কলকাতা, 2 ফেব্রুয়ারি: রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ বা আরসিইপি, অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের এই বহুদেশীয় জোট থেকে 2019 সালে নিজেদের সরিয়ে নেয় ভারত ৷ বছর চারেক কেটে যাওয়ার পর দেখা যাচ্ছে যে সেই সময় ভারত সরকারের নেওয়া এই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল ৷ কারণ, যে দেশগুলি এই জোটে রয়েছে, সেখানে ক্রমশ প্রভাব বাড়ছে চিনা বাণিজ্যের ৷ ভারতেও এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে এখানকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্র মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হত ৷ ভারত সরে আসায়, সেই পরিস্থিতি অন্তত এড়ানো গিয়েছে ৷
2011 সালে আরসিইপি-র খসড়া তৈরি হয় ৷ সেই সময় থেকেই ভারত মুক্ত বাণিজ্যের জন্য তৈরি এই বহুদেশীয় জোটের অংশীদার ছিল ৷ 2019 সালের 4 নভেম্বর ব্যাংককে এই জোটের তৃতীয় শীর্ষ সম্মেলন হয় ৷ সেখানেই ভারত জানিয়ে দেয় যে তারা এই জোট থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ৷
ভারত না থাকলেও এখানে 15টি সদস্য দেশ রয়েছে ৷ চিন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশের সঙ্গে রয়েছে আশিয়ান গোষ্ঠীর 10টি দেশ ও ওশিয়ানিয়া অঞ্চলের দু’টি দেশ ৷ আশিয়ান গোষ্ঠীর দেশগুলি হল - ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিলিপিন্স, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, ব্রুনাই দারুসসালাম, ভিয়েতনাম ও মায়ানমার৷ আর ওশিয়ানিয়া অঞ্চলের দু’টি দেশ হল - অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড ৷ এই গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলি বিশ্বের জিডিপি ও জনসংখ্যার 30 শতাংশের অংশীদারিত্ব করে ৷
শুল্ক পার্থক্যের সংশোধন, সর্বাধিক পছন্দের দেশ (এমএফএন) নিয়মে কাস্টমস ডিউটি পরিবর্তনের বেস হারে বদল-সহ পাঁচটি কারণ উল্লেখ করে এই গোষ্ঠী থেকে সরে আসে ভারত ৷ যদিও ভারতের সরে আসার সবচেয়ে বড় কারণ ছিল চিন ৷ মুক্ত বাণিজ্য না থাকা সত্ত্বেও চিনের জন্য যথেষ্ট বাণিজ্য ঘাটতি হয় ভারতের ৷ ওই গোষ্ঠীতে থাকলে এই পরিস্থিতি আরও বৃদ্ধি পেত বলেই আশঙ্কা করা হয় ৷ আর আমদানির চাহিদার কারণে শিল্পায়নও ধাক্কা খেত আরসিইপি থেকে সরে না এলে ৷ তখন অর্থনীতিতে শুধু কৃষি ও পরিষেবা ক্ষেত্রের আধিপত্য থাকত ৷ ভারতের আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না, তা চিনের দিকে তাকালেই বোঝা যায় ৷ কারণ, চিন তাদের রফতানির বেশিরভাগটাই আরসিইপি গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলিতে করার চেষ্টা করে ৷ সেক্ষেত্রে চিন ভারতের বাজারে আরও আধিপত্য বিস্তার করত ৷
আরসিইপি কার্যকর হয়েছে 2022 সালের 1 জানুয়ারি ৷ তার পর কেটে গিয়েছে দু’বছর ৷ এই দু’বছরে চিন ও অন্য সদস্য দেশগুলির বাণিজ্যিক ভারসাম্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে ৷ চিনের বৃহত্তম রফতানি বাজার এখন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ নয়, বরং সেই জায়গা নিয়েছে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া । ওই দেশগুলিতে চিনের রফতানির পরিমাণ 600 বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ এর জেরে আরসিইপি এখন বিশ্বের বৃহত্তম মুক্ত বাণিজ্যের ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷ তাছাড়া চিনে তৈরি হওয়া বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশগুলিতে পাঠানোর পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ সেখানে এখন চিনা পণ্য়ের সংযুক্তিকরণ করে বাকি বিশ্বে রফতানি করা হয় ৷ এই দেশগুলির সঙ্গে চিনের বাণিজ্যের পরিমাণ 1.77 ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে গিয়ে পৌঁছেছে ৷
আরসিইপি সদস্য দেশগুলিতে চিনের রফতানি 6.41 ট্রিলিয়ন ইউয়ানে পৌঁছেছে, যা 2021 সালের তুলনায় রফতানি শেয়ারের পরিপ্রেক্ষিতে 1.1 শতাংশ পয়েন্ট বেড়ে 27 শতাংশ হয়েছে ৷ লিথিয়াম ব্যাটারি, অটোমোবাইলের যন্ত্রাংশ ও ফ্ল্যাট প্যানেল ডিসপ্লে মডিউলগুলি উল্লেখযোগ্য রফতানি বৃদ্ধি বজায় রেখেছে ৷
এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে যে চিনা বাণিজ্যের ভারসাম্যের পূর্বাভাস বিশ্লেষণ করে ভারতের আরসিইপি থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল ৷ এটা না হলে ভারতের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন শিল্পে প্রভাব পড়ত ৷ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্রেও ক্ষতিকর প্রভাব পড়ত ৷ মেক ইন ইন্ডিয়াতেও এর প্রভাব ভালো হত না ৷ তাছাড়া চিনের সঙ্গে এখন প্রায়ই সীমান্ত সংঘাত লাগছে ৷ গত কয়েক বছরে এমন পরিস্থিতিতে চিনের অনেক কিছুর উপর ভারত নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে ৷ আরসিইপি-তে থাকলে এটা সম্ভব হত না সবক্ষেত্রে ৷
অনেকে মনে করেন মুক্ত বাণিজ্য দেশের উৎপাদনশীলতায় ভালো প্রভাব ফেলে ৷ কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তা নাও হতে পারে ৷ বাস্তব পরিস্থিতি এত সহজ নয় ৷ কারণ, এই সব ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির অনেক ফ্যাক্টর কাজ করে ৷ এর বদলে পরিকাঠামোর উন্নয়ন, লজিস্টিকস ও পরিবহণ ব্যবস্থা উন্নত করা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো করা, শ্রমক্ষেত্রে সংস্কার ও আইন তৈরি, প্রযুক্তি ও পণ্য উদ্ভাবনের উপর নজর দেওয়া এবং বিচক্ষণ সরকারী নীতি ভারতীয় রফতানিকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করতে পারে ৷ আর ভারতীয় সংস্থাগুলিকে বিশ্ব বাজারে আরও সমৃদ্ধ করতে পারে ৷
আরও পড়ুন: