প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় মেয়াদ শুরু হয়েছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্য়মে । দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তাঁর সক্রিয় বিদেশনীতিতে ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে । শপথ গ্রহণের কয়েক দিনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী মোদি জি7 বৈঠকে অংশ নিতে ইতালির আপুলিয়ায় যান, যা তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর প্রথম আন্তর্জাতিক সফর ছিল । জি7-এ ভারতের অংশগ্রহণের উদ্দেশ্য ছিল উন্নত পশ্চিমী দেশগুলির সঙ্গে আলোচনা করা, একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে ভারতের উত্থানের বিষয়টি আরও একবার তুলে ধরা ও গ্লোবাল সাউথ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা ।
জি7 ও ভারত
ইতালিতে জি7 শীর্ষ সম্মেলনের একটি বিশেষ তাৎপর্য ছিল ৷ কারণ, এটা ছিল এই গোষ্ঠীর 50তম বার্ষিকী । জি7 এর পরিকল্পনা করা হয়েছিল ঠান্ডা যুদ্ধের সময় ৷ সেই সময়ের প্রধান উদার গণতান্ত্রিক অর্থনীতির দেশগুলিকে সদস্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এই গোষ্ঠীতে । এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান ও ব্রিটেন এই গোষ্ঠীর সদস্য ৷ ফলে জি7 এর গঠন একই রয়ে গিয়েছে । যদিও ভারত বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি অর্থনীতির মধ্যে একটি হলেও জি7 এর সদস্য নয় ৷ কারণ, ভারত এখনও একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে বিবেচিত হয় । সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, ভারতের অর্থনীতি চিত্তাকর্ষক বৃদ্ধি করেছে । এই দেশ বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র এবং বহুমুখী বিশ্ব ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় । ফলে, স্থায়ী সদস্য় না হওয়া সত্ত্বেও ভারত প্রায়শই একটি 'আউটরিচ কান্ট্রি' হিসাবে জি7-এ আমন্ত্রিত হয় ৷
এখনও পর্যন্ত, ভারত 11টি জি7 শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছে এবং প্রধানমন্ত্রী মোদি টানা প্রায় পাঁচটি বৈঠকে অংশ নিয়েছেন । অনেক জি7 দেশের সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে ৷ তাই দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক প্ল্যাটফর্মে এই দেশগুলির সঙ্গে দিল্লির অংশগ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ ।
জি7 শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে, প্রধানমন্ত্রী মোদি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজ এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাঁকরের মতো অনেক বিশ্ব-নেতার সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা করেছেন । ভারত ও ইতালির প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে ‘ক্লিন এনার্জি, ম্যানুফ্যাকচারিং, স্পেস এবং টেলিকম’-এর ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করার কথা জানিয়েছেন । তাঁরা মুম্বই-আমেদাবাদ হাই-স্পিড রেলওয়ে প্রকল্প নিয়েও আলোচনা করেছেন ।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনকের সঙ্গেও মতবিনিময় করেন মোদি । এটা উল্লেখ করা জরুরি যে ভারত ও ব্রিটেনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে ৷ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে সরে যাওয়ার পর ভারতের মতো উদীয়মান অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করা এখন ব্রিটেনের জন্য জরুরি ৷ উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রীই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি কোন পর্যায়ে রয়েছে, সেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন ৷ পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদির কথোপকথন অনেকেরই নজর কেড়েছে । প্রধানমন্ত্রী মোদি ও পোপ ফ্রান্সিস একে অপরকে আলিঙ্গন করেন এবং তাঁদের মধ্যে হালকা মেজাজে একটি সংক্ষিপ্ত কথোপকথনও হয় । ভারতের প্রধানমন্ত্রী পোপ ফ্রান্সিসকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ।
প্রধানমন্ত্রী জি7 প্ল্যাটফর্মকে ভারতীয় গণতন্ত্রের শক্তি প্রদর্শন করতে এবং দেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলি সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য অসাধারণ ব্যবস্থাগুলি প্রদর্শন করতে ব্যবহার করেছেন । ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো জি7 দেশগুলির মধ্যে কয়েকটিতে এই বছর নির্বাচন হবে ৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী তাঁদের প্রথম মেয়াদে রয়েছেন এবং তীব্র প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার সম্মুখীন হচ্ছেন । অন্যদিকে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী তৃতীয় মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন । শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মোদি উল্লেখ করেছেন যে ভারতীয় নির্বাচনের ফলাফল "সমগ্র গণতান্ত্রিক বিশ্বের বিজয়" নিশ্চিত করেছে ।
চিন এবং সংঘাত
জি7 নেতাদের নিজস্ব আলোচনায় ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডোরের প্রতি সমর্থনের বিষয়টি উঠে এসেছে ৷ পাশাপাশি বিশ্ব রাজনীতিতে চিনের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে ৷ চিন সম্পর্কে দুই ডজনেরও বেশি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে ৷ সেখানে দক্ষিণ চিন সাগর ও তাইওয়ানে চিনের আগ্রাসী কৌশলের সমালোচনা করা হয়েছে । যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে চিনের অর্থনৈতিক বা বাণিজ্য নীতির জন্য 'বাজারের বিকৃতি' তৈরি হচ্ছে ৷ এর ফলে ফলে জি7 দেশগুলির 'শিল্প এবং অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা ও নিরাপত্তা' ক্ষুণ্ন হচ্ছে । চিনের চ্যালেঞ্জের জবাবে, জি7 নেতারা উল্লেখ করেছেন যে তাঁরা তাঁদের নিজ নিজ শিল্প সক্ষমতা তৈরিতে বিনিয়োগ করবেন ৷ বৈচিত্র্যময় ও স্থিতিস্থাপক সরবরাহ ব্যবস্থাকে উন্নত করবেন এবং সমালোচনামূলক নির্ভরতা এবং দুর্বলতা হ্রাস করবেন ।
ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাশিয়ার প্রতি চিনের সমর্থন নিয়েও জি7 নেতারা তাঁদের হতাশা প্রকাশ করেছেন । ইউক্রেনের জন্য, জি7 নেতারা 50 বিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা কঠোর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন । শীর্ষ সম্মেলনে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী শান্তিপূর্ণ সমাধানের গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছিলেন ৷ আর তিনি যোগ করেছেন যে "ভারত শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য সবকিছু করতে থাকবে ।" 16-17 জুন রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত নিয়ে আলোচনার জন্য সুইজারল্যান্ডে আয়োজিত শান্তি সম্মেলনেও ভারতীয় কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করেছিলেন ।
পরবর্তী পদক্ষেপ
সাম্প্রতিক জি7 শীর্ষ সম্মেলনে উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে ইউরোপে অভিবাসন নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে । যাইহোক, এটি অপরিহার্য যে উন্নত দেশগুলি উন্নয়নশীল বিশ্বের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত চাহিদাগুলির প্রতি গভীর মনোযোগ দিচ্ছে । ভারত অন্যান্য আফ্রিকান দেশ-সহ গ্লোবাল সাউথের পক্ষে সমর্থন অব্যাহত রেখেছে । জি7 নেতাদের সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের সময় প্রধানমন্ত্রী মোদি শক্তিশালী অর্থনীতির প্রতি আহ্বান জানান, যাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো আধুনিক প্রযুক্তিগুলি ‘স্বচ্ছ, ন্যায্য, নিরাপদ, অ্যাক্সেসযোগ্য এবং দায়িত্বশীল’ হয় এবং ‘ব্যাপক ব্যবহারে প্রযুক্তির একচেটিয়া রূপান্তর’-এর গুরুত্বের উপর জোর দেন ।
গত কয়েক বছর ধরে, জি7-এর সদস্যপদ সম্প্রসারণ করা উচিত এমন একটি আলোচনা ছিল, যা ক্ষমতার পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় । প্রতিষ্ঠিত শক্তিগুলি ঠান্ডা যুদ্ধের পরপরই বিশ্বব্যাপী সংস্থাগুলির উপর তাদের দখল যেভাবে বজায় রেখেছিল, এখনও সেই ধারা তারা বজায় রাখতে চায় ।
যাই হোক, বিশ্বব্যাপী শক্তি সম্পর্কের একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে । বিশ্ব অর্থনীতি গত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছে । ভারতের মতো দেশগুলো প্রধান অর্থনীতি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে । চিনের বিপরীতে ভারতে প্রাণবন্ত গণতন্ত্র ও একটি উন্মুক্ত সমাজ ব্যবস্থা রয়েছে । তাই, ভারতকে এই গোষ্ঠীর আনুষ্ঠানিক সদস্যপদ থেকে দূরে রাখার খুব একটা মানে হয় না । অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে জি7 কে জি10-এ রূপান্তর করার প্রস্তাব ছিল ৷ প্রকৃতপক্ষে, প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আরও এক ধাপ এগিয়ে রাশিয়াকেও অন্তর্ভুক্ত করে জি11 করার প্রস্তাব করেছিলেন । জি7-এর সদস্যপদ সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তার উপর অবিরাম আলোচনা ভারতের মতো দেশগুলির দ্রুত বৃদ্ধির ফলাফলে হয়েছে । ইতালীয় প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি উল্লেখ করেছেন যে জি7 ‘দুর্গ নয়, যা বন্ধ হয়ে গিয়েছে...[কিন্তু].. মূল্যবোধের একটি প্রস্তাব যা আমরা বিশ্বের জন্য উন্মুক্ত করেছি ।’ ভারতকে শুধুমাত্র একটি আউটরিচ সদস্য নয়, এই গোষ্ঠীর পূর্ণ সদস্য করার জন্য জি7 এ আলোচনার সময় সম্ভবত এসে গিয়েছে ৷