ক্রম-উন্নয়নশীল বিশ্ব পরিমণ্ডলে একটি আকর্ষণীয় মোড় নিয়েছে কাজানে সম্প্রতি শেষ হওয়া ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন ৷ সেই সম্মেলন ব্রিকসের দেশগুলির জন্য আরও দৃঢ় পরিচয় তৈরি করতে চাইছে । ব্রিকসের প্রাথমিক সদস্য পাঁচটি দেশ - ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চিন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ৷ তবে এই গোষ্ঠী তার সদস্য সংখ্যা আরও প্রসারিত করে সেখানে ইরান, মিশর, ইথিওপিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরশাহীকে অন্তর্ভুক্ত করেছে ৷
ক্রমবর্ধমান বহুমুখিতার পটভূমিতে এই শীর্ষ সম্মেলন পশ্চিমী নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক কাঠামোর বিকল্প হিসাবে ব্রিকস জোটের সম্ভাবনাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে । পাশাপাশি এই গোষ্ঠীর মধ্যে বেশ কয়েকটি অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ এবং প্রতিযোগী উচ্চাকাঙ্ক্ষাকেও চিহ্নিত করেছে সাম্প্রতিক সম্মেলন ৷ সম্ভবত সবচেয়ে আশ্চর্যজনকভাবে, এই শীর্ষ সম্মেলন ভারত-চিন এবং আর্মেনিয়া-আজারবাইজানের মতো যে দেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব রয়েছে, তাদের মধ্যস্থতার ভিত্তি প্রদান করেছে ৷ শীর্ষ সম্মেলনটি সফল হওয়া সত্ত্বেও একটি প্রশ্ন রেখে গিয়েছে ব্রিকস ৷ তা হল, ক্রমে অসম গোষ্ঠীতে পরিণত হওয়া ব্রিকস গোষ্ঠী কি গ্লোবাল সাউথের কণ্ঠস্বরের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে কার্যকরভাবে প্রদর্শন করতে সক্ষম হবে ?
ব্রিকসের প্রতি সতর্ক উচ্চাকাঙ্ক্ষার দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে ভারতের ৷ যদিও ভারত ব্রিকসকে এমন একটি প্ল্যাটফর্ম হিসাবে স্বীকার করে, যেটি অ-পশ্চিমী দেশগুলিকে শক্তিশালী করে, তবে এটি সম্পূর্ণরূপে পশ্চিম বিরোধী হওয়ার অবস্থানও নেয় না । এই সতর্ক অবস্থানটি থেকেই ভারতের অভিপ্রায় স্পষ্ট যে, তারা ব্রিকস ও সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও)-এর মতো অ-পশ্চিমী জোটের সঙ্গে যুক্ত থেকেও পশ্চিমের সঙ্গে বিশেষত জি7-এর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখছে ৷
ভারতের বিবৃতিটি উদীয়মান অর্থনীতির অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য একটি গোষ্ঠী হিসাবে ব্রিকস সম্পর্কে তার ধারণাকে স্পষ্ট করেছে, যেখানে বলা হয়েছে যে, পশ্চিমের বিরোধিতাকে এই গোষ্ঠীর প্রাথমিক লক্ষ্য করা উচিত নয় । এই বিবৃতির মধ্যে একটি বহুমুখী বিশ্ব ব্যবস্থার পক্ষে কৌশলগত ভারসাম্যের বার্তা রয়েছে ।
আমেরিকার চোখে ব্রিকস একটি জটিল সত্তা, যাকে তারা গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে । আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং বিশ্বব্যাংকের মতো পশ্চিমী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য তাৎক্ষণিক হুমকি না হলেও, ব্রিকসের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শক্তি যা বিশেষত চিন দ্বারা চালিত, তাদের প্রতি নজর রয়েছে আমেরিকার ৷ সাম্প্রতিক শীর্ষ সম্মেলনটি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক নির্ভরতা এবং ডি-ডলারাইজেশনের মতো বিষয়ে ব্রিকস সদস্যদের মধ্যে সম্ভাব্য সহযোগিতার উপর জোর দিয়েছে ।
ধীরে ধীরে বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের ধরণকে ডলার নির্ভরতা থেকে দূরে সরিয়ে ফেলার প্ল্যাটফর্ম হিসাবে ব্রিকস আবির্ভূত হবে কি না, তা সময় বলবে ৷ পশ্চিমীরা সৌদি আরব এবং আর্জেন্টিনার মতো দেশগুলিকে তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করবে, যারা ব্রিকসে যোগদান না করেও এর কাঠামোর প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে । যেহেতু ব্রিকস তার প্রচার প্রসারিত করছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত এই পরিবর্তনশীল জোটগুলির উপর নজর রাখবে এবং এই জোটের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের মূল্যায়ন করবে, যে জোট আদর্শগতভাবে বৈচিত্র্যময় হলেও বিশ্বের নিয়মগুলিকে পুনর্নির্মাণে একটি বৃহত্তর কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে পারে ৷
প্রতীক এবং সারবত্তা
ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন একটি উচ্চ-প্রোফাইল ইভেন্ট হিসাবে প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে 35টিরও বেশি দেশ উপস্থিত ছিল এবং যেখানে রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিবেরও উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি দেখা গিয়েছে । এই উপস্থিতি মস্কোর জন্য একটি প্রতীকী জয় ছিল ৷ ইউক্রেন সঙ্গে সংঘাতের পরে পশ্চিমী নিষেধাজ্ঞা এবং বিচ্ছিন্নতার মধ্যে পড়ে বিশ্ব মঞ্চে নিজেদের অবস্থানকে তুলে ধরার জন্য এই শীর্ষ সম্মেলনটিকেই কাজে লাগায় রাশিয়া । তারা অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রনেতাদের জন্য উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক উষ্ণতা প্রসারিত করেছে, উন্নয়নশীল দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার জন্য তার প্রস্তুতির ইঙ্গিত দিয়েছে । এই শীর্ষ সম্মেলনটি রাশিয়ার জন্য একটি সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে ৷ পশ্চিমী নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করতে সক্ষম একটি বহুমুখী জোট গঠনের লক্ষ্যে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার দিকে আবর্তিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে রাশিয়া ৷
ব্রিকসের মধ্যে চিনের অসামান্য প্রভাব এই গোষ্ঠীর জন্য একইসঙ্গে একটি শক্তি এবং বিতর্কের বিষয় । মন্থর অর্থনীতির মধ্যে দিয়ে চলা চিনের ব্রিকসে স্বার্থ নিহিত রয়েছে অর্থনৈতিক জোট তৈরি করায়, যা তার বাণিজ্য অংশীদারিত্বকে শক্তিশালী করবে এবং বিকল্প বৃদ্ধির পথ প্রদান করবে । ব্রিকসের একটি সাধারণ মুদ্রার জন্য চিনের সওয়ালে রাশিয়ার কণ্ঠই শোনা গিয়েছে ৷ ডলারের উপর নির্ভরতা কমানোর ইচ্ছার কথা শোনা গিয়েছে চিনের কথায় ৷
সাধারণ মুদ্রার প্রস্তাব দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও, ব্রিকস অর্থনীতি, রাজস্ব নীতি এবং আর্থিক একীকরণের স্তরে বিশাল বৈষম্যের কারণে এটি একটি দূরবর্তী লক্ষ্য হিসেবেই থেকে গিয়েছে । পাশাপাশি চিনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রভাব ব্রিকস সদস্যপদ সম্প্রসারণ নিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে । বহুমুখিতা হিসেবে সম্প্রসারণ ব্রিকসকে খুব বেশি দূর হয়তো নিয়ে যেতে পারবে না । একটি স্পষ্ট কাঠামো ছাড়াই ব্রিকস সদস্যপদ সম্প্রসারণের বিষয়ে সতর্কতা ব্যক্ত করেছে ভারতও, কারণ এই সম্প্রসারণ গোষ্ঠীর উদ্দেশ্যকে দুর্বল করে দিতে পারে এবং এর অভ্যন্তরীণ গতিশীলতাকে অসম করে তুলতে পারে ।
ব্রিকস কাঠামো বিকশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারত একটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ৷ তা হল পশ্চিমের সঙ্গে তার কৌশলগত সম্পর্ক ও ব্রিকস গোষ্ঠীর মধ্যে তার ভূমিকার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চ্যালেঞ্জ ৷ সাম্প্রতিক বছরগুলিতে প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি এবং জলবায়ু অংশীদারিত্বকে অন্তর্ভুক্ত করে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে গভীর হয়েছে । কোয়াড এবং অন্যান্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন উদ্যোগে ভারতের অংশগ্রহণ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চিনা আধিপত্য মোকাবিলার প্রতিশ্রুতিকেই প্রতিফলিত করে । তা সত্ত্বেও ব্রিকসের সঙ্গে ভারতের সম্পৃক্ততা তাকে কৌশলগত নমনীয়তা বজায় রাখার অনুমতি দেয়, এটি নিশ্চিত করে যে, পশ্চিমের সঙ্গে তার সম্পর্ককে আপোস না করে অ-পশ্চিমী দেশগুলির সঙ্গে সহযোগিতা করতে পারে ভারত ।
দীর্ঘমেয়াদে ভারতের ভারসাম্যমূলক কাজটি পরীক্ষার মুখে পড়বে, কারণ ব্রিকস বিশ্ব অর্থনৈতিক ইস্যুতে আরও দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করছে । পশ্চিমী অংশীদারদের বিচ্ছিন্ন করতে পারে এমন একটি অবস্থানে থেকে দীর্ঘমেয়াদি বৃদ্ধির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধকারী একটি এজেন্ডার দিকে ব্রিকসকে চালিত করার ক্ষেত্রে ভারতের নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে । কাজান শীর্ষ সম্মেলনে এই সরু সূতোর উপর চলতে হয়েছে ভারতকে, যেখানে দিল্লি নিজেকে পাশ্চাত্য-বিরোধী তকমা থেকে দূরে রেখে ব্রিকসের অ-পশ্চিমী অভিমুখিতার উপর জোর দিয়েছে ৷
কাজান শীর্ষ সম্মেলন ব্রিকসের জন্য একটি মাইলফলক হিসাবে কাজ করেছে কারণ এটি সংলাপের একটি ফোরামের থেকে কার্যকরী ও আরও গতিশীল প্ল্যাটফর্মে রূপান্তরিত হতে চেয়েছে । কীভাবে এই গোষ্ঠী তার অভ্যন্তরীণ শক্তির গতিশীলতাকে চালিত করবে, উদীয়মান অর্থনীতির চাহিদাগুলিকে মোকাবিলা করবে এবং এর সবচেয়ে শক্তিশালী সদস্যদের আধিপত্যের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবে, তার উপরই গোষ্ঠীর বিবর্তন নির্ভর করবে ৷
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা কড়া পর্যবেক্ষণে রেখেছে ব্রিকসকে, কারণ এটি এমন একটি বিকল্প কাঠামোর প্রস্তাব করেছে যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমী প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরতা কমাতে পারে । সাম্প্রতিক ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন এই প্রক্রিয়ার অন্তর্নিহিত উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং চ্যালেঞ্জগুলিকে তুলে ধরেছে ৷ ব্রিকস বিশ্ব প্রশাসনকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করতে পারে কি না, তা আগামী বছরগুলিতে নির্ধারিত হবে ৷ একটি প্রতীকী সমাবেশের বাইরে গিয়ে এই গোষ্ঠী বহুমেরুর বিশ্বকে রূপ দেওয়ার জন্য একটি চালিকা শক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে কি না, সেটাই দেখার ৷
(ডিসক্লেইমার: এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের । এখানে প্রকাশিত তথ্য এবং মতামত ইটিভি ভারতের মতামতকে প্রতিফলিত করে না)