কিছু কিছু মিডিয়া রিপোর্টে দেখানো হয়েছে যে, নভেল কোরোনা ভাইরাস সংক্রমণের আতঙ্কের মধ্যেই এই বছর ফ্লু- এর টিকা নেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজারে ফ্লু ভ্যাকসিন সম্পর্কে প্রচার বেশি কারণ মানুষজন এই ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে রয়েছেন যে ফ্লু-এর টিকা কোভিড-১৯ ও প্রতিরোধ করবে। কিন্তু জনগণকে যেটা বুঝতে হবে, সেটা হল ফ্লু এবং কোভিড-১৯ আলাদা আলাদা ভাইরাসের আক্রমণে হয়। সুতরাং তাদের প্রতিষেধকও একে অন্যের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই বিষয়ে আরও জানতে, আমরা ইন্দোরের অ্যাপল হাসপাতালের চিকিৎসক, ডা. সঞ্জয় কে জৈন, MBBS, MD (মেডিসিন)-এর সঙ্গে কথা বলেছি।
- সাধারণ ফ্লু আর কোভিড-১৯ এর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য:
—কোভিড-১৯ সংক্রমণ হয় SARS CoV-২ ভাইরাসের আক্রমণে। অন্যদিকে ফ্লু ছড়ায় ইনফ্লুয়েঞ্জা এ এবং বি ভাইরাসের মাধ্যমে।
—কোভিড-১৯ প্রাথমিকভাবে হল শ্বাসযন্ত্রের একটি রোগ যেখানে ভাইরাস ফুসফুসে পৌঁছে যায় কিন্তু ফ্লু-এর ক্ষেত্রে ভাইরাস মূলত নাক আর গলাতেই সীমাবদ্ধ থাকে।
—কোভিড-১৯ ভাইরাস ১৪ থেকে ২১ দিন পর্যন্ত সংক্রামক থাকে আর ফ্লু ভাইরাস সংক্রামক থাকে ৭ দিন পর্যন্ত।
—কোভিড-১৯ ভাইরাস, সাধারণ ফ্লু ভাইরাসের তুলনায় আরও বেশি তীব্র, গুরুতর এবং বিপজ্জনক।
- ফ্লু-এর টিকা কি কোভিড-১৯ ও প্রতিরোধ করতে পারবে?
—না। ফ্লু-এর টিকা নভেল করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা গড়ে তুলতে পারে না। এর কারণ হিসাবে ডা. সঞ্জয়ের ব্যাখ্যা হল, প্রতিটি ভাইরাসের আলাদা গঠন আছে এবং যখন কোনও একটি নির্দিষ্ট ভাইরাসকে নির্মূল করতে কোনও ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়, তখন সেটি কোনও মানুষকে কেবল সেই ভাইরাস থেকেই প্রতিরক্ষা দেয়। অন্যভাবে বলতে গেলে, ফ্লু বা সোয়াইন-ফ্লু এর যে টিকা রয়েছে, তা কেবল একজনকে সেই নির্দিষ্ট ভাইরাস থেকেই রক্ষা করবে এবং আর কোনও নির্দিষ্ট ভাইরাসের উপর সেটি সক্রিয় হবে না।
- ভ্যাকসিন কাকে বলে?
—ভ্যাকসিন তৈরির প্রক্রিয়া প্রতিটি ভাইরাসের ক্ষেত্রেই মোটামুটি সমান। সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন(সিডিসি)-এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী প্রতিষেধকের মধ্যে সেই জীবাণুই উপস্থিত থাকে, যা রোগব্যাধি ঘটায়। (উদাহরণস্বরূপ, হামের টিকায় হামের ভাইরাসই থাকে এবং Hib ভ্যাকসিনে Hib ব্যাকটিরিয়া থাকে)। কিন্তু সেই জীবাণুগুলিকে হয় মেরে ফেলা হয় অথবা এতটাই দুর্বল করে দেওয়া হয় যে তাদের প্রভাবে কেউ অসুস্থ হয় না। কিছু কিছু টিকায় আবার সেই রোগের জীবাণুর শুধু একটি অংশই থাকে ।
আমাদের বিশেষজ্ঞ আরও জানিয়েছেন যে, ভ্যাকসিন আমাদের শরীরে subcutaneously ইনজেক্ট করা হয় অর্থাৎ চামড়ার নিচে প্রয়োগ করা হয়। একবার ইনজেক্ট করার পর ভ্যাকসিনগুলি আমাদের ইমিউন সিস্টেমকে উজ্জীবিত করে এবং অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হয় রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসের বিরুদ্ধে। অ্যান্টিবডি তৈরি হতে ২ থেকে ৪ সপ্তাহ লাগে, যার পর নির্দিষ্ট রোগের বিরুদ্ধে কেউ ইমিউনিটি অর্জন করতে পারে। যদিও কতক্ষণ ইমিউনিটি স্থায়ী হবে, তা নিয়ে মতভেদ আছে। কিছু কিছু ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে ইমিউনিটি এক বছর কিংবা দু’বছর বা তারও বেশি হতে পারে । উদাহরণস্বরূপ, সোয়াইন ফ্লু ভ্যাকসিনের ইমিউনিটি এক বছর স্থায়ী হয় কিন্তু এখনও পর্যন্ত আমরা কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন সম্পর্কে এমন কোনও বিস্তারিত তথ্য জানি না ।
যেহেতু এই ভ্যাকসিনসমূহ তৈরি হয়েছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘Live Attenuated Vaccines ’-এর মাধ্যমে অর্থাৎ দুর্বল হয়ে পড়া জীবাণুর মাধ্যমে, তাই শরীরের যেখানে একে ইনজেক্ট করা হবে, সেখানে সামান্য ব্যথা হবে। সঙ্গে দেখা দেবে ফ্লু-এর কিছু উপসর্গ যেমন মৃদু জ্বর, মৃদু মাথাব্যথা বা শরীরে ব্যথা, যা এক বা দু’দিন স্থায়ী হবে। তবে সাধারণ প্যারাসিটামল ওষুধ সেবনেই মিলবে আরোগ্য। যদিও অতিবিরল রোগের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনের প্রভাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়াও দেখা দিতে পারে।
কিন্তু এই ধরনের ঘটনা খুবই কম ঘটে। যদি কারও শরীর আগে থেকেই ‘ইমিউনোকমপ্রোভাইসড’ থাকে তাহলে তাঁর কিছু নিউরোলজিক্যাল সমস্যা যেমন মেনিনজাইটিস, নিউরোপ্যাথি বা মায়োপ্যাথি প্রভৃতি হতে পারে কিন্তু ভ্যাকসিনের প্রভাবে এই ধরনের জটিলতা খুবই কম দেখা দেয়।
আরও পড়ুন : ইনফ্লুয়েঞ্জ়ার উপসর্গকে অবহেলা করবেন না
- ফ্লু ভ্যাকসিন কাদের দরকার?
—ডা. সঞ্জয় বলেন যে তিনি যতটা দেখেছেন, মানুষ ফ্লু-এর বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন নিতে ততটা উৎসাহী নয় । যদিও এটা সকলের জন্যই সুপারিশ করা হয়, তবুও সকলে টিকা নিতে আগ্রহী নয় কারণ সম্ভবত সচেতনতার অভাব। তাঁর কথায়, “যদি সকলের জন্য না-ও হয়, তবু আমি সকলকে মন থেকে পরামর্শ দেব, যাদের ঝুঁকি বেশি, তারা যেন ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা পেতে ভ্যাকসিন নেয় । বয়স্ক যারা, যারা ডায়াবিটিস, হার্টের রোগে আক্রান্ত, যাদের বাইপাস সার্জারি হয়েছে, হাঁটু প্রতিস্থাপন হয়েছে যাদের, ডায়ালিসিসের রোগী, ক্যানসার আক্রান্ত যাদের কেমোথেরাপি চলছে, বিছানায় শুয়ে থাকা রোগী প্রভৃতি, তাদের নিউমোনিয়া এবং ফ্লু হওয়ার ঝুঁকি খুবই বেশি । সুতরাং, তাদের জন্য ফ্লু-এর টিকা নেওয়ার জরুরি পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে ।” এছাড়া শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক–সকলের ক্ষেত্রেই ফ্লু টিকা নেওয়া যেতে পারে ।
আমাদের চেষ্টা করা উচিত বাজারে এই নিয়ে সচেতনতা প্রসার করা কারণ এটা সমাজের হিতের জন্য ভাল । এতে ইমিউনাইজেশন হয় এক থেকে দু’বছরের জন্য।
সুতরাং ভ্যাকসিন শুধুমাত্র কোনও একটি নির্দিষ্ট ভাইরাসের বিরুদ্ধেই কাজ করে, যার বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য তাকে তৈরি করা হয়েছে। ডা. সঞ্জয় এটাও জানিয়েছেন যে টিকা প্রস্তুতিতে সাধারণত ৩ থেকে ৫ বছর সময় লাগে। তবে বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি এবং চিকিৎসাগত উদ্ভাবনের কারণে কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।