2023 সালের মে মাসের শুরুর দিকে মণিপুরে মেইতি ও কুকিদের মধ্যে জাতিগত হিংসা শুরু হয়েছিল ৷ এখনও পর্যন্ত সেই হিংসাত্মক পরিস্থিতি শেষ হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না ৷ প্রতিদিন সংঘর্ষ হয়েই চলেছে ৷ সাম্প্রতিক রিপোর্টে তো ড্রোন ও রকেট চালিত গ্রেনেড-সহ উন্নত অস্ত্রের ব্যবহারের বিষয়টি সামনে আসতে শুরু করেছে ৷
চলতি মাসের এক তারিখ পশ্চিম ইম্ফলের কাউটরুকে কুকি জঙ্গি ড্রোন ব্যবহার করে হামলা চালায় ৷ সেই হামলায় একজন নিহত হন এবং তিনজন নিরাপত্তা কর্মী-সহ বেশ কয়েকজন আহত হন । এর পরে মণিপুরে এই ধরনের একাধিক হামলার ঘটনা ঘটে ৷ যা থেকে মনে হচ্ছে অত্যাধুনিক অস্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে সংঘর্ষ বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে । জাতীয় নিরাপত্তার প্রেক্ষাপটে হিংসার ধরনের এই পরিবর্তনকে দেখা উচিত ৷ কারণ, জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি সংঘাতের কার্যকরী সমাধানের প্রয়োজনীয়তাকে ঢেকে দিয়েছে ৷ হিংসার মূল কারণ ও এর জেরে তৈরি হওয়া সামাজিক প্রতিক্রিয়ার জেরে তৈরি হওয়া সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে অস্ত্রের উৎসের তদন্ত করার উপর বেশি নজর দেওয়া হয়েছে ৷
রাজ্যের পদক্ষেপ
মেইতি-কুকি সংঘর্ষ নিয়ে রাজ্যের পদক্ষেপ অনেকাংশে অপর্যাপ্ত । হিংসা দমন করতে যে পদক্ষেপ করা হয়েছে, তার বেশিরভাগই নিরাপত্তার বিষয়টিকে সামনে রেখে করা হয়েছে ৷ যেমন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে কারফিউ জারি করা ও ইন্টারনেট বন্ধ করে রাখা ৷ যদিও পদক্ষেপের এই কৌশলগুলি প্রচলিত ৷ তারা সংঘাতের অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলির সমাধানের পরিবর্তে লক্ষণগুলিকে মোকাবিলা করেছে ।
চলতি বছরের 29 জুন মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং দাবি করেছিলেন যে শীঘ্রই এই সংঘাতের সমাধান করা হবে ৷ কিন্তু সেপ্টেম্বরে হিংসা বৃদ্ধি পাওয়ার পর বোঝাই যাচ্ছে যে সেই আশ্বাস বাস্তবায়িত হয়নি ৷ নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের পাশাপাশি সরকার যে বিপদগুলি চিহ্নিত করেছে, তা হল - কুকিদের সাহায্যে মায়ানমার থেকে অনুপ্রবেশ, কুকি-অধ্যুষিত এলাকায় ক্রমবর্ধমান গাঁজার চাষ এবং জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে বহিরাগত শক্তির অস্ত্র সরবরাহ ৷ এই বিষয়গুলিকে সমাধান করার জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে ৷
যদিও এই উদ্বেগের যৌক্তিকতা রয়েছে, তার পরও রাজ্যের তরফে বিষয়গুলি চিহ্নিত করার পরও কার্যকরী কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি ৷ সংঘাত সমাধান নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর তরফে দেওয়া আশ্বাস ছিল তৃতীয় এনডিএ সরকারের প্রথম একশো দিনের পরিকল্পনার একটি অংশ, যে সরকার গত 4 জুন পথ চলা শুরু করেছে ৷ তাই ওই আশ্বাসকে ‘ঘোর ব্যর্থতা’ বলে উল্লেখ করেন কংগ্রেসের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে ৷ 'মণিপুরের আদিবাসীদের নির্মূলে' কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করেছে কোর্ডিনেটিং কমিটি অন মণিপুর ইন্ট্রিগ্রিটি (কোকোমি)-র মতো মণিপুরের নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলি ৷
কুকি ও মেইতি, দুই পক্ষের সদিচ্ছার অভাব
সংঘর্ষে জড়িত উভয় সম্প্রদায়ের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে । শান্তি পুনঃস্থাপনের লক্ষ্যে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অর্থপূর্ণ আলোচনা শুরুর প্রয়াস খুবই সামান্য হয়েছে ৷ কুকিদের শীর্ষ সংগঠন কুকি ইনপি চলতি বছরের জুলাই মাসে ঘোষণা করেছিল যে কুকি ও মেইতিদের মধ্যে কোনও শান্তি আলোচনা চলছে না ।
কুকিদের কাছ থেকে এমন একটি বিবৃতি মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতির আগে দেওয়া হয়েছিল, তা থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে মেইতি ও কুকিদের মধ্যে শান্তি আলোচনা মণিপুরের আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে প্রভাবিত করবে না । গত 1 অগস্ট যদিও জিরাবাম জেলায় হামারস (একটি কুকি উপ-গোষ্ঠী) এবং মেইতিদের মধ্যে একটি শান্তি বৈঠক হয়েছিল ৷ তবে সেই বৈঠক থেকে কোনও উল্লেখযোগ্য ফলাফল সামনে আসেনি ।
এর বদলে উভয়পক্ষের সামাজিক সংগঠনগুলি নিজেদের দাবি আদায়ে অনড় ৷ একটি পৃথক আঞ্চলিক বা প্রশাসনিক ব্যবস্থার জন্য কুকি সংস্থাগুলির চাপ ততটাই বিতর্কিত, যতটা বিতর্কিত মেইতি গোষ্ঠীর তরফে তোলা কুকিদের স্বদেশীয়তার দাবি নিয়ে প্রশ্ন ৷ মণিপুরের 'আঞ্চলিক অখণ্ডতা' রক্ষা নিয়ে মেইতিদের ব্যাখ্যা কেবল দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনাকেই বাড়িয়ে দিয়েছে ।
একটি পৃথক অঞ্চলের জন্য কুকিদের দাবি তাদেরই উপ-গোষ্ঠীর মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে বারবার চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে ৷ এর ফলে তাদের এই দাবির গুরুত্ব কমে গিয়েছে ৷ 2024 সালের এপ্রিলে ভারত-মায়ানমার সীমান্তে অবাধে চলাচল বন্ধ করে দেওয়া নিয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এই উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে ৷ এর ফলে বিশেষ করে আন্তঃসীমান্ত সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য কুকিদের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করেছে ।
দ্বন্দ্বের সমাধান
কুকি-মেইতি দ্বন্দ্ব নিরসনের বিষয়টি জরুরি, কিন্তু সেটাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করা যায় না । রাজ্যকে অবশ্যই একটি ব্যাপক পন্থা অবলম্বন করতে হবে, যা নিরাপত্তা ব্যবস্থার বাইরে প্রসারিত হয় । এর জন্য যে পদক্ষেপগুলি প্রয়োজন, তা হল - মেইতি, কুকি ও নাগাদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের অসামঞ্জস্য দূর করা, পাহাড় ও উপত্যকা অঞ্চলের মধ্যে উন্নয়নের ব্যবধান কমানো, স্বায়ত্তশাসিত জেলা পরিষদের জন্য নির্বাচন পরিচালনা এবং স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য এই কাউন্সিলগুলিকে আরও ক্ষমতা দেওয়া ৷
এটি উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে মণিপুরে সর্বশেষ নির্বাচিত স্বায়ত্তশাসিত জেলা পরিষদগুলির মেয়াদ 2020 সালের নভেম্বরে শেষ হয়ে গিয়েছে । মণিপুরে ছয়টি স্বায়ত্তশাসিত জেলা পরিষদের জন্য নির্বাচন পরিচালনায় চার বছর বিলম্ব হয়েছে । রাজ্য সরকার স্বায়ত্তশাসিত জেলা পরিষদের নির্বাচন পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিলেও কুকি দলগুলি বয়কটের ডাক দিয়েছে ।
এই ধরনের পরিস্থিতিতে স্বায়ত্তশাসিত জেলা পরিষদের নির্বাচনে সব সম্প্রদায়ের মানুষের সর্বাধিক অংশগ্রহণের অবস্থা তৈরি করা রাজ্য সরকারের দায়িত্ব । এই ধরনের পদক্ষেপ বিরোধে ইতি ঘটাতে পারে ৷ উপরন্তু, সংঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের অভিযোগ শোনার ও তা সমাধানের জন্য একটি উচ্চস্তরের কমিটি গঠন করা অপরিহার্য ।
শুধুমাত্র নিরাপত্তার দিক এবং বাহ্যিক কারণ যেমন অনুপ্রবেশ, মাদক পাচার ও অস্ত্র সরবরাহের উপর নজর দিলে, তা শুধুমাত্র সীমিত ফলাফলই দেবে ৷ সামাজিকভাবে, উভয় সম্প্রদায়েরই আলোচনা শুরু করতে হবে এবং আলোচনায় অংশ নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করতে হবে । যদিও সংঘাতের সমাধানের পথ দীর্ঘ ও জটিল হতে পারে, আলোচনাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হিংসাকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে পারে ও মণিপুরে আরও শান্তিপূর্ণ সমাধানে অবদান রাখতে পারে ।