ETV Bharat / bharat

কেরিয়ার হিসেবে কেন মহাকাশ গবেষণাকে বেছে নেবেন তরুণরা? একান্ত সাক্ষাৎকারে কারণ জানালেন দেশের 'মুন ম্যান'

Exclusive Interview of Moon Man of India: ভারতে মহাকাশ গবেষণার কয়েকটি ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগে ছাড়পত্র দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার ৷ এরপর মহাকাশ গবেষণার ভবিষ্যৎ কী ? এই নিয়ে ইটিভি ভারত-এর প্রতিনিধি শঙ্করনারায়ণন সুদলাইকে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন ভারতের 'মুন ম্যান' তথা ইসরোর প্রাক্তন ডিরেক্টর ডঃ মাইলস্বামী আন্নাদুরাই ৷

ETV Bharat
ভারতের মহাকাশবিজ্ঞানে বিদেশি বিনিয়োগ
author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : Feb 26, 2024, 9:01 AM IST

চেন্নাই, 25 ফেব্রুয়ারি: মহাকাশকে ঘিরে যে কখনও ব্যবসা-বাণিজ্য হতে পারে, এই শতকের আগে এরকমটা বোধহয় কেউ ভাবেনি ৷ গ্রহ-নক্ষত্র, উপগ্রহ- এসব শুধু বৈজ্ঞানিক বিষয় ছিল ৷ আর তার একচ্ছত্র অধিপতি ছিল ইসরো আর নাসা ৷ আরেক দিকে দূরদর্শী ব্যক্তিরা গ্রহ-তারকা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন ৷ এভাবেই গ্রহ-নক্ষত্রকে চিনত সাধারণ মানুষ ৷

তবে সাম্প্রতিক অতীতে মহাকাশ বিজ্ঞানের অনেক অগ্রগতি হয়েছে ৷ এই ক্ষেত্রে এখন বেসরকারি সংস্থাগুলিও ঢুকে পড়েছে ৷ আর তার ফলে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে সারা বিশ্বে মহাকাশ বিজ্ঞানের গবেষণায় ৷ তেমনই একটি পরিবর্তন হয়েছে ভারতেও ৷ মহাকাশ বিজ্ঞানের গবেষণার কয়েকটি সেক্টরে 100 শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বা ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট বা এফডিআই-তে ছাড়পত্র দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার ৷ ভারতের মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রকে উন্মুক্ত করা এবং সম্ভাবনাময় বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করাই এই পদক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য ৷

ভারতে মহাকাশ গবেষণা নিয়ে ইটিভি ভারতের প্রতিনিধিকে একান্ত সাক্ষাতকারে অনেক দিক তুলে ধরলেন ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন বা ইসরোর প্রাক্তন ডিরেক্টর ডঃ মাইলস্বামী আন্নাদুরাই ৷ তিনি দেশের 'মুন ম্যান' বলেও পরিচিত ৷ মহাকাশ, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাবের কথা বলেছেন তিনি ৷ এছাড়া তরুণ প্রজন্ম কীভাবে এখানে দুর্দান্ত কেরিয়ার গড়ে তুলতে পারে, সেই সুযোগগুলির কথাও জানিয়েছেন ডঃ মাইলস্বামী আন্নাদুরাই ৷ রইল সেই সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ ৷

ইটিভি ভারত: মহাকাশ গবেষণার সেক্টরে কেন্দ্রীয় সরকার 100 শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগে ছাড়পত্র দিয়েছে ৷ এতে এই শিল্পক্ষেত্রে কী সদর্থক পরিবর্তন হতে পারে, আপনি কী মনে করছেন ?

ডঃ আন্নাদুরাই: এর উত্তরে সাম্প্রতিক কিছু উদাহরণের কথা তুলে ধরি ৷ বিশ্বে কোভিডের সময়ে যদি কোনও একটি সেক্টর উন্নতি করে থাকে, তা হল এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রি ৷ গত 65 বছরে যত উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করা হয়েছে, তার মধ্যে 40 শতাংশেরও বেশি হয়েছে প্যানডেমিকের পরবর্তী 3 বছরে ৷ প্রধানত, এলন মাস্কের স্পেস এক্স এবং ওয়ান ওয়েবের মতো বেসরকারি স্পেস কোম্পানিগুলি 90 শতাংশেরও বেশি উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করেছে ৷ আর ভারতের কথা উঠলে, সেখানে প্রধানত কেন্দ্রীয় সরকার এই ক্ষেত্রটি পরিচালনা করলেও অনেক উন্নত গবেষণা হচ্ছে মহাকাশ নিয়ে ৷ আমরা চাঁদে, মঙ্গলে মহাকাশযান পাঠাচ্ছি ৷ আমরা নিজেরাই আমাদের প্রয়োজনীয় অনেক উপগ্রহ তৈরি করেছি ৷ আমার বিশ্বাস, বিদেশি বিনিয়োগ একে বাণিজ্যিক দিক দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে ৷

একসময় বিমান শুধুমাত্র বায়ুসেনার জন্যই ছিল ৷ পরে তা আমজনতার পরিবহণের মাধ্যম হয়ে উঠেছে ৷ ঠিক এমনটাই হতে চলেছে স্পেস সেক্টরে ৷ অন্য দেশগুলি এই বিষয়ে এগিয়ে রয়েছে ৷ তবে ভারতও খুব একটা পিছিয়ে নেই ৷ ভারতে স্পেস ইন্ডাস্ট্রি শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করে ৷ তবে সেখানেও পরিবর্তন হচ্ছে, যাতে বেসরকারি সেক্টরগুলিও মহাকাশ গবেষণায় অংশ নিতে পারে ৷

বিদেশি বিনিয়োগের প্রসঙ্গ উঠলে আরও ভালো পারফর্ম্যান্সের সুযোগের কথা উঠবে ৷ সেখানে ভারতীয়রাও প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে অংশ নিতে পারে ৷ আমার মনে হয়, এতে ব্যবসায়িক দিক দিয়ে উন্নতি হবে ৷ তামিলনাড়ুর কুলাসেকরন পট্টিনমে একটি লঞ্চ প্যাড তৈরি করা হবে ৷ আমি আত্মবিশ্বাসী, বাণিজ্যিকভাবে বিনিয়োগের দিকটি খুলে গেলে তা মহাকাশ গবেষণায় ভারতীয়দের আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে ৷

ইটিভি ভারত: মহাকাশকে জানার বিষয়টা শুধুমাত্র বিজ্ঞানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় ৷ দেশের সামরিক বাহিনীর স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ রয়েছে ৷ তার সঙ্গে জড়িয়ে জাতীয় সুরক্ষা ৷ এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ হলে তা সুবিধেজনক হবে কি ? আপনি কী মনে করেন ?

ডঃ আন্নাদুরাই: এটা একটা চ্যালেঞ্জিং বিষয় ৷ ব্যাপারটা মোবাইল ফোনের মতো ৷ একদিকে নিরাপত্তার জন্যও কার্যকরী আবার ব্যক্তিগত ব্যবহারেও দরকারি ৷ এর মধ্যে ড্রোনের বিষয়টিও রয়েছে ৷ সরকারের এই সেক্টরটি পরিচালনা করার অবশ্যই প্রয়োজন আছে ৷ যেখানে উৎপাদন অনেক বেশি, নতুন স্ট্র্যাটেজি এবং প্রযুক্তি দরকার ৷ আমার মতে, সেল ফোন আর আকাশপথে ভ্রমণকে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে, সেরকম ভাবেই এই সেক্টরকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ৷ বর্তমান যুগে শুধুমাত্র সরকারের পক্ষেই সব বিনিয়োগ এবং উন্নয়ন একাহাতে করা সম্ভব নয় ৷ বেসরকারি অংশীদারও প্রয়োজন ৷

ইটিভি: ধরে নেওয়া যাক, ভারতের স্পেস সেক্টরে বিশাল বিনিয়োগ হবে ৷ আর তার ফলে দারুণ কেরিয়ার গড়ার সুযোগও পাওয়া যাবে ৷ তাহলে ছাত্র-ছাত্রীরা এই সেক্টরে কীভাবে এগোবে ? কী নিয়ে লেখাপড়া করলে এই সেক্টরে পড়ার সুযোগ পাবে ?

ডঃ আন্নাদুরাই: মেকানিক্যাল, ইলেক্ট্রিক্যাল, ইলেক্ট্রনিক্স, কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ার ক্ষেত্রে বিটেক করার সুযোগ থাকে ৷ এরপর স্নাতকোত্তর স্তরে এরোনটিক্যাল, এরোস্পেস নিয়ে পড়াশোনা করা যেতে পারে ৷ যদি কেউ তিরুবনন্তপুরমে অবস্থিত ইসরোর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ স্পেস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে পড়াশোনা করার সুযোগ পায়, তাহলে তাঁর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবেই ৷ এই কোর্স শেষ করে সরকারি বা বেসরকারি স্পেস সেক্টরে চাকরি পেতে পারে ৷ আর পরীক্ষার ফলাফল খুব ভালো হলে নাসা অ্যাকাডেমিতে পড়াশোনার সুযোগও পেয়ে যাবেন ৷

ইটিভি: গঙ্গায়ন প্রজেক্টে মানুষকে মহাকাশে পাঠানোর কথা রয়েছে ৷ এই প্রজেক্ট এখন কী অবস্থায় রয়েছে ?

ডঃ আন্নাদুরাই: গঙ্গায়ন প্রজেক্টের শেষ দফায় একটি ক্রায়োজেনিক মেশিন ব্যবহার করতে হবে ৷ এমনকী এই চন্দ্রায়ন-3 প্রজেক্টেও পরীক্ষাগুলি হয়েছিল মানুষকে ধরেই ৷ এই ধরনের মিশনগুলিতে বাইরের তাপমাত্রা, এবং জ্বালানির মতো ছোটখাটো বিষয়ের পরিবর্তন যেন কোনও বাধা হয়ে না-দাঁড়ায় ৷ লঞ্চ ভেহিকল তৈরি শেষের পথে ৷ আমরা মানুষের যাওয়ার বিষয়ে খুবই সতর্ক রয়েছি ৷

ক্রায়োজেনিকের উপর 30 ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে ৷ শেষ ধাপে ক্রোয়াজেনিক মেশিন মানুষ বহন করতে পারবে কি না, সেই পরীক্ষা হয়েছে ৷ তাতে উতরে গিয়েছে ৷ এবার আলাদা আলাদাভাবে পরীক্ষাগুলিকে একসঙ্গে করলে কী ফল পাওয়া যায়, তা দেখতে হবে ৷ সেটাই চূড়ান্ত হবে ৷ এই বছরের শেষে মানুষবিহীন মহাকাশযানে 'বায়োমমিত্র' নামের একটি হিউম্যানয়েড রোবোট পাঠানো হবে ৷ সেই পরীক্ষার ফলাফলের উপর নির্ভর করে মানুষ পাঠানোর প্রচেষ্টা চালানো হবে ৷ মহাকাশযানটির উপর বায়ু চাপ, তাপমাত্রা ইত্যাদির কী প্রভাব পড়ল ৷ এই পরীক্ষার উত্তরে জানা যাবে, মানুষ যখন মহাকাশযানে ভ্রমণ করবে, তখন কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে ৷

ইটিভি: স্পেস ইন্ডাস্ট্রিতে আর্টিফিসিয়ান ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বিষয়ে আপনার মত কী ?

ডঃ আন্নাদুরাই: কম্পিউটার এবং সেল ফোনের মতো প্রযুক্তিগুলি প্রথমে স্পেস ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছে ৷ পরে সেগুলি বাণিজ্যিক হয় ৷ মঙ্গলায়নের উৎক্ষেপণের সময় থেকে ইসরো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ব্যবহার করে আসছে ৷ মঙ্গলায়ন কালাম মঙ্গলের দিকে এগিয়ে যায়, সেখান থেকে পাঠানো কোনও বার্তা আমাদের কাছে আসতে 20 মিনিট সময় নেবে ৷ আমরাও যদি কোনও বার্তা পাঠাই, সেটাও 20 মিনিট পরে সেখানে গিয়ে পৌঁছবে ৷ তাই মাঝে 40 মিনিটের একটা ব্যবধান থেকে যাচ্ছে ৷ এই সময়ের মধ্যে মঙ্গলায়নের পক্ষে পৃথিবী থেকে পাঠানো কোনও নির্দেশ ফলো করা কোনওভাবে সম্ভব নয় ৷ মঙ্গলের কক্ষপথে পৌঁছলে সেই সময় মঙ্গলায়ন নিজের অবস্থান স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে বুঝতে পারবে ৷ তখন নিজের গতি কমিয়ে মঙ্গলের কক্ষপথে নিজেকে স্থাপন করতে পারবে ৷ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই এই কাজটা করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে ৷

একইভাবে, চন্দ্রায়ন প্রজেক্টের বিক্রম ল্যান্ডার এবং প্রজ্ঞান রোভারকে অপারেট করার ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করা হয়েছে ৷ এখনও পর্যন্ত মহাকাশে ছোটখাটো যন্ত্রগুলির কাজকর্ম ঠিক হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করার কাজটি করছে মানুষ ৷ তবে এর জন্য আমরা এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ব্যবহার করছি ৷ ক্রায়োজেনিকের মতো যন্ত্রগুলিকে পরীক্ষা করে যে ডেটা পাওয়া যাচ্ছে, তার উপর নির্ভর করেই এআই সিদ্ধান্ত নেবে ৷ কম্পিউটারেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ৷ আর তার সাহায্যে কক্ষপথে ঘুরতে থাকা কৃত্রিম উপগ্রহগুলির উপর নজরদারি চালানো হয় ৷ এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রি আজকের প্রযুক্তিকে পথ দেখাচ্ছে, যা আগামিকাল দুনিয়ার প্রয়োজন ৷

ইটিভি: বিশ্ব উষ্ণায়ন এখন বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি সমস্যা ৷ আদিত্য এল-1 মহাকাশ যান সূর্যের সম্বন্ধে যে সব গবেষণা করবে, তাতে কি জলবায়ু পরিবর্তনের কোনও সমাধান সম্ভব ?

ডঃ আন্নাদুরাই: আদিত্য এল-1 মহাকাশের পরিবর্তনগুলি নিয়ে গবেষণা করবে, পৃথিবীর নয় ৷ মহাকাশে ঘুরে বেড়ানো কৃত্রিম উপগ্রহগুলির উপর বিশ্ব উষ্ণায়নে অনেক বেশি ৷ সম্প্রতি আইএনএসএটি-3ডিএস উৎক্ষেপণ করা হয়েছে, যা পৃথিবীর তাপমাত্রা পরীক্ষা করবে ৷ আর কয়েক সপ্তাহ পরেই এনআইএসআর (নাসা ইসরো সিন্থেটিক অ্যাপারচার রেডার) স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হবে ৷ এটি তৈরিতে 1.5 বিলিয়ন বা 150 কোটি মার্কিন ডলার খরচ হয়েছে ৷ ইসরো এবং নাসা- দু'টি মহাকাশ গবেষণা সংস্থা যৌথভাবে এই স্য়াটেলাইট তৈরি করেছে ৷ প্রতি 14 দিনে পৃথিবীর আবহাওয়ার পর্যালোচনা করা হচ্ছে ৷ আমার মনে হয়, এই ফল বিশ্বের অন্য দেশগুলিকে বুঝতে পারবে, বিশ্ব উষ্ণায়ন কী সাংঘাতিক হতে চলেছে ৷ শুধুমাত্র হিমালয় বা আন্টার্কটিকা নয়, জঙ্গলের তাপমাত্রাও রেকর্ড করে তার পর্যালোচনা করা হবে ৷

আরও পড়ুন:

  1. সফল উৎক্ষেপণ! প্রথম এক্স-রে স্পেস অবজারভেটরি পাঠিয়ে কৃষ্ণগহ্বরের অনুসন্ধানে ইসরো
  2. সূর্যের প্রথম পূর্ণ ডিস্ক ছবি পাঠালো আদিত্য-এল 1, পোস্ট করে তার বিবরণ দিল ইসরো
  3. মহাকাশ খাতের উন্নয়নের জন্য এফডিআই নীতি গুরুত্বপূর্ণ: ইন্ডিয়ান স্পেস অ্যাসোসিয়েশন

চেন্নাই, 25 ফেব্রুয়ারি: মহাকাশকে ঘিরে যে কখনও ব্যবসা-বাণিজ্য হতে পারে, এই শতকের আগে এরকমটা বোধহয় কেউ ভাবেনি ৷ গ্রহ-নক্ষত্র, উপগ্রহ- এসব শুধু বৈজ্ঞানিক বিষয় ছিল ৷ আর তার একচ্ছত্র অধিপতি ছিল ইসরো আর নাসা ৷ আরেক দিকে দূরদর্শী ব্যক্তিরা গ্রহ-তারকা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন ৷ এভাবেই গ্রহ-নক্ষত্রকে চিনত সাধারণ মানুষ ৷

তবে সাম্প্রতিক অতীতে মহাকাশ বিজ্ঞানের অনেক অগ্রগতি হয়েছে ৷ এই ক্ষেত্রে এখন বেসরকারি সংস্থাগুলিও ঢুকে পড়েছে ৷ আর তার ফলে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে সারা বিশ্বে মহাকাশ বিজ্ঞানের গবেষণায় ৷ তেমনই একটি পরিবর্তন হয়েছে ভারতেও ৷ মহাকাশ বিজ্ঞানের গবেষণার কয়েকটি সেক্টরে 100 শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বা ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট বা এফডিআই-তে ছাড়পত্র দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার ৷ ভারতের মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রকে উন্মুক্ত করা এবং সম্ভাবনাময় বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করাই এই পদক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য ৷

ভারতে মহাকাশ গবেষণা নিয়ে ইটিভি ভারতের প্রতিনিধিকে একান্ত সাক্ষাতকারে অনেক দিক তুলে ধরলেন ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন বা ইসরোর প্রাক্তন ডিরেক্টর ডঃ মাইলস্বামী আন্নাদুরাই ৷ তিনি দেশের 'মুন ম্যান' বলেও পরিচিত ৷ মহাকাশ, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাবের কথা বলেছেন তিনি ৷ এছাড়া তরুণ প্রজন্ম কীভাবে এখানে দুর্দান্ত কেরিয়ার গড়ে তুলতে পারে, সেই সুযোগগুলির কথাও জানিয়েছেন ডঃ মাইলস্বামী আন্নাদুরাই ৷ রইল সেই সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ ৷

ইটিভি ভারত: মহাকাশ গবেষণার সেক্টরে কেন্দ্রীয় সরকার 100 শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগে ছাড়পত্র দিয়েছে ৷ এতে এই শিল্পক্ষেত্রে কী সদর্থক পরিবর্তন হতে পারে, আপনি কী মনে করছেন ?

ডঃ আন্নাদুরাই: এর উত্তরে সাম্প্রতিক কিছু উদাহরণের কথা তুলে ধরি ৷ বিশ্বে কোভিডের সময়ে যদি কোনও একটি সেক্টর উন্নতি করে থাকে, তা হল এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রি ৷ গত 65 বছরে যত উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করা হয়েছে, তার মধ্যে 40 শতাংশেরও বেশি হয়েছে প্যানডেমিকের পরবর্তী 3 বছরে ৷ প্রধানত, এলন মাস্কের স্পেস এক্স এবং ওয়ান ওয়েবের মতো বেসরকারি স্পেস কোম্পানিগুলি 90 শতাংশেরও বেশি উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করেছে ৷ আর ভারতের কথা উঠলে, সেখানে প্রধানত কেন্দ্রীয় সরকার এই ক্ষেত্রটি পরিচালনা করলেও অনেক উন্নত গবেষণা হচ্ছে মহাকাশ নিয়ে ৷ আমরা চাঁদে, মঙ্গলে মহাকাশযান পাঠাচ্ছি ৷ আমরা নিজেরাই আমাদের প্রয়োজনীয় অনেক উপগ্রহ তৈরি করেছি ৷ আমার বিশ্বাস, বিদেশি বিনিয়োগ একে বাণিজ্যিক দিক দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে ৷

একসময় বিমান শুধুমাত্র বায়ুসেনার জন্যই ছিল ৷ পরে তা আমজনতার পরিবহণের মাধ্যম হয়ে উঠেছে ৷ ঠিক এমনটাই হতে চলেছে স্পেস সেক্টরে ৷ অন্য দেশগুলি এই বিষয়ে এগিয়ে রয়েছে ৷ তবে ভারতও খুব একটা পিছিয়ে নেই ৷ ভারতে স্পেস ইন্ডাস্ট্রি শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করে ৷ তবে সেখানেও পরিবর্তন হচ্ছে, যাতে বেসরকারি সেক্টরগুলিও মহাকাশ গবেষণায় অংশ নিতে পারে ৷

বিদেশি বিনিয়োগের প্রসঙ্গ উঠলে আরও ভালো পারফর্ম্যান্সের সুযোগের কথা উঠবে ৷ সেখানে ভারতীয়রাও প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে অংশ নিতে পারে ৷ আমার মনে হয়, এতে ব্যবসায়িক দিক দিয়ে উন্নতি হবে ৷ তামিলনাড়ুর কুলাসেকরন পট্টিনমে একটি লঞ্চ প্যাড তৈরি করা হবে ৷ আমি আত্মবিশ্বাসী, বাণিজ্যিকভাবে বিনিয়োগের দিকটি খুলে গেলে তা মহাকাশ গবেষণায় ভারতীয়দের আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে ৷

ইটিভি ভারত: মহাকাশকে জানার বিষয়টা শুধুমাত্র বিজ্ঞানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় ৷ দেশের সামরিক বাহিনীর স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ রয়েছে ৷ তার সঙ্গে জড়িয়ে জাতীয় সুরক্ষা ৷ এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ হলে তা সুবিধেজনক হবে কি ? আপনি কী মনে করেন ?

ডঃ আন্নাদুরাই: এটা একটা চ্যালেঞ্জিং বিষয় ৷ ব্যাপারটা মোবাইল ফোনের মতো ৷ একদিকে নিরাপত্তার জন্যও কার্যকরী আবার ব্যক্তিগত ব্যবহারেও দরকারি ৷ এর মধ্যে ড্রোনের বিষয়টিও রয়েছে ৷ সরকারের এই সেক্টরটি পরিচালনা করার অবশ্যই প্রয়োজন আছে ৷ যেখানে উৎপাদন অনেক বেশি, নতুন স্ট্র্যাটেজি এবং প্রযুক্তি দরকার ৷ আমার মতে, সেল ফোন আর আকাশপথে ভ্রমণকে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে, সেরকম ভাবেই এই সেক্টরকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ৷ বর্তমান যুগে শুধুমাত্র সরকারের পক্ষেই সব বিনিয়োগ এবং উন্নয়ন একাহাতে করা সম্ভব নয় ৷ বেসরকারি অংশীদারও প্রয়োজন ৷

ইটিভি: ধরে নেওয়া যাক, ভারতের স্পেস সেক্টরে বিশাল বিনিয়োগ হবে ৷ আর তার ফলে দারুণ কেরিয়ার গড়ার সুযোগও পাওয়া যাবে ৷ তাহলে ছাত্র-ছাত্রীরা এই সেক্টরে কীভাবে এগোবে ? কী নিয়ে লেখাপড়া করলে এই সেক্টরে পড়ার সুযোগ পাবে ?

ডঃ আন্নাদুরাই: মেকানিক্যাল, ইলেক্ট্রিক্যাল, ইলেক্ট্রনিক্স, কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ার ক্ষেত্রে বিটেক করার সুযোগ থাকে ৷ এরপর স্নাতকোত্তর স্তরে এরোনটিক্যাল, এরোস্পেস নিয়ে পড়াশোনা করা যেতে পারে ৷ যদি কেউ তিরুবনন্তপুরমে অবস্থিত ইসরোর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ স্পেস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে পড়াশোনা করার সুযোগ পায়, তাহলে তাঁর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবেই ৷ এই কোর্স শেষ করে সরকারি বা বেসরকারি স্পেস সেক্টরে চাকরি পেতে পারে ৷ আর পরীক্ষার ফলাফল খুব ভালো হলে নাসা অ্যাকাডেমিতে পড়াশোনার সুযোগও পেয়ে যাবেন ৷

ইটিভি: গঙ্গায়ন প্রজেক্টে মানুষকে মহাকাশে পাঠানোর কথা রয়েছে ৷ এই প্রজেক্ট এখন কী অবস্থায় রয়েছে ?

ডঃ আন্নাদুরাই: গঙ্গায়ন প্রজেক্টের শেষ দফায় একটি ক্রায়োজেনিক মেশিন ব্যবহার করতে হবে ৷ এমনকী এই চন্দ্রায়ন-3 প্রজেক্টেও পরীক্ষাগুলি হয়েছিল মানুষকে ধরেই ৷ এই ধরনের মিশনগুলিতে বাইরের তাপমাত্রা, এবং জ্বালানির মতো ছোটখাটো বিষয়ের পরিবর্তন যেন কোনও বাধা হয়ে না-দাঁড়ায় ৷ লঞ্চ ভেহিকল তৈরি শেষের পথে ৷ আমরা মানুষের যাওয়ার বিষয়ে খুবই সতর্ক রয়েছি ৷

ক্রায়োজেনিকের উপর 30 ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে ৷ শেষ ধাপে ক্রোয়াজেনিক মেশিন মানুষ বহন করতে পারবে কি না, সেই পরীক্ষা হয়েছে ৷ তাতে উতরে গিয়েছে ৷ এবার আলাদা আলাদাভাবে পরীক্ষাগুলিকে একসঙ্গে করলে কী ফল পাওয়া যায়, তা দেখতে হবে ৷ সেটাই চূড়ান্ত হবে ৷ এই বছরের শেষে মানুষবিহীন মহাকাশযানে 'বায়োমমিত্র' নামের একটি হিউম্যানয়েড রোবোট পাঠানো হবে ৷ সেই পরীক্ষার ফলাফলের উপর নির্ভর করে মানুষ পাঠানোর প্রচেষ্টা চালানো হবে ৷ মহাকাশযানটির উপর বায়ু চাপ, তাপমাত্রা ইত্যাদির কী প্রভাব পড়ল ৷ এই পরীক্ষার উত্তরে জানা যাবে, মানুষ যখন মহাকাশযানে ভ্রমণ করবে, তখন কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে ৷

ইটিভি: স্পেস ইন্ডাস্ট্রিতে আর্টিফিসিয়ান ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বিষয়ে আপনার মত কী ?

ডঃ আন্নাদুরাই: কম্পিউটার এবং সেল ফোনের মতো প্রযুক্তিগুলি প্রথমে স্পেস ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছে ৷ পরে সেগুলি বাণিজ্যিক হয় ৷ মঙ্গলায়নের উৎক্ষেপণের সময় থেকে ইসরো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ব্যবহার করে আসছে ৷ মঙ্গলায়ন কালাম মঙ্গলের দিকে এগিয়ে যায়, সেখান থেকে পাঠানো কোনও বার্তা আমাদের কাছে আসতে 20 মিনিট সময় নেবে ৷ আমরাও যদি কোনও বার্তা পাঠাই, সেটাও 20 মিনিট পরে সেখানে গিয়ে পৌঁছবে ৷ তাই মাঝে 40 মিনিটের একটা ব্যবধান থেকে যাচ্ছে ৷ এই সময়ের মধ্যে মঙ্গলায়নের পক্ষে পৃথিবী থেকে পাঠানো কোনও নির্দেশ ফলো করা কোনওভাবে সম্ভব নয় ৷ মঙ্গলের কক্ষপথে পৌঁছলে সেই সময় মঙ্গলায়ন নিজের অবস্থান স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে বুঝতে পারবে ৷ তখন নিজের গতি কমিয়ে মঙ্গলের কক্ষপথে নিজেকে স্থাপন করতে পারবে ৷ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই এই কাজটা করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে ৷

একইভাবে, চন্দ্রায়ন প্রজেক্টের বিক্রম ল্যান্ডার এবং প্রজ্ঞান রোভারকে অপারেট করার ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করা হয়েছে ৷ এখনও পর্যন্ত মহাকাশে ছোটখাটো যন্ত্রগুলির কাজকর্ম ঠিক হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করার কাজটি করছে মানুষ ৷ তবে এর জন্য আমরা এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ব্যবহার করছি ৷ ক্রায়োজেনিকের মতো যন্ত্রগুলিকে পরীক্ষা করে যে ডেটা পাওয়া যাচ্ছে, তার উপর নির্ভর করেই এআই সিদ্ধান্ত নেবে ৷ কম্পিউটারেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ৷ আর তার সাহায্যে কক্ষপথে ঘুরতে থাকা কৃত্রিম উপগ্রহগুলির উপর নজরদারি চালানো হয় ৷ এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রি আজকের প্রযুক্তিকে পথ দেখাচ্ছে, যা আগামিকাল দুনিয়ার প্রয়োজন ৷

ইটিভি: বিশ্ব উষ্ণায়ন এখন বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি সমস্যা ৷ আদিত্য এল-1 মহাকাশ যান সূর্যের সম্বন্ধে যে সব গবেষণা করবে, তাতে কি জলবায়ু পরিবর্তনের কোনও সমাধান সম্ভব ?

ডঃ আন্নাদুরাই: আদিত্য এল-1 মহাকাশের পরিবর্তনগুলি নিয়ে গবেষণা করবে, পৃথিবীর নয় ৷ মহাকাশে ঘুরে বেড়ানো কৃত্রিম উপগ্রহগুলির উপর বিশ্ব উষ্ণায়নে অনেক বেশি ৷ সম্প্রতি আইএনএসএটি-3ডিএস উৎক্ষেপণ করা হয়েছে, যা পৃথিবীর তাপমাত্রা পরীক্ষা করবে ৷ আর কয়েক সপ্তাহ পরেই এনআইএসআর (নাসা ইসরো সিন্থেটিক অ্যাপারচার রেডার) স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হবে ৷ এটি তৈরিতে 1.5 বিলিয়ন বা 150 কোটি মার্কিন ডলার খরচ হয়েছে ৷ ইসরো এবং নাসা- দু'টি মহাকাশ গবেষণা সংস্থা যৌথভাবে এই স্য়াটেলাইট তৈরি করেছে ৷ প্রতি 14 দিনে পৃথিবীর আবহাওয়ার পর্যালোচনা করা হচ্ছে ৷ আমার মনে হয়, এই ফল বিশ্বের অন্য দেশগুলিকে বুঝতে পারবে, বিশ্ব উষ্ণায়ন কী সাংঘাতিক হতে চলেছে ৷ শুধুমাত্র হিমালয় বা আন্টার্কটিকা নয়, জঙ্গলের তাপমাত্রাও রেকর্ড করে তার পর্যালোচনা করা হবে ৷

আরও পড়ুন:

  1. সফল উৎক্ষেপণ! প্রথম এক্স-রে স্পেস অবজারভেটরি পাঠিয়ে কৃষ্ণগহ্বরের অনুসন্ধানে ইসরো
  2. সূর্যের প্রথম পূর্ণ ডিস্ক ছবি পাঠালো আদিত্য-এল 1, পোস্ট করে তার বিবরণ দিল ইসরো
  3. মহাকাশ খাতের উন্নয়নের জন্য এফডিআই নীতি গুরুত্বপূর্ণ: ইন্ডিয়ান স্পেস অ্যাসোসিয়েশন
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.