লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি ফ্ল্য়াগশিপ প্রকল্প, যে প্রকল্পের মাধ্যমে মহিলাদের, বিশেষ করে সমাজের অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অংশ থেকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয় । সেই প্রকল্প নিয়ে একটি সমীক্ষা করে নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের প্রতীচী ট্রাস্ট ৷
গত বছর শীতের শুরুতে করা সেই সমীক্ষা অনুযায়ী, রাজ্যে এই প্রকল্প চালু হওয়ার পর থেকে, "85.55 শতাংশ মহিলারা ওই অর্থ খরচের জন্য নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেন বলে জানিয়েছেন ৷ স্বামীর সঙ্গে সহমতের ভিত্তিতে খরচ করেন 10.76 শতাংশ ৷ শুধুমাত্র স্বামীরা সিদ্ধান্ত নেন মাত্র 2.69 শতাংশ মহিলাদের ক্ষেত্রে ।"
গবেষণায় বলা হয়েছে, “এই রিপোর্ট প্রমাণ করে যে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার অসহায় মহিলাদের সামনে তাঁদের দৈনন্দিন জীবনে পরিবর্তন আনার জন্য যথেষ্ট প্রতিশ্রুতি দিয়েছে । এছাড়াও, এই প্রতিশ্রুতিগুলির মধ্যে কিছু তাদের নিজস্ব সংস্থা এবং পদক্ষেপ দ্বারা একটি 'ছোট' অঙ্কের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ । পরিমাণ কতটা 'ছোট' তা কেবলমাত্র তার পরিমাণের পরিপ্রেক্ষিতে নয়, এর গুণগত সম্ভাবনার ক্ষেত্রেও পরিমাপ করা যেতে পারে ।"
কিন্তু প্রশ্ন হল, এখানে কেন আমরা এখানে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার এবং মহিলাদের উপর এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করছি ? উত্তর বহুমুখী ।
তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রিমো ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় 2021 সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারের সময় এই প্রকল্পের প্রস্তাব করেছিলেন এবং এই প্রকল্পই তৃণমূল কংগ্রেসকে অ্যান্টি ইনকাম্বেন্সিকে ড্রিবল করে আরও বেশি আসনে জয়ী হওয়ার অন্যতম ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছিল ৷ সেই থেকে পার্টি লাইনের উর্ধ্বে উঠে মহিলাদের প্রতি মাসে 1000 ও 1200 টাকা করে সরাসরি ব্যাংকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে ৷
মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী লাডলি বেহনা যোজনা থেকে কর্ণাটকের গৃহলক্ষ্মী যোজনা, তেলেঙ্গানার মহালক্ষ্মী প্রকল্প থেকে ওড়িশার সুভদ্রা যোজনা পর্যন্ত, মহিলাদের অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতায়নের পাশাপাশি ভোটারদের উৎসাহিত করার জন্য রাজ্যস্তরের আর্থিক হস্তক্ষেপের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা এই প্রকল্পগুলি ৷ এতে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলগুলিই লাভবান হচ্ছে ৷ তালিকার সাম্প্রতিকতম সংযোজনগুলি হল মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী মাঝি লাডকি বহিন যোজনা এবং ঝাড়খণ্ডের মাইয়া সম্মান যোজনা ৷
এই দুই রাজ্যের মহিলা ভোটাররা, যাঁরা এই প্রকল্পগুলির সুবিধা পেয়েছেন, তাঁদের ভোটই নির্ণায়ক হয়ে উঠেছে ৷ নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক তথ্য ইঙ্গিত দেয় যে 2019 বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে আরও পাঁচ শতাংশ ভোটার মহারাষ্ট্রের বুথের বাইরে ভোট দেওয়ার লাইনে দাঁড়িয়েছেন ৷ আর সেখানে সংখ্যায় মহিলারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন । ঝাড়খণ্ডেও মহিলা ভোটাররা পুরুষদের পেছনে ফেলেছেন । ঝাড়খণ্ডের 81টি বিধানসভা আসনের মধ্যে 68টি আসনে বেশি মহিলা ভোটার রেকর্ড পরিমাণে ভোট দিয়েছেন ৷
ঝাড়খণ্ডের ছবিটা গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে ৷ গত 24 ধরে এই রাজ্যে কোনও ক্ষমতাসীন সরকার ফের ভোটে জেতেনি ৷ এবার সেই নজির ভেঙে গিয়েছে ৷ ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা (জেএমএম)-এর নেতৃত্বাধীন ‘ইন্ডিয়া’ ব্লকের চমকপ্রদ পারফরম্যান্সের জন্য অবশ্যই অনেকগুলি কারণ রয়েছে ৷ তবে মহিলা ভোটারদের উপর মাইয়া সম্মান যোজনার প্রভাব একটি অকাট্য সত্য, যা দেখায় যে হেমন্ত সোরেন সরকার সরাসরি টাকা পাঠানোর সুবিধা কোথায় পেয়েছে ৷ প্রতীচির সমীক্ষার ফলাফলই এখানে প্রমাণিত হয়েছে ৷ এখানে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য সম্মানিত হওয়ার অনুভূতিই কাজ করেছে ৷
হেমন্ত সোরেন ও তাঁর জেএমএমের উত্থানে দৃঢ়তা ছিল ৷ যা তাঁর ক্যারিশম্যাটিক পিতা এবং জেএমএমের প্রতিষ্ঠাতা শিবু সোরেনের মতো নয় ৷ 2009 সালে জেএমএমের মাত্র 18টি আসন ছিল, কিন্তু 2014 সালে সংখ্যাটি 19-এ গিয়ে দাঁড়ায় । যখন 2019 সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়, তখন জেএমএম 30টি আসনে জিতেছিল ৷ এবার ঝাড়খণ্ডের এই দলের আসন সংখ্যা আরও বেড়ে 34-এ পৌঁছেছে ।
জেএমএম-এর এই জয়ে স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচনী ক্ষতির শিকার হতে হয়েছে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির । জেএমএম 2019 ও 2024 সালে জয়ের ধারাবাহিকতা দেখানোয় গেরুয়া শিবির অনেকটা পিছিয়ে গেল ৷ প্রকৃতপক্ষে, কোলহান ও সাঁওতাল পরগনার উপজাতীয় অঞ্চলে বিজেপির পারফরম্যান্স হতাশাজনক ৷
কোলহান অঞ্চলের 14টি আসনে বিজেপি দলবদলু চম্পাই সোরেনের উপর প্রবলভাবে ভরসা করেছিল ৷ কিন্তু জেএমএমের তীর-ধনুক সেই আশা শেষ করে দিয়েছে ৷ সরাইকেলা থেকে চম্পাই জিতে গেলেও তাঁর ছেলে বাবুলাল ঘাটশিলা থেকে হেরে গিয়েছেন । ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন মুণ্ডার স্ত্রী মীরা হেরেছেন পটকা থেকে । শিবু সোরেনের বড় পুত্রবধূ সীতা সোরেন জামতারায় পরাজিত হয়েছেন । ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মধু কোড়ার স্ত্রী গীতা জগন্নাথপুর থেকে হেরেছেন । গেরুয়া শিবিরের একমাত্র সান্ত্বনা যে তারা কোলহানে তারা খাতা খুলেছে ৷ 2019 সালে এই অঞ্চলে বিজেপি শূন্য পেলেও এবার দু’টি আসনে জিতেছে ৷
সাঁওতাল পরগনার ফলাফল, যা কার্যত ঝাড়খণ্ডের ক্ষমতায় থাকার চাবিকাঠি, তাও জেএমএম-এর পক্ষে গিয়েছে ৷ সাঁওতাল পরগনার 18টি আসনের মধ্যে বিজেপি মাত্র একটিতে জিতেছে । জেএমএম একাই 11টি, কংগ্রেস চারটি এবং আরজেডি দু’টি আসন জিতেছে ।
কোলহান এবং সাঁওতাল পরগনার ফলাফলই বিজেপির ভাগ্য নির্ধারিত হয় ৷ এটা এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে বিজেপিকে তার শরিক আজসু ও জেডিইউ-কে নিয়ে উত্তর ছোটনাগপুর এবং পালামুর ঐতিহ্যবাহী ঘাঁটির মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে । কিন্তু, সেই আসনগুলি এনডিএ জোটের রাঁচির গভর্নর হাউসে যাওয়ার পথ তৈরি করত না ।
গত 3 নভেম্বর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান (উভয়কেই ঝাড়খণ্ড ভোটের জন্য দলের নেপথ্যের পরিকল্পনাকারী হিসাবে বিজেপি দ্বারা নির্বাচিত করা হয়েছিল), ঝাড়খণ্ডে বিজেপির সভাপতি ও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বাবুলাল মারান্ডিকে সঙ্গে নিয়ে রাঁচিতে বিজেপির নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশ করেন ৷ বিজেপির ভাষায় সংকল্প পত্র ৷ সেখানে 'অনুপ্রবেশ' এবং 'জনবিন্যাস পরিবর্তনের' উপরই জোর দেওয়া হয় ৷ সেই সময়ই স্পষ্ট হয়ে যায় যে জেএমএম তার নিজস্ব অনবদ্য স্টাইলে এর মোকাবিলায় সর্বাত্মক চেষ্টা করবে । এবং তারা এটা করেওছে ৷
হেমন্ত সোরেন জানতেন যে তাঁর নিজের উপজাতি, সাঁওতালদের সমর্থন নিজের দিকে টানতে পারলেও তাঁরা ভোটে জেতার জন্য একমাত্র ফ্যাক্টর হবেন না ৷ উপজাতীয় ভোটকে একত্রিত করতে ওরাওঁ, মুন্ডা এবং হো উপজাতি গোষ্ঠীর সমর্থনও তার প্রয়োজন ছিল । সুতরাং, হেমন্ত ‘আবুয়া রাজ’ (আমার রাজ্য) এবং ‘আবুয়া সরকার’ (আমার সরকার) এর স্লোগান তোলেন এবং সঙ্গে শিবু সোরেনের সংবেদনশীল মূল্যবোধ যোগ করেন ৷ পাশাপাশি, তাঁকে কারাবন্দি করে বিজেপি আদিবাসীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল, সেই অভিযোগ করেন ৷ আর এগুলিই তাঁর জয়ের পথ সুগম করে ৷
হেমন্তের নির্বাচনী সমাবেশ কোলহান ও সাঁওতাল পরগনার ভোটারদের কাছে ঘরের ছেলের বাতাবরণ তৈরি করে ৷ অন্যদিকে ‘বহিরাগত’ বিজেপির অনুপ্রবেশের স্লোগান মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়নি ৷ কারণ, ঝাড়খণ্ড এমন একটি রাজ্য, যে রাজ্যের পাশে কোনও আন্তর্জাতিক সীমানা নেই ৷ সেই কারণের গেরুয়া শিবির ভোটে বিপর্যস্ত হয় ৷
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা হিমন্ত এবং শিবরাজ ধরতে পারেননি, তা হল জয়রাম মাহাতো ও তাঁর ঝাড়খণ্ড লোকতান্ত্রিক ক্রান্তিকারী মোর্চা (জেএলকেএম) ফ্যাক্টর । গিরিডির ডুমরি আসনে জয়ী হওয়া ছাড়াও তিনি জেএমএম নেতা প্রয়াত জগরনাথ 'টাইগার' মাহাতোর বেবিকে পরাজিত করেছেন ৷ এই রাজনৈতিক সমীকরণ ছোটনাগপুর অঞ্চলের বেশ কয়েকটি বিধানসভা আসনের ফলাফলকে বিপর্যস্ত করেছে । জেএলকেএম কীভাবে রাঁচি, রামগড়, ধানবাদ, বোকারো ও গিরিডিতে কুর্মি-মাহাতো সম্প্রদায়ের ভোট কেটে এনডিএ-র ক্ষতি করেছে, তা বিজেপি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে৷ এটাই জেএমএম বা তার শরিকদের জয়ের পথ তৈরি করেছে ।
বারমোর আসনে জেএলকেএম প্রার্থী বিজেপিকে তৃতীয় স্থানে ঠেলে দিয়েছেন । সিল্লিতে এনডিএ শরিক আজসুর সুদেশ মাহতো জেএমএমের কাছে হেরেছেন । ভোটগণনার পর দেখা যায় জেএলকেএম প্রার্থী জেএমএমের বিজয়ী ব্যবধানের প্রায় দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন । বোকারো ও রামগড়েও একই ঘটনা ঘটেছে । গোমিয়া এবং চন্দনকিয়ারির মতো আসনগুলিতে এনডিএ প্রার্থীরা জেএমএমের কাছে হেরেছেন জেএলকেএম মনোনীত প্রার্থীরা দ্বিতীয় হওয়ার জন্য ৷
বৃহস্পতিবার যখন রাঁচিতে ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপাল সন্তোষ গাংওয়ার হেমন্ত সোরেনকে (প্রথম মুখ্যমন্ত্রী যিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারলেন) যখন শপথবাক্য পাঠ করান, তখন মঞ্চেই ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ এই জয়ের জন্য মমতাকে ও তাঁর লক্ষ্মীর ভাণ্ডারকে ধন্যবাদ দিতেই পারেন হেমন্ত ৷ কারণ, জেএমএমের মাইয়া সম্মান যোজনা এবং মহিলা ভোটারদের অপ্রতিরোধ্য সমর্থনই তাঁকে টানা দ্বিতীয়বারের জন্য ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী চেয়ারে বসার সুযোগ করে দিয়েছে ৷
বিজেপি একটি কঠিন শিক্ষা পেল ৷ দিল্লিতে ক্ষমতাসীন আপ ইতিমধ্যেই লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো মুখ্যমন্ত্রী মহিলা সম্মান যোজনা আনার প্রস্তাব করেছে ৷ সেখানে 18 বছরের বেশি বয়সী মহিলা ভোটার, যাঁরা কর দেন না বা অন্য সরকারি সুবিধা নেন না, তাঁদের জন্য মাসে 1000 টাকা করে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে ৷ যা অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও তাঁর দলের জন্য সোনার ডিম হতে পারে ৷