ্রদ বিস্ফোরিত হয়ে নিম্নধারার অঞ্চলে বিধ্বংসী বন্যা হয় ৷ লাচেন উপত্যকায় তিস্তা নদীতে প্রবাহিত বন্যার জলের ঢেউ এতটাই তীব্র ছিল যে বেশ কয়েকটি সেতু ও রাস্তা ভেসে যায় এবং সিকিমের চুংথাং-এ তিস্তা-তিন বাঁধে সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পেরও কিছুটা অংশ জলের তোড়ে ভেসে যায় ৷

Glacial Lake Outbursts
হিমবাহী হ্রদে বিস্ফোরণের জেরে হিমালয়ে ঝুঁকি বাড়ছে (ইটিভি ভারত)

আকস্মিক এই বন্যা মেঘ বিস্ফোরণের ফলে ঘটেছিল ৷ যার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে 5200 মিটার উপরে অবস্থিত লোনাক হিমবাহী হ্রদটি আবদ্ধ মোরাইনকেও ছাপিয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত এটি একটি আউটলেট তৈরি করতে ক্ষয় শুরু করে । সিকিমে এই বিপর্যয়কে হিমালয়ে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি বলা যেতে পারে ৷ বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ও পর্বত হিমবাহ এবং পারমাফ্রস্ট দীর্ঘস্থায়ীভাবে গলে যাওয়ার কারণে ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছে । অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং নৃতাত্ত্বিক ক্রিয়াকলাপের কারণে ব্যাপক বিপর্যয় হচ্ছে ৷

মেরু অঞ্চলের বাইরে হিমালয়ে তুষার ও বরফের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি । তাই এটাকে 'তৃতীয় মেরু'ও বলা হয় ৷ এখানে হিমবাহের একটি বিশাল ভাণ্ডার রয়েছে৷ হিমালয় এশিয়ার কয়েকটি প্রধান নদীর উৎপত্তিস্থল । এটি এশিয়ার সাধারণ বৈশ্বিক জলবায়ুর একটি প্রধান নিয়ন্ত্রক । চিন, ভারত, পাকিস্তান এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলিতে বিভিন্ন নদীর তীরে বসবাসকারী এক বিলিয়ন মানুষ তাদের জলের চাহিদা মেটাতে হিমালয় ও তিব্বত মালভূমির উপর নির্ভর করে । বৈজ্ঞানিক গবেষণা আমাদের জানায় যে এই তৃতীয় ধরনের শক্তি, যা এখন বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রধান চালক হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে, তা প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে প্রভাবিত করে ও পর্বতশ্রেণীতে পরিবেশগত পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে ।

চিন, ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ জলের জন্য হিমালয় এবং তিব্বত মালভূমির উপর নির্ভরশীল । সাম্প্রতিক অনুমানগুলি ইঙ্গিত দেয় যে মাউন্ট এভারেস্টের আশেপাশের অঞ্চলে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের জেরে উষ্ণায়নের কারণে 2100 সালের মধ্যে হিমবাহের আয়তনের 70-99 শতাংশ হারাতে পারে । তীর্থযাত্রী পর্যটনের কারণে ভারী যানবাহন থেকে ধোঁয়া নির্গমন ও কালো কার্বন বা কাঁচের বৃদ্ধির ফলে হিমবাহ গলে যেতে পারে এবং পরিবেশগত অবনতি ঘটতে পারে ।

গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে কালো কার্বন একাই হিমালয়ের মোট হিমবাহের অন্তত 30 শতাংশ গলিয়ে দেয় । এই ফলাফল খুব উদ্বেগজনক পরিস্থিতির ইঙ্গিত দেয় । গবেষণাগুলি দেখায় যে দীর্ঘমেয়াদে হিমবাহ গলে যাওয়ার ফলে হিমালয়ের হিমবাহ হ্রদ তৈরি হয়, যা সম্ভাব্য অস্থির মোরেইন দ্বারা বাঁধা রয়েছে ৷ হিমবাহ দ্বারা পরিবাহিত আলগা ধ্বংসাবশেষই হল এই মোরাইন । বরফ বা ধ্বংসাবশেষের পতন, ভূমিকম্প বা তীব্র বৃষ্টিপাতের ফলে তৈরি হওয়া তরঙ্গের জেরে এই হ্রদগুলিতে বিস্ফোরণ হওয়ার ঝুঁকি থাকে ৷ এই বিপর্যয় এক মিনিট বা এক ঘণ্টার মধ্যে ঘটতে পারে ৷ তখন পলি-বোঝাই জল নীচের দিকে ছুটে যায় এবং এর জেরে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায় ।

গবেষণা আরও ইঙ্গিত করে যে হিমবাহের হ্রদগুলি সংখ্যায় অনেক বেশি এবং পর্বতশ্রেণীর অন্যান্য অংশের তুলনায় 1990 সাল থেকে মধ্য ও পূর্ব হিমালয়ে এই হ্রদগুলি বেশি দেখা দিয়েছে । শিলা তুষারপাত উচ্চতর উচ্চতায় শুরু হয়, যেখানে পর্বতের ঢালগুলিতে দীর্ঘমেয়াদী তাপমাত্রার পরিবর্তনের জন্য বেশি মাউন্টেন পারমাফ্রস্ট থাকে ।

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ইঙ্গিত করে, গত 25 জুলাই কেন্দ্রীয় সরকার যে ন্যাশনাল গ্লাসিয়াল লেক আউটবার্স্ট ফ্লাডস রিস্ক মিটিগেশন প্রোগ্রামের অনুমোদন দিয়েছে, তা উচ্চ-ঝুঁকি হিসাবে চিহ্নিত সিকিমের ছয়টি হ্রদের আয়তন, গভীরতা ও অনুদৈর্ঘ্য প্রোফাইলের মূল্যায়ন করবে । বৈদ্যুতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা টমোগ্রাফি জরিপ এবং গ্রাউন্ড পেনিট্রেটিং রাডার সার্ভে ব্যবহার করে তাদের স্থিতিশীলতা ও ঝুঁকির কারণগুলি মূল্যায়ন করতে এই সমীক্ষাটি করা হবে ৷ এর ফলে এই মোরাইন বাঁধগুলির একটি ভূ-পদার্থগত মূল্যায়ন করা যাবে ।

হিমবাহী হ্রদে জলের পরিমাণ কমানোর উপায় খুঁজে বের করা হল, ‘গল্ফ’-এর ঝুঁকি কমানোর একটি উপায় । যদিও হিমবাহী হ্রদের উন্নত তালিকা এখন উপলব্ধ ৷ তবে ঝুঁকি বিশ্লেষণের জন্য হ্রদের আয়তনের আরও সুনির্দিষ্ট অনুমান করতে বাথিমেট্রিক ডেটা প্রয়োজন ।

সম্ভাব্য বিপজ্জনক হিমবাহী হ্রদের ম্যাপিং এবং তাদের ‘গল্ফ’ বিপদের মূল্যায়নের মাধ্যমে এলাকায় এই ধরনের দুর্যোগের প্রভাব প্রশমিত করার জন্য উপযুক্ত প্রশমন পদ্ধতি তৈরি করা উচিত । মানুষের বাসস্থানের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা এবং হিমালয়ে হাইড্রো-ইলেকট্রিকাল প্রকল্প, সেতু, টানেল ও রাস্তার মতো পরিকাঠামো নির্মাণে মানুষের উপস্থিতি বৃদ্ধি পেলে ক্রায়োস্ফিয়ারে বিপদ বাড়ে ৷ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে অনিয়ন্ত্রিত তীর্থযাত্রী পর্যটন, বর্ধিত দুর্যোগের সম্ভাবনা এবং দুর্বলতা-সহ হিমালয় সংলগ্ন রাজ্যগুলির জন্য বর্তমান উন্নয়নমূলক মডেলগুলিকে গুরুত্ব দিয়ে পুনর্বিবেচনা করা উচিত ।

(এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামতগুলি লেখকের । এখানে প্রকাশিত তথ্য এবং মতামত ইটিভি ভারত-এর মতামতকে প্রতিফলিত করে না ৷)

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.