কলকাতা, 22 অগস্ট: ভালোবাসার শহর তিলোত্তমার আজ বড় অসুখ ৷ গানে গানে শিল্পী ঊষা উত্থুপও বলেছিলেন, 'আহা! তুমি সুন্দরী কত কলকাতা!...' তবে সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া আরজি কর কাণ্ড সেই সুন্দরে যেন কালো দাগ লাগিয়েছে ৷ দু'দিন বাদেই নাকি কলকাতার জন্মদিন ! যদিও তা নিয়ে রয়েছে বিস্তর বিতর্ক ৷ আবার এই শহর কে প্রতিষ্ঠা করেছেন তা নিয়ে চলেছে বিস্তর গবেষণা ৷ কলকাতার কি আদৌ কোনও জন্মদিন বলে নির্দিষ্ট তারিখ আছে ? কে এই শহরের প্রতিষ্ঠাতা? 24 অগস্টের প্রাক্কালে ইতিহাস গবেষক শুভদীপ রায় চৌধুরীর কাছ থেকে অনেক অজানা তথ্য জেনে নিল ইটিভি ভারত ৷
ইতিহাস গবেষকের কথায়, "কলকাতার মতো এই বিরাট মহানগরীর প্রতিষ্ঠাতা কেউ একজন হতে পারে কি? ঠিক এই প্রশ্নটাই আদালতে তুলেছিলেন সাবর্ণ রায় চৌধুরীর পরিবারের সদস্যরা। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন কলকাতার ন'জন বুদ্ধিজীবী। সত্যি কি, জব চার্নক 1690 সালের 24 অগস্টে সুতানুটি এসেছিলেন? সেই দিনেই কলকাতার জন্ম হয়েছে? এ প্রশ্নও কোর্টে তোলা হয়। তবে এই ভ্রান্ত ইতিহাসকে মেনে নেননি বিচারপতিরা, তাই তাঁদের স্পষ্ট ঘোষণা- কলকাতার কোনও জনক নেই।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা জব চার্নকের যে ছবিটি সাধারণত দেখতে পাই, ঐতিহাসিকদের একাংশের মতে সেটি নাকি চার্নকের ছবিই নয়! এমনকী, চার্নক তৃতীয়বার যখন সুতানুটিতে আসেন তখন তিনি এক গুপ্তরোগে আক্রান্ত ছিলেন। গোবিন্দুপুর কিংবা কলকাতা তো দূর, বাড়ির বাইরে অবধি বেরোতেন না তিনি। তাহলে তিনি কীভাবে কলকাতার জনক হলেন? যদিও চার্নককে জনক তৈরির পেছনে ছিলেন কয়েকজন পেইড হিস্টোরিয়ান। যাঁরা বরাবরই বিদেশী সভ্যতাকে দেশীয় ভাবধারায় প্রবেশ করাতে একেবারে বদ্ধপরিকর ছিলেন। কিন্তু সত্য ইতিহাস কখনও চাপা থাকে না, কলকাতার আদি ইতিহাস সেই প্রকাশিত হয়েই গেল।"
উল্লেখ্য, কলকাতা হাইকোর্টে দায়ের হওয়া জনস্বার্থ মামলার রায়ে (16 মে, 2003 সাল), বিচারপতি অশোক কুমার মাথুর ও বিচারপতি জয়ন্ত বিশ্বাসের ডিভিশন বেঞ্চ রায় দেয় যে, জব চার্নক কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা নন এবং কলকাতার কোনও জন্মদিনও নেই। সাহিত্যগত, প্রত্নতাত্ত্বিক কিংবা মৌখিক ইতিহাসের উপাদানের ভিত্তিতে বলা যায় যে, তিলোত্তমা দুই হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন। 1495 খ্রিষ্টাব্দে বিপ্রদাস পিপলাইয়ের 'মনসাবিজয়' কাব্যে ‘কলিকাতা’র উল্লেখ রয়েছে। আবার 1594 থেকে 1606 খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রচিত মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর 'চণ্ডীমঙ্গল' কাব্যেও কলকাতার নাম উল্লেখ রয়েছে।
পাশাপাশি , 1676-77 সালে কৃষ্ণরাম দাস রচিত কালিকামঙ্গল কাব্যে স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় কলকাতার – ‘অতি পুণ্যময় ধাম/সরকার সপ্তগ্রাম/কলিকাতা পরগণা তায়।’ তাছাড়া বহু ঐতিহাসিক এই যুক্তি দিয়েছেন যে, জব চার্নক আসার বহু আগে থেকেই কলকাতার অস্তিত্ব ছিল। তাই চার্নক এলেন আর কলকাতার প্রতিষ্ঠা হল, এমন ভাবনা নিছকই ছেলেমানুষি ছাড়া কিছুই নয়। ঐতিহাসিক রাধারমণ মিত্র দেখিয়েছেন যে, ইংরাজদের নথিপত্রেও ‘ক্যালকাটা’ নামটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় 1688 সালের 22 জুন চার্লস আয়ার ও রজার ব্র্যাডিলের লেখা এক চিঠিতে ।
তাই 1690-এর 24 অগস্টকে কখনও শহরের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসাবে চিহ্নিত করা যায় না। সর্বোপরি, কোনও শহরের প্রতিষ্ঠাতা বলে একজনকে দাগিয়ে দেওয়া যায় না বলে মনে করেন ঐতিহাসিকরা। এই কলকাতা তৈরি হয়েছে বাঙালির কৃষ্টিতে, বাঙালির কল্পনায়, কোনও বিদেশীর জাদুদণ্ডে নয়, এমনই মনে করেন ইতিহাস গবেষক শুভদীপ রায় চৌধুরী।
উল্লেখ্য, এই কলকাতার জন্মদিন এবং প্রতিষ্ঠাতার পাশাপাশি পেইড হিস্টোরিয়ানের একাংশ আরও একটি মিথ তৈরি করেন, সেটি হল মাত্র 1300 টাকায় কলিকাতা, গোবিন্দপুর এবং সুতানুটি সাবর্ণ চৌধুরীরা বিক্রি করে দিয়েছিলেন চার্নকের কাছে! পরবর্তিতে কলকাতার জায়গিরদার পরিবার সাবর্ণ রায় চৌধুরীরা 2001 সালে দায়ের করা একটি মামলার (WP No. 1484 of 2001) সুবাদে কলকাতা হাইকোর্ট তৎকালীন প্রধান-বিচারপতি অশোককুমার মাথুর ও বিচারপতি জয়ন্তকুমার বিশ্বাসের ডিভিশন বেঞ্চ ইতিহাসবিদ নিমাইসাধন বসু, বরুণ দে, প্রদীপ সিনহা, অরুণ দাশগুপ্ত এবং সুশীল চৌধুরীকে নিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়ে দেন।
মূলত, কলকাতা শহরের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা কে, তা খুঁজে বের করবার জন্যই ওই কমিটি তৈরি হয়। আর কমিটির পেশ করা রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে ২০০৩-এর ১৬ মে বিচারপতিরা রায় দেন যে, "কলকাতার কোনও নির্দিষ্ট জন্মদিন নেই, আর কলকাতার কোনও প্রতিষ্ঠাতাও নেই।"