ধূমপায়ীদের তাদের কুঅভ্যাস ছাড়তে উৎসাহিত করতে প্রতি বছর মার্চের দ্বিতীয় বুধবার নো স্মোকিং ডে পালন করা হয় । এবছর এই দিনটি পালিত হল 10 মার্চ । এই দিনটির মূল উদ্দেশ্য ধূমপানের কুপ্রভাব নিয়ে সচেতনতার প্রসার করা । এই উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে বহু মানুষ ধূমপানের জেরে ক্যান্সারের মতো গুরুতর অসুখের শিকার হয়ে প্রাণ হারান। এছাড়াও, শুধু ধুমপায়ীদের জীবনেই প্রভাব পড়ে না, তাঁরা তাঁদের আশেপাশের সেইসব মানুষকেও প্রভাবিত করেন, যাঁরা ধূমপান করেন না।
হায়দরাবাদের চেতনা হাসপাতালের মনোবিদ, ড. ফণী প্রশান্ত বলেন, “ধূমপান হল কোনও নিরাপত্তা ছাড়াই গাড়ি চালানোর মতো। অ্যালকোহলের ক্ষেত্রে, সামান্য পরিমাণে খেলে তা কিছু মানুষের পক্ষে উপকারী হতে পারে, কিন্তু সিগারেটের ক্ষেত্রে নিরাপদ কিছুই নেই। এমনকী একটা সিগারেটও মারাত্মক ক্ষতিকর ।”
ধূমপান নিয়ে কিছু তথ্য
- বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসকরা বলেন, সিগারেটে প্রায় চার হাজার বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় । এগুলো শুধু ক্যান্সার তৈরি করে তাই নয়, পাশাপাশি বহু গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের ক্ষতিসাধন করে এবং গুরুতর অসুস্থতার জন্ম দেয় ।
- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, তামাক প্রতি বছর 8 মিলিয়নেরও বেশি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায় । এই মৃত্যুর মধ্যে 7 মিলিয়নেরও বেশি হল সরাসরি তামাক সেবনের ফলে । প্রায় 1.2 মিলিয়ন মৃত্যুর কারণ হল পরোক্ষ ধূমপান ।
- হু জানিয়েছে, যে বিশ্বজুড়ে তামাক সেবনের সবথেকে পরিচিত পদ্ধতি হল সিগারেট । অন্যান্য তামাকজাত পণ্যের মধ্যে রয়েছে ওয়াটারপাইপ, ধোঁয়াহীন নানা তামাকজাত পণ্য, সিগার, সিগারিলো, পাইপ, বিড়ি এবং ক্রেটেক ।
স্বাস্থ্যের ওপর ধূমপানের প্রভাব
ধূমপান হল একটা নেশা এবং বহু অসুখ তৈরির পাশাপাশি, সেগুলোকে আরও গুরুতরও করে তোলে । বহু রকমের ক্যান্সার এবং অসুস্থতার সৃষ্টি হয় এর থেকে :
- হৃদরোগ ও স্ট্রোক
- করোনারি হার্ট ডিজ়িজ়
- ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজ়িজ় (সিওপিডি)
- শ্বাসজনিত অসুখ এবং লাং ক্যান্সার
- মুখ, নাক, গলা, অগ্ন্যাশয়, ব্ল্যাডার, সারভিক্স, কিডনি, রক্ত ও অন্যান্য ক্যান্সারের অন্যতম কারণও হতে পারে ধূমপান ।
- পেরিফেরাল আর্টেরিয়াল ডিজ়িজ় (পিএডি)
- পেরিফেরাল ভাস্কুলার ডিজ়িজ় (পিভিডি)
- রিউম্যাটয়েড আরথ্রাইটিস
- দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণতা
- উদ্বেগ ও খিটখিটে ভাব
- একটানা কাশি
- লিঙ্গ শিথিলতা এবং বন্ধ্যাত্বের মতো যৌন সমস্যা
- সন্তানধারণে সমস্যা, এমনকী গর্ভাবস্থায় ধূমপান গর্ভপাতের কারণও হয়ে দাঁড়াতে পারে । অথবা, শিশুর শরীরে জন্মগত সমস্যা দেখা দিতে পারে । সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোমের (এসআইডিএস) কারণে শিশুর মৃত্যুর সম্ভাবনাও থেকে যায় ।
আরও অনেক ধরণের অসুস্থতাও তৈরি হতে পারে। যিনি ধূমপান করেন, তাঁর ডায়াবিটিস, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, ত্বকে অকাল বলিরেখার মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে ।
ধূমপান ছাড়ার টিপস
এক ধাক্কায় হঠাৎ করে ধূমপান ছেড়ে দেওয়া সহজ কাজ নয় । ড. ফণী প্রশান্তের কথা, প্রথমে একজন ধূমপায়ীকে বুঝতে হবে যে কতটা ঝুঁকি তাঁরা নিচ্ছেন এবং কোনওভাবেই এই বদঅভ্যাসের পক্ষে সাফাই দেওয়া উচিত নয় । অন্যান্য টিপসগুলো হল:
- ধূমপান একেবারে ছাড়ার চেষ্টা করুন । সেটা সম্ভব না হলে, আস্তে আস্তে ধূমপানের মাত্রা কমিয়ে আনুন । উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনি দিনে ছ'টি সিগারেট খান, সেটা প্রথমে তিনে, তারপর দুইতে এবং শেষপর্যন্ত দিনে একটি সিগারেটে নামিয়ে আনুন। দিনে একটা সিগারেটে নামিয়ে আনার পর, তাকে কমিয়ে দুদিনে একটা সিগারেটে আনুন। এভাবে ব্যবধান বাড়াতে থাকুন, আর তারপর একেবারে থামিয়ে দিন।
- সেইসমস্ত বন্ধুদের এড়িয়ে চলুন, যারা আপনার ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার পরও আপনাকে অফার করবেন । খুবই সম্ভাবনা আছে যে এধরণের পরিস্থিতিতে আপনি ফের ধূমপান শুরু করে দিলেন ।
- আমাদের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, উইথড্রয়াল সিম্পটম এড়াতে রোজকার রুটিনে বদল আনুন । নিজেকে দিনভর ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করুন ।
- বন্ধু ও পরিবারের সহযোগিতা নিন ।
- স্ট্রেসে অনেকের ধূমপান করতে ইচ্ছে হয় । তাই স্ট্রেসের মোকাবিলা করতে আপনি যোগাসন, ধ্যান ও অন্যান্য ব্যায়াম করতে পারেন ।
- ড. প্রশান্ত জানান, যে এক্ষেত্রে গাম বা প্যাচের মতো নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপিও করা যেতে পারে ।
- আপনি যদি তা না পারেন, এবং প্রচুর সিগারেট খান, সেক্ষেত্রে আপনি মনোবিদের পরামর্শও নিতে পারেন । তিনি আপনাকে কিছু ওষুধ দিতে পারেন, যা ধূমপান ছাড়তে সাহায্য করবে ।
ধূমপান ছাড়া সহজ নয়, কিন্তু অসম্ভবও নয় । নিজের পাশাপাশি আপনি আপনার আশেপাশের মানুষগুলোকেও এর মারাত্মক কুপ্রভাব থেকে রক্ষা করতে পারেন । এই পদক্ষেপ করতে কোনও নির্দিষ্ট দিন লাগে না, যে কোনও দিনই এটা করা যায় । সব সময় মনে রাখবেন, ধূমপান ছাড়ার ক্ষেত্রে কখনোই খুব বেশি দেরি হয় না । মৃত্যুর দরজায় কড়া নাড়ার বদলে, বেছে নিন উজ্জ্বল ও সুস্থ ভবিষ্যৎকে । আজই ধূমপান ছাড়ুন !
আরও পড়ুন : 21 বছরের আগে ধূমপান নয় ! আইন আনছে কেন্দ্র
এছাড়াও পৃথিবী যখন কোভিড মহামারীর মধ্যে দিয়ে চলেছে, হু বলছে যে ধূমপায়ীদের সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি । “তামাক সেবনকারীরা (সিগারেট, ওয়াটার পাইপ, বিড়ি, সিগার, ধোঁয়া সৃষ্টিকারী তামাকজাত পণ্য) কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকতে পারেন, কারণ এতে আঙুল ঠোঁটের সংস্পর্শে আসে, যা হাত থেকে মুখে ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয় । শিশা বা হুঁকোর ক্ষেত্রে, প্রায়শই তার পাইপটির হাতবদল হয়ে থাকে, যার জেরে সামাজিকতার মধ্যে দিয়েও ভাইরাস ছড়াতে পারে ।” তাই ধূমপান করে ফুসফুসের আরও ক্ষতি করার থেকে, ধূমপান ছেড়ে দেওয়াই ভাল ।