করোনা প্যানডেমিক অনেক কিছুর উপরই প্রভাব ফেলেছে । আর তা শুধুমাত্র মানুষের জীবনযাপনের উপরই নয় ৷ বরং আরও অনেক জরুরি পরিষেবার উপরও যেমন স্বাস্থ্য পরিষেবা অত্যন্ত বিপর্যস্ত হয়েছে । গত বছরে কোভিড সংক্রমণে আকস্মিক বৃদ্ধি এবং লকডাউনের পর চিকিৎসায় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল তাদের, যারা নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিল । কোনও ক্লিনিক বা হাসপাতালে গিয়ে নিজেদের অসুবিধার কথা জানাতে মানুষও খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন । এর ফলে একাধিক স্বাস্থ্য পরিষেবা হয় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল বা অবহেলা করা হয়েছিল ।
যদিও করোনার আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) তরফে প্রকাশিত একটি খবরে বলা হয়, “বিশ্বব্যাঙ্ক এবং হু-র তরফে প্রকাশিত একটি নতুন রিপোর্ট অনুযায়ী, গোটা দুনিয়ার অন্তত অর্ধেক জনসংখ্যা জরুরি স্বাস্থ্য পরিষেবা পায় না । আর প্রতি বছর প্রচুর পরিবার দারিদ্রের কবলে পড়ে ৷ কারণ স্বাস্থ্য পরিষেবা পেতে তাদের নিজেদের পকেট থেকেই টাকা দিতে হয় ।” সুতরাং, এদের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবা হয় একেবারেই সাশ্রয়ী নয় আর নয় পাওয়া সম্ভব নয়, যা খুবই উদ্বেগের ।
আরও একটি উদ্বেগের খবর এসেছে হু–র তরফে এবং তা হল 2020 সালে শিশুমৃত্যু সংখ্যা নিয়ে ৷ কারণ এই বছর অনেক শিশু সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা পায়নি । ওই খবর অনুযায়ী, “2019 সালে আনুমানিক 5.2 মিলিয়ন শিশু, যাদের বয়স পাঁচ বছরের নিচে, এমন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে যা নিয়ন্ত্রণযোগ্য এবং নিরাময়যোগ্য ছিল । 1 থেকে 11 মাস বয়সি শিশুদের মধ্যে অন্তত 1.5 মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়েছে ৷ এমন রোগে আর 1 থেকে 4 বছর বয়সি অন্তত 1.3 মিলিয়ন শিশুর মৃত্যু হয়েছে । সদে্যাজাত শিশুদের (যাদের বয়স 28 দিনের নিচে) মধ্যে এমন রোগে মৃত্যুর সংখ্যা 2.4 মিলিয়ন । 2019 সালে পাঁচ থেকে নয় বছর বয়সের মধ্যে আরও অতিরিক্ত পাঁচ লাখ শিশুর মৃত্যু হয়েছে ।”
পাঁচ বছরের নিচে বয়স যাদের, এমন শিশুদের মৃত্যুর মূল কারণের তালিকায় রয়েছে জন্মের সময়ের আগের শারীরিক জটিলতা, জন্মগত ট্রমা, কনজেনিটাল অ্যানোম্যালিস, ডায়েরিয়া এবং ম্যালেরিয়া। এই সমস্ত রোগই নিয়ন্ত্রণযোগ্য এবং নিরাময়যোগ্য । আর তার জন্য সহজ ও সাশ্রয়ী কিছু উপায় যেমন টিকাকরণ, যথাযথ পুষ্টি, পরিষ্কার পানীয় জল এবং খাবার, প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর করা সেবাযত্ন প্রয়োজন । একটি বেশি বয়সের শিশুদের (5-9 বছর) 1990 সাল থেকে মৃত্যুহারে সবচেয়ে বেশি পতন ঘটেছে । হার হল 61 শতাংশ । আর এর কারণ সংক্রামক রোগব্যাধির প্রকোপ হ্রাস । বেশি বয়সের শিশুদের মধ্যে মৃত্যুর অন্যতম বড় কারণই হল চোট, আঘাত (যা সড়ক দুর্ঘটনা কিংবা নদীতে তলিয়ে যাওয়ার প্রভাবে ঘটে থাকে)। দুনিয়াজুড়ে বহু মানুষ টিকাকরণ, ‘নন–কমিউনিকেবল’ রোগব্যাধির নির্ধারণ এবং চিকিৎসা, মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা, পরিবার–পরিকল্পনা এবং গর্ভনিরোধক প্রভৃতি পরিষেবা থেকে বঞ্চিত থাকেন ।
মায়ের স্বাস্থ্য পরিষেবায় বড় প্রভাব পড়েছে
নিজেদের নির্দেশিকায় ভারতের ন্যাশনল হেলথ মিশন (এনএইচএম) উল্লেখ করেছে যে চারটি অ্যান্টি–নেটাল চেকআপ (এএনসি-সমূহ) কোনও অন্তঃস্বত্ত্বা মহিলার জন্য অত্যন্ত জরুরি, মায়ের স্বাস্থ্য এবং গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্য ভাল রাখার জন্য। তাছাড়া এটি শিশুর ডেলিভারির সময়ের জন্যও সহায়ক। যদিও 2020 সালে লকডাউনের জন্য আমাদের দেশে, চারটি এএনসি–পাওয়া মহিলাদের সংখ্যার হার, জানুয়ারি থেকে জুন মাসের মধে্য 7.7 শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, আগের বছর, 2019 সালের তুলনায়। সংখ্যায় বললে, 2020 সালের এপ্রিলে 7.15 লক্ষ কম মহিলা চারটি চেকআপ পরিষেবাই পেয়েছেন, 2019 সালের এপ্রিল মাসের তুলনায়। যদিও এই সংখ্যা ধীরে ধীরে বেড়েছে কারণ লকডাউনের নিয়মনীতি ক্রমশ শিথিল করে দেওয়া হয়েছে। তবুও এটি কোভিড–পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় এখনও কম। আরও একটি বিস্ময়কর পর্যবেক্ষণ হল, স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে ডেলিভারির সংখ্যা 2020 সালের প্রথম ছ’মাসের মধে্য কমে হয়েছে 9.59 লক্ষ, 2019 সালের একই সময়ের তুলনায়। এর কারণ সম্ভবত বেশিরভাগ মহিলাই সন্তান প্রসবের জন্য বাড়ি বা বাড়ির বাইরের কোনও জায়গা বেছে নিয়েছেন, ভাইরাস সংক্রমণের ভয় থেকে বাঁচতে। কারণ সেইসময় ভাইরাস সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য কারওই জানা ছিল না।
শিশুদের টিকাকরণ
এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ টিকা রয়েছে, যা শিশুদের একটি নির্দিষ্ট বয়সে পাওয়া বাধ্যতামূলক যেমন হাম, ডিপিটি, রুবেল্লা প্রভৃতি। হু এবং ইউনিসেফও আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে, “গোটা বিশ্বে জীবনদায়ী ভ্যাকসিন পেয়েছে, এমন শিশুদের সংখ্যায় বিপজ্জনক ঘাটতি দেখা গিয়েছে। এর কারণ ডেলিভারিতে বিপত্তি এবং কোভিড–19 প্যানডেমিকের প্রভাবে টিকাকরণ পরিষেবা স্থগিত হয়ে যাওয়া।” টিকাকরণে দেরি বা টিকাকরণ এড়িয়ে যাওয়া সামগ্রিকভাবে সারা জীবনের জন্য একটি শিশুর স্বাস্থে্যর উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
2020 সালের প্রথমার্ধে বিসিজি টিকাকরণে অন্তত 12.8 লক্ষ ঘাটতি দেখা গিয়েছে, 2019 সালের একই সময়ের তুলনায়। শিশুরা যারা জন্মের সময়ই পেন্টাভ্যালেন্ট ভ্যাকসিনের ডোজ পেয়েছে, তেমন শিশুদের সংখ্যাও অন্তত 14 লক্ষেরও বেশি হ্রাস পেয়েছে। এছাড়াও সেই সমস্ত শিশুদের সংখ্যায় 44 শতাংশ ঘাটতি দেখা গিয়েছে, যাদের মিসলস এবং রুবেল্লা রোগের বিরুদ্ধে টিকা দেওয়া হয়েছিল। শুধুমাত্র এপ্রিলেই এই সব টিকা ‘মিস’ করেছে, এমন শিশুদের সংখ্যা 1 লক্ষেরও বেশি। একইরকমভাবে হেপাটাইটিস বি এবং পোলিও রোগের টিকাকরণের সংখ্যাও কম হয়েছে।
অথচ ঠিক এর বিপরীতে, অভাবনীয়ভাবে রোটাভাইরাস টিকাকরণের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে যে সেই সমস্ত শিশু, যারা টিকা নিয়েছে, তাদের শতকরা হার 2020 সালের প্রথম ছ’মাসে 71 শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
অন্যান্য স্বাস্থ্য পরিষেবা
কোভিড–19 প্যানডেমিকের ফলে মানুষ এই মারণ ভাইরাসের সংক্রমণের ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছিল তাই তারা স্বাস্থ্যকেন্দ্র কিংবা হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা করানোর বদলে বাড়িতে থাকাই শ্রেয় বলে মনে করেছিল। খুব কম সংখ্যক মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হন, তাদের চিকিৎসা হয়, অস্ত্রোপচারও হয়। ‘ইন–পেশেন্ট’ এবং ‘আউট–পেশেন্ট’ স্বাস্থ্য পরিষেবা লকডাউনের সময় কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। আগের বছরের সঙ্গে তুলনা করলে 2020 সালের এপ্রিলে অন্তত 71 শতাংশ পতন ঘটেছে দাঁতের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যাওয়া মানুষের সংখ্যায়।
জরুরিকালীন পরিষেবা
লকডাউনের সময় জরুরি পরিষেবাতেও কাঁচি পড়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে হাসপাতালগুলি ইতস্তত করেছে এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে জরুরি পরিষেবা দিতেও প্রত্যাখ্যান করেছে। এছাড়াও হাসপাতালের শয্যা এবং অন্যান্য চিকিৎসাগত সম্পদও সীমিত হয়ে পড়েছিল সেই সময় এবং তা শুধুমাত্র কোভিড রোগীদের জন্যই রাখা হত। এর ফলে অন্যান্য জরুরি স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়া তখন আরও বেশি কঠিন এবং চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেরিব্রোভাস্কুলার রোগব্যধি এবং অ্যাকিউট কার্ডিয়াক এমারজেন্সির জন্য জরুরি পরিষেবাগুলিতে 14 শতাংশ ঘাটতি হয়েছিল। এর পাশাপাশি ওবেস্টেরিকস জটিলতা রোধে পরিষেবা পাওয়ার ক্ষেত্রেও 11 শতাংশ ঘাটতি দেখা গিয়েছে 2020 সালের প্রথমার্ধে।
আপাতদৃষ্টিতে বলতে গেলে, কোভিড–19 প্যানডেমিক এবং তার জেরে হওয়া লকডাউন যা 2020 সালের মার্চ মাসে দেখা গিয়েছিল, তাবিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যক্ষেত্রকে রীতিমতো পরীক্ষার মুখে ফেলে দিয়েছিল। যতটুকু সীমিত চিকিৎসা সম্পদ পরিকাঠামো, স্বাস্থ্যকর্মী, সাজ–সরঞ্জাম প্রভৃতি ছিল, সব কিছুই কোভিড–19 আক্রান্ত রোগীদের জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। আর এই সব কিছুই মানুষের স্বাস্থে্যর উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। মানুষ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়া এড়িয়ে গিয়েছে, যতক্ষণ না তা কোভিডের কারণে হয়। পুষ্টি কর্মসূচিগুলি বাধার মুখে পড়েছে এবং লকডাউন পরিবহণের উপরও প্রভাব ফেলেছে। এই সমস্ত বিপর্যয় হয়তো সাময়িক হতে পারে কিন্তু এটা দীর্ঘমেয়াদী ক্ষেত্রে অনেক জীবনের উপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে সমস্ত পরিষেবা সমস্ত রোগীর জন্য খোলা এবং অনলাইনে পরামর্শ দেওয়া ও টেলি–কনসালটেশনও চালু রয়েছে, তবুও সরকারি কর্তৃপক্ষের উচিত, প্যানডেমিক নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি এই ধরনের পরিষেবা চালু রাখা এবং তাদের সক্রিয়তাও বজায় রাখা।