হায়দরাবাদ: ইনাডু ৷ রামোজি রাও’য়ের হাত ধরে যে চারাগাছের জন্ম হয়েছিল, আজ তা বটবৃক্ষ ৷ প্রতি 30 বছরে, সমাজে একটি প্রজন্ম পরিবর্তন হয় ৷ তাদের চিন্তাভাবনার পরিবর্তন হয় ৷ যারা এই প্রজন্মগত পরিবর্তনের সূচনা করেন তাদের ট্রেন্ডসেটার বলা হয় ৷ যারা এই নতুন ধারণাকে এগিয়ে নিয়ে যায় তাদের বলা হয় মশালবাহক ৷ তেলেগু সংবাদ জগতে মশালবাহক হল 'ইনাডু' ৷
চলতি বছরের 10 অগস্ট 50 বছরে পা দিচ্ছে ইনাডু ৷ গোড়ার দিকে 4,500 সার্কুলেশন দিয়ে শুরু করা সংবাদপত্রের 50 বছর বয়সে পাঠক সংখ্যা 13 লক্ষেরও বেশি ৷ দেশের অন্যতম সমৃদ্ধ ভাষার অন্যতম দলিল মিডিয়া টাইকুন রামোজি রাও’য়ের এই স্বপ্নের ‘কাগজ’ ৷
গোড়ার কথা...
10 অগস্ট, 1974 ৷ বিশাখাপত্তনমের সীতামাধরা এলাকা ৷ প্রিন্টিং প্রেসের শব্দ । আশেপাশের লোকজন তখনও বুঝতে পারেননি, কী হচ্ছে । অচিরেই জন্ম নিল ইনাডু ৷ দাক্ষিণাত্যে তথ্য বিপ্লবের অন্যতম শরিকের যাত্রা শুরু হয়েছিল । অন্ধকারের বুক চিরে ‘ইনাডু’ প্রতিদিন সকালে পাঠকদের কাছে দেশের, দশের খবর দেয় ৷ আঞ্চলিক সংবাদপত্র হিসাবে যাত্রা শুরু করা ইনাডু শীঘ্রই বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছে ৷
ইনাডু’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক চেরুকুরী কিরণ বলেন, ‘‘50 বছরে পা দেওয়া ইনাডু’র যাত্রাপথের শরিক হওয়া এবং 35 বছর ধরে সংগঠনে দায়িত্বশীলভাবে কাজ করা গর্বের বিষয় । আমাদের চেয়ারম্যান শ্রী রামোজি রাও’য়ের শৃঙ্খলা স্থাপনের কারণে এটি সম্ভব হয়েছে । সংগঠনের অন্য সকলের মতো আমারও একই শৃঙ্খলাবোধ রয়েছে ৷’’
শব্দের জাদুকর রামোজি রাও !
অপ্রত্যাশিত যাত্রা, অবিচলিত বিবর্তন ৷ ‘ইনাডু’ দৈনিক একটি খুব নৈমিত্তিক পরিস্থিতিতে জন্ম নিয়েছে ৷ ছাত্রাবস্থায় টি. রামচন্দ্র রাও নামে এক ব্যক্তির সংস্পর্শে আসেন রামোজি রাও ৷ বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কর্মরত রামচন্দ্রকে দেখে এই জগতে আগ্রহ বাড়ে রামোজি রাও’য়ের । বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত কৌশল শিখতে আগ্রহী হন ৷ পড়াশোনা শেষ করে রামোজি রাও শিল্পী হিসেবে দিল্লির একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় যোগ দেন ৷ সেখানে তিন বছর কাজ করার পর তিনি ফিরে আসেন হায়দরাবাদে । সেসময় রামনাথ গোয়েঙ্কার অন্ধ্র প্রভা তেলেগু মিডিয়াতে সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্র ছিল ৷ তেলুগু সংবাদপত্র কেন তেলুগু মাটিতে পিছিয়ে থাকবে ? নিজেকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দৈনিক পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেন রামোজি রাও ।
কিন্তু শুরুটা কোথা থেকে হবে ? সেসময় বিজয়ওয়াড়া থেকে সমস্ত তেলুগু সংবাদপত্র প্রকাশিত হত ৷ বিজয়ওয়াড়া থেকে ট্রেনে করে সংবাদপত্র পাঠাতে হত বিশাখাপত্তনমে ৷ ট্রেনে করে সংবাদপত্র পাঠকদের কাছে পৌঁছতে প্রায় দুপুর হয়ে যেত । উত্তর অন্ধ্রের অন্যান্য অঞ্চলে পৌঁছত সন্ধে নাগাদ ৷
কিন্তু একইভাবে বিজয়ওয়াড়ায় পত্রিকা শুরু করলে, অনন্য হয়ে উঠবেন কী করে ? বিশেষ কিছু করার তাগিদে সেরা হয়ে ওঠার কৌশল খুঁজতে শুরু করেন তিনি ৷ সেই সুবাদেই বিশাখাপত্তনমে প্রেস তৈরির নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ৷ উদ্দেশ্য, পাঠকদের কাছে কোনও সংবাদপত্র পৌঁছনোর আগেই পৌঁছে যাবে ইনাডু ৷ রামোজি রাও বলতেন, চিনের যুদ্ধ কৌশল ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ তত্ত্ব তাঁর এই সিদ্ধান্তের অনুপ্রেরণা ৷
চারাগাছের জন্ম...
বিশাখাপত্তনমে সংবাদ প্রকাশনা শুরু করার সিদ্ধান্ত যদি দুঃসাহসী হয়, সংবাদপত্রের নাম বেছে নেওয়া ছিল আরও কঠিন সিদ্ধান্ত ! সেসময়ে, সমস্ত তেলুগু সংবাদপত্রের নামে ‘অন্ধ্র’ শব্দটি ছিল ৷ অন্ধ্র পত্রিকা, অন্ধ্র প্রভা, অন্ধ্র জনতা, অন্ধ্র জ্যোতি, ভিসালন্ধ্র পত্রিকাগুলি যেন অন্ধ্রের ইতিহাস, সংস্কারের ধারক ৷ যা মাটির সঙ্গে নিজেদের ‘ঘনিষ্ঠতা’ আরও বেশি করে বুঝিয়ে দিত ৷ এই পরিস্থিতিতে অন্ধ্র শব্দ ছাড়া একটি কাগজের নামকরণ করার সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সাহসী ছিল ! রামোজি রাও কাউকে অনুকরণ করতে অভ্যস্ত ছিলেন না । নিজের প্রাণপ্রিয় পত্রিকাটির নাম দিলেন ইনাডু (Eenadu) । 'নাড়ু' শব্দটির দু’টি অর্থ - ‘স্থান’ এবং ‘দিন’ । ইনাডু মানে এই জায়গা বা এই দিন ৷ অর্থাৎ অন্ধ্রের নাম ছাড়াই বুঝিয়ে দিলেন, তাঁর সংবাদপত্র এই মাটি ও তাঁর মানুষের কথা বলবে ৷
বিশাখাপত্তনমের সীতামাধরা এলাকার নাক্কাভানিপালেমে, বন্ধ থাকা একটি স্টুডিও লিজ নেওয়া হয় । সেটিকে মেরামত করে শুরু হয় ইনাডু সংবাদপত্র প্রকাশ । মুম্বইয়ের নব হিন্দ টাইমস থেকে একটি সেকেন্ড-হ্যান্ড ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটবেড রোটারি প্রিন্টিং প্রেস কেনা হয় । খরচ হয়েছিল এক লক্ষ পাঁচ হাজার টাকা ৷ প্রায় পাঁচ বা ছ’দিন আগে চলে ট্রায়াল রান । 9 অগস্ট সন্ধ্যায়, রামোজি রাও একজন সাধারণ কর্মীকে ইনাডুর প্রথম সংস্করণ ছাপানোর জন্য সুইচটি চাপতে অনুরোধ করেন । 10 অগস্ট ভোরের আগেই বিশাখাপত্তনমের মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যায় ইনাডু ।
ইনাডুর সম্পাদক এম. নাগেশ্বর রাও বলেন, ‘‘রামোজি রাও বলতেন, ইনাডু হল আপনাদের (পাঠকদের) পত্রিকা ৷ পাঠকরা এটিকে তাদের হৃদয়ে স্থান দিয়েছেন ৷ এটাই ইনাডুর খ্যাতি । ইনাডু তেলুগু পরিবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে । লক্ষ লক্ষ পাঠক ইনাডুর খবরে বিশ্বাস করেন ৷ একইভাবে যদি কোনও চ্যানেলে খবর পাওয়া যায়, তাহলে সেই খবরটি সত্য কি না তা জানার জন্য মানুষ ইটিভি দেখে ৷’’
সহজ শব্দে উদযাপন...
ইনাডু তেলেঙ্গানার সম্পাদক ডিএন প্রসাও বলেন, "ইনাডুর আগে, সংবাদপত্রে প্রচুর সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করা হত । সাধারণ পাঠকরা সেগুলি ভাষাটি বুঝতে পারত না । রামোজি রাও'খবর'কে সহজেই মানুষের বোধগম্য করার তাগিদে সাধারণ শব্দগুলির ব্যবহার শুরু করেন । সংবাদপত্রের ভাষা যাতে এমন হয় যে সংবাদ সাধারণ জনগণের কাছে যায় ।"
1974 সালে অন্ধ্রপ্রদেশের সম্মিলিত জনসংখ্যা ছিল এক কোটি । তেলেগু দৈনিকের সার্কুলেশন ছিল মাত্র দু'লক্ষ । রামোজি রাও কর্মীদের বলেছিলেন, তাদের লক্ষ্য বাকি 90 লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছনো । 1975 সালের 17 ডিসেম্বর হায়দরাবাদে ইনাডুর সূচনা হয়। হায়দরাবাদ সংস্করণটি শুরু হয় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জালাগাম ভেঙ্গালারাও, হাইকোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আভুলা সাম্বাসিভারাও এবং তেলেগু অভিনেতা এনটিআর এবং এএনআর-এর উপস্থিতিতে।
1978 সালের মে দিবসে, তৎকালীন রাজ্যপাল সারদা মুখোপাধ্যায়ের হাতে খুব ধুমধাম করে ইনাডুর বিজয়ওয়াড়া সংস্করণ শুরু হয়েছিল। বিজয়ওয়াড়া সংস্করণটি শুরু থেকেই প্রচলনের এক লক্ষ মাইলফলক অতিক্রম করেছে। এটি অন্ধ্র প্রভাকে পিছনে ফেলে শীর্ষস্থানীয় তেলেগু দৈনিকের অবস্থান নিয়েছে। 46 বছর ধরে ইনাডু'ই এক নম্বর ! চতুর্থ ইউনিট শুরু হয়েছিল তিরুপতিতে। 30 জুন, 2002-এ, সাতটি ইউনিট এক দিনে চালু করা হয়েছিল । কর্ণাটক, তামিলনাড়ু এবং মহারাষ্ট্রেও ইনাডুর সংস্করণ চালু হয় । 11 সেপ্টেম্বর, 2002-এ, রামোজি রাও দিল্লি সংস্করণ চালু করেন। মোট 23টি সংস্করণ সহ, ইনাডু শুধুমাত্র ধাপে ধাপে প্রসারিতই হয়নি, বরং তেলুগু ভাষাভাষীদের কাছে নিজের শিকড়ও গেড়েছে।
1974 সালে, ইনাডু'র প্রাথমিক প্রচলন ছিল 32টি এজেন্সির সঙ্গে 4,500 । 50 বছর পর ইনাডু এখন 11,000 এজেন্সির সঙ্গে 13 লক্ষেরও বেশি সংখ্যা-সহ বৃহত্তম তেলুগু দৈনিক হিসাবে প্রকাশিত হচ্ছে ।