কলকাতা, 23 এপ্রিল: 1992 সালের এই দিনেই বাঙালি হারিয়েছিল সত্যজিৎ নামের এক মহামূল্যবান রত্নকে । যে রত্ন বাঙালি আঁকড়ে ধরে বাঁচছে । যে রত্নের কল্যাণে বাঙালি চিনেছে 'অপু-দুর্গা' থেকে 'ফেলুদা'কে । আদি অনন্তকাল ধরে সেই সব চরিত্রকে মনের ভিতরে লালন করে চলেছে বাঙালি । তাঁর চলে যাওয়ার দিন ভেঙে পড়েন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় । সেই দিনটির কথা ইটিভি ভারতকে জানালেন সৌমিত্র কন্যা পৌলমী বসু ।
তিনি বলেন, "ছোটবেলা থেকে অনেকবারই দেখেছি ওই প্রবাদপ্রতিম মানুষটিকে । আমাদের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন তিনি । সেই সূত্রে ওঁনার বাড়িতে যাতায়াতও ছিল আমাদের । ওঁনার বহু ছবিতে বাবা অভিনয় করেছেন । সত্যজিৎ রায়ের চলে যাওয়ার দিন বাবাকে ভেঙে পড়তে দেখেছি । মনে হচ্ছিল যেন নিজের পরিবারের কাউকে হারিয়েছেন । শুধু বাবা কেন, আমার মাও ওঁনার মৃত্যুতে কম কষ্ট পাননি ।"
সত্যজিৎ রায়ের প্রয়াণ দিবসে আজ কেন সৌমিত্রর কথা ?
কারণ সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরেই চলচ্চিত্র জগতে অভিযান শুরু হয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের । তবে অপু হিসেবে সৌমিত্রকে তাঁর মোটেই পছন্দ ছিল না, তাই প্রথমবার সত্যজিৎ রায় রিজেক্ট করেছিলেন তাঁকে । অথচ এই সৌমিত্রই একসময় হয়ে ওঠেন সত্যজিতের পছন্দের অভিনেতা । আর সত্যজিৎ হয়ে ওঠেন সৌমিত্রর পথ প্রদর্শক, মেন্টর । অপু ট্রিলজি সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ছবি 'অপুর সংসার' (1959)-এর সঙ্গেই শুরু এই জুটির পথচলা । সত্যজিতের কেরিয়ারের পাঁচ নম্বর ছবি ছিল এটি । এরপর সত্যজিতের বাকি 29টি ছবির মধ্যে 13টিতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় । এ কী কম কথা? চলচ্চিত্র জগতে অভিন্ন হৃদয় হতে এর থেকে বেশি কী লাগে?
কিন্তু কেন সোমিত্রকে বাতিল করেন সত্যজিৎ ?
'অপরাজিত'র অপু হিসেবে সৌমিত্রর বয়স ও উচ্চতা দুটোই বেশি বলে মনে হওয়ায় তাঁকে তখন নেননি সত্যজিৎ রায় । তবে ট্রিলজির পরিকল্পনা সেদিনই সেরে রেখেছিলেন তিনি সৌমিত্রকে নিয়ে । এ কথা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় । বাংলা সিনেমার ফেলুদা একাধিক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, সত্যজিৎ রায় তাঁকে নিয়ে সর্বদাই পজেসিভ ছিলেন । সর্বোপরি মেন্টর ছিলেন তাঁর । 'অপুর সংসার'-এর পরের বছরেই মুক্তি পায় 'দেবী'। সেখানেও সত্যজিতের পরিচালনায় জুটিতে দেখা যায় সৌমিত্র এবং শর্মিলা ঠাকুরকে ।
রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে মুক্তি পেয়েছিল সত্যজিৎ পরিচালিত রবির তিনটি ছোটগল্প নিয়ে তৈরি 'তিনকন্যা' । তার মধ্যে 'সমাপ্তি'তে অভিনয় করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় । অন্যদিকে 'চারুলতা' (1964) সত্যজিৎ এবং সৌমিত্র জুটির মাইলফলক তৈরি করে দিয়েছিল । রবীন্দ্রনাথের 'নষ্টনীড়' অবলম্বনে তৈরি এই ছবিতে অমল চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন সৌমিত্র । ষাটের দশকে সত্যজিতের পরিচালনায় অভিযান (1962), কাপুরুষ (1965), অরণ্যের দিনরাত্রি (1969)-র মতো ছবিতে অভিনয় করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ।
সত্যজিৎ-সৌমিত্র জুটির কালজয়ী ছবি
1943-44 সালের দুর্ভিক্ষপীড়িত অবিভক্ত বাংলার প্রেক্ষাপটে সত্যজিৎ রায়ের তৈরি 'অশনি সংকেত'-এও সেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় । এই ছবির গঙ্গাচরণ চক্রবর্তীকে আজও ভুলতে পারেনি বাঙালি । 1974 সালে এই সোনার জুটিতে তৈরি 'ফেলুদা' সিরিজ । প্রথমে 'সোনার কেল্লা' । আর ঠিক পাঁচ বছর পর মুক্তি পায় ফেলুদা সিরিজের দ্বিতীয় ছবি 'জয় বাবা ফেলুনাথ' । সত্যজিৎ রায়ের একাধিক কালজয়ী ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করলেও ইচ্ছা সত্ত্বেও সুযোগ পাননি 'গুপী গাইন বাঘা বাইন'-এ । সত্যজিৎ রায় সাফ জানিয়ে দেন, এই ছবির দুই চরিত্রের সঙ্গে একটিতেও মানানসই নন সৌমিত্র । কিন্তু 'হীরক রাজার দেশে'(1980) করার সময়ে উদয়ণ পণ্ডিতের চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কেই নিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায় ।
চরিত্রের সঙ্গে অভিনেতার কিছু মাত্র মিল না-থাকলে তাঁকে সেই চরিত্রে নিতেন না তিনি । এতটাই খুঁতখুঁতে ছিলেন সত্যজিত । উদয়ণ পণ্ডিতের মেক আপও তিনিই করেছিলেন । সৌমিত্র-সত্যজিৎ জুটির আরও একটি কালজয়ী ছবি 'ঘরে-বাইরে' । এই ছবির চিত্রনাট্য সত্যজিৎ তৈরি করেছিলেন 'পথের পাঁচালি'রও আগে । এই ছবিতে সন্দীপ মুখুজ্জের ভূমিকায় ধরা দিয়েছিলেন সৌমিত্র । সত্যজিতের কেরিয়ারের শেষের দিক থেকে দ্বিতীয় ছবি 'শাখা-প্রশাখা' ও তৃতীয় ছবি 'গণশত্রু'তেও কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় । সত্যজিতের মোট 14টি ফিচার ফিল্ম আর দু’টো শর্ট ফিল্মে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র । এমনকী কাহিনিকার সত্যজিতের শেষ ছবি 'উত্তরণ'-এর কেন্দ্রবিন্দুতেও ছিলেন এই কিংবদন্তি । সত্যজিৎ রায় এই সময় অসুস্থ হওয়ায় ছবিটি শেষ করেন সত্যজিৎ পুত্র সন্দীপ রায় ।
সারা বিশ্বের নানা পরিচালকের কাজের দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্র পরিচালক । বলতে দ্বিধা নেই, বাংলার চলচ্চিত্রপ্রেমী দর্শক যুগ যুগ ধরে ভালোবেসে এসেছে এই সোনার জুটিকে । যে ভালোবাসায় কালিমা লেপার স্পর্ধা নেই কারও । তাই আজ তাঁর 33তম প্রয়াণ দিবসে আরও একবার স্মৃতির পাতা উলটে ঝালিয়ে নেওয়ার পালা পুরনো দিনগুলোকে ৷
আরও পড়ুন: