কলকাতায় ভয়ঙ্কর ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় ফের মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে আলোড়ন তৈরি হয়েছে । অতীতের মতো আমরা আবার মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করছি ৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটবে না । প্রচার ও আলোচনার মধ্য়ে হয়তো কোনও যোজনা শুরু হবে, বক্তৃতা দেওয়া হবে ৷ কিন্তু বাস্তবে কোনও পরিবর্তন হবে না ৷ শ্লীলতাহানি করতে পারে এমন ব্যক্তি, উত্যক্ত করে এমন ব্যক্তি ও ধর্ষকদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করে যেতে হবে মেয়েদের ৷
গার্হস্থ্য হিংসা আমাদের সমাজের গভীরে প্রবেশ করে রয়েছে এবং কখনও কখনও তা প্রকাশ্যে চলে আসে ৷ প্রকাশ্যে আসা সেই ছবি অনেক সময় শহরের সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়ে এবং তা দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে ৷ একটা ভিডিয়ো হিসেবে সেগুলি দেখা হয় ৷ কিন্তু তারপরে কী ? আমরা এমন ঘটনায় পড়ি যে একটি মেয়ে কোনও পুরুষকে প্রত্যাখান করেছেন এবং সেই রাগে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে ৷ মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে রাজস্থানে একটি মেয়েকে ফ্রেন্ডশিপ ডে-তে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়া হয় ৷ সে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় তাকে চলন্ত ট্রেনের সামনে ধাক্কা দেওয়া হয়েছিল । তার বয়স ছিল মাত্র 15 । এই বছরের জুনে, মথুরায় এক কিশোরীকে হত্যা করা হয়েছিল৷ কারণ সে ফেসবুকে বন্ধুত্বের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল । এরকম অনেকগুলি ঘটনা আছে ৷ কিন্তু সেগুলি শুধুমাত্র কিছু রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে এবং তা নিয়ে সমাজে হইচই হয়েছে ।
কলকাতার ঘটনার মতো নির্যাতিতা একজন প্রাপ্তবয়স্ক হোক অথবা রাজস্থান বা মথুরার কিশোরী, খুনের ঘটনা নিঃসন্দেহে ভয়ঙ্কর । নাবালিকা বা শিশুদের উপর যৌন নিপীড়ন আমার মতে সমান ভয়ঙ্কর । মহারাষ্ট্রের বদলাপুরের একটি স্কুলে 3 এবং 4 বছর বয়সী শিশুদের উপর যৌন নিপীড়নের সাম্প্রতিক ঘটনাটি মর্মান্তিকের চেয়েও বেশি ৷ হাজার হাজার মানুষ তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে রাস্তায় নামেন এবং পুলিশ ও স্কুল প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন ।
শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধ
শিশুরা অপরাধ করলে, তা যতটা সংবাদ শিরোনামে আসে, শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধ নিয়ে সেই ভাবে হইচই হয় না ৷ আমরা হতবাক হয়ে যাই, যখন জানতে পারেনি যে উদয়পুরে দশম শ্রেণীর এক ছাত্র তার সহপাঠীকে পুরনো শত্রুতার জেরে ছুরিকাঘাত করেছে । একজন প্রাপ্তবয়স্ক একজন শিশুকে হত্যা বা ধর্ষণ করলে আমরা কি সমানভাবে হতবাক হই ? হ্যাঁ, আমরা হতবাক হই ৷ কিন্তু এই ধরনের অপরাধের কয়টি রিপোর্ট হয় বা আলোচনা হয় ? ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো প্রকাশনা ক্রাইম ইন ইন্ডিয়া 2022-এ শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধের যে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে, তা আপনাকে চমকে দেবে ৷ শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধের দু’টি বিভাগ রয়েছে । প্রথমত, ভারতীয় দণ্ডবিধি এবং বিশেষ ও স্থানীয় আইনের অধীনে মামলা । 2022 সালে শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধের মামলার সংখ্যা ছিল 1 লক্ষ 62 হাজার 449, যা বিস্ময়কর ৷ শুধু তাই নয়, এই সংখ্যা 2021 সালের তুলনায় 8.7 শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল । এর মধ্যে খুন, অপহরণ, মানব পাচার ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে । দ্বিতীয়ত, যৌন নিপীড়নের মামলা, যা যৌন অপরাধ থেকে শিশুদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি পকসো আইনের অধীনে থাকে ।
ওই বছর মেয়ে শিশুদের উপর যৌন নিপীড়নের 62 হাজারেরও বেশি ঘটনার রিপোর্ট করা হয়েছে । এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গড়ে প্রতি 10 মিনিটে একটি শিশুকন্যা যৌন নির্যাতনের শিকার হয় ৷ আমরা একটি সমাজ হিসাবে এই ভয়াবহ অবস্থা সম্পর্কে কী করেছি ?
আমি এই পরিসংখ্যান সম্পর্কে সতর্কতামূলক শব্দ যোগ করতে চাই ৷ এর মধ্যে কিশোরীদের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও রয়েছে । সংখ্যাটি খুব বেশি নয় ৷ তবে এই ধরনের ঘটনা প্রতিবারই ঘটে থাকে ৷ এই নিয়ে একটি পৃথক আলোচনার আহ্বান জানানো উচিত ৷
পকসো আইনের অধীনে অপরাধ মোকাবিলার জন্য বিশেষ আদালত স্থাপন করা হয়েছে । কিন্তু যেহেতু এই আদালতে হাজার হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে, তাই বিচারব্যবস্থা সেগুলি মোকাবিলা করতে এবং দ্রুত তার নিষ্পত্তি করতে পারছে না । এনসিআরবি তথ্য বলছে যে প্রায় 3 লক্ষ মামলা আদালতে বিচারাধীন । কবে সেগুলি নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে ? দু’টি মৌলিক প্রশ্ন উঠছে: (1) কখন এই অপরাধের অপরাধীরা দোষী সাব্যস্ত হবে এবং উপযুক্ত শাস্তি পাবে ? (২) শিশু ও তাদের পরিবার বিচার কবে পাবে ? এক অর্থে, বেঁচে যাওয়াদের প্রতি কখনোই ন্যায়বিচার করা হবে না ৷ কারণ, সারাজীবন আতঙ্ক কাটবে না তাদের ৷ সুতরাং, যখন আমরা নারীর নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করি, তখন আমাদের অবশ্যই শিশুদের বিরুদ্ধে হওয়া অপরাধ নিয়ে আলোচনা করতে হবে ৷ আইপিসি অনুযায়ী অপরাধ (বর্তমানে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা বা বিএনএস অপরাধ) এবং পকসো আইনের অধীনে হওয়া অপরাধের দিকেও নজর দিতে হবে । এটা খুবই জরুরি ৷
কিছু সম্ভাব্য সমাধান
শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধের মাত্রা সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে হবে । অনেকে এই ধরনের অপরাধগুলিকে (যৌন নিপীড়নের ঘটনা ব্যতীত) এমন কিছু বলে ধরে নেয়, যা ঘটতেই এবং সেগুলিকে গুরুত্ব দেয় না ৷ কিন্তু সেগুলি স্বাভাবিক ঘটনা নয়, বরং জঘন্য অপরাধ ৷ শিশু হত্যা, মুক্তিপণের জন্য বা অন্য কোনও কারণে শিশু অপহরণ একটি অপরাধ, যা সহ্য করা উচিত নয় । ভ্রূণহত্যা, বিশেষ করে কন্যাভ্রূণ হত্যা জঘন্য অপরাধ৷ আমরা কি এমন খুনিদের বিচার করব ? একটি শিশুর যৌন নিপীড়ন, কখনও কখনও 3 বা 4 বছর বয়সী বদলাপুরের মতো, যৌন আনন্দের জন্য শিশুদের পাচারও জঘন্য অপরাধ । আমাদের এই সমস্যাগুলিকে স্বীকার করতে হবে এবং আলোচনা করতে হবে ও গুরুতর সামাজিক সমস্যা হিসাবে সেগুলিকে সামনে আনতে হবে । বক্তৃতা ও পরিকল্পনার সময় চলে গিয়েছে ।
বিচারব্যবস্থার পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন ৷ বিশেষ করে যখন শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধ হয় ৷ বিচারব্যবস্থার গতি খুবই কম ৷ বদলাপুরের প্রতিবাদকারীরা যে অভিযোগগুলি তুলেছিলেন, তার মধ্য়ে তেমন ছিল আদালতের বিলম্বের বিষয়টি ৷ বিশেষ আদালত ব্যর্থ হয়েছে, ফাস্ট ট্র্যাক আদালতও তাই । অপরাধের শিকার হাজার হাজার নারী ও শিশুকে ন্যায়বিচার দিতে হলে ন্যায়বিচার প্রদান ও মামলার নিষ্পত্তিতে সময়সীমা বেঁধে দিতে কেস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু করার উপায় খুঁজে বের করতে হবে । সময়মতো বিচার না দিতে পারলে নারীদের মা, বোন ও কন্যা বলা অর্থহীন হয়ে যাবে ।
একইভাবে, আমরা যদি তাদের ন্যায়বিচার দিতে না পারি এবং তাদের ভয় ও মানসিক আঘাত থেকে মুক্তি দিতে না পারি, তবে শিশুদের দেশের ভবিষ্যত বলে কথা বলা অর্থহীন । পরিশেষে, রাজনীতিকে আলোচনার বাইরে রাখা যাক । একটি জঘন্য অপরাধ একটি জঘন্য অপরাধ এবং এর রাজনীতিকরণ করলে, তা কম বা বেশি জঘন্য হয়ে যাবে না ।
যে শিশুটি এখনও বড় হয়নি, তার বিরুদ্ধে হওয়া অপরাধের পেছনে কেন রাজনীতি থাকবে ? যখন একটি জঘন্য অপরাধ হয়, তখন কেন রাজনীতিবিদরা সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করবেন ? তাঁরা যদি একে অপরের শুধু সমালোচনায় লিপ্ত না হয়ে শিশুদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে এবং অনুসন্ধানমূলক অনুশীলন ও ন্যায়বিচার সরবরাহের উন্নতিতে শক্তি ব্যয় করে ৷ তাহলে সেটা সমাজের জন্য ভালো হবে ।
(এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের৷ এখানে প্রকাশিত তথ্য ও মতামত ইটিভি ভারত-এর মতামতকে প্রতিফলিত করে না৷)