কোন তেলটা রান্নায় ব্যবহার করা উচিত, কোন তেলটা বেশি স্বাস্থ্যকর আর তেল কতটা পরিমাণে রান্নায় ব্যবহার করা উচিত, তা নিয়ে প্রায়ই আমরা নিজেদের মধে্য আলোচনা কিংবা তর্কবিতর্কে জড়িয়ে পড়ি। বর্তমানে পৃথিবী স্বাস্থ্যসচেতন মানুষে পরিপূর্ণ, কাজেই বিভিন্ন তেলের ধরন বোঝা আর বাজারে এত তেলের মধে্য থেকে সবচেয়ে স্বাস্থ্যকরটি বেছে নেওয়া খুব জরুরি। প্রতিটি তেলের নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা অন্যটির থেকে আলাদা। রান্নার তেল সম্পর্কে বিশদে জানার জন্য আমরা ইন্দোরের MGM মেডিক্যাল কলেজ এবং নেহরু চিলড্রেন’স হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের পুষ্টিবিদ, ড. সংগীতা মালুর সঙ্গে কথা বলেছি।
তেলের সম্পর্কে কোন তথ্য অবশ্যই জানা উচিত?
রান্নার তেল সংক্রান্ত এমন কিছু জরুরি তথ্য, যা প্রতে্যকেরই অবশই জানা উচিত, ডা. সংগীতা তা ব্যাখ্যা করেছেন।
রিফাইন্ড না আনরিফাইন্ড?
—তেল সাধারণত বীজ থেকে নিঃসরণ করা হয়।
—আগে তেল ‘আনরিফাইন্ড’ (অপরিশোধিত) তথা ‘কচ্চি ঘানি’ থাকত, যা দীর্ঘ সময়ের জন্য সংরক্ষণ করে রাখা যেত না।
—এই ধরনের তেল বর্তমানে বাজারে ‘রিফাইন্ড’ (পরিশোধিত) বা ‘পিউরিফাইড’ (ভেজালমুক্ত) এবং ‘ফিল্টার্ড’ (পরিস্রাবণ) বা ‘ডবল ফিল্টার্ড’ করে বিক্রি করা হয়। এতে তেলগুলি দীর্ঘ সময়ের জন্য ব্যবহার করা যায় এবং এর গন্ধ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয় না।
—তেল ‘রিফাইন’ করার এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকে ‘অ্যাসিডিফিকেশন’। অর্থাৎ তেলের মধে্য অ্যাসিড মেশানো হয়।
সুতরাং, ‘আন—রিফাইন্ড’ তেলই ব্যবহার করা উচিত, কারণ এটি প্রাকৃতিক এবং এতে রাসায়নিক মেশানো হয় না। আপনি এমন তেলও বেছে নিতে পারেন, যা সবচেয়ে কম ফিল্টার করা হয়।
সেপারেট না ব্লেন্ডেড?
অনেক তেল মিশিয়ে একটি তেল তৈরি করা হয়েছে, এমন তেলও বাজারে পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে তেলের পুষ্টিগত গুরুত্ব বাড়াতে একের বেশি তেল মেশানো হয়। কিন্তু এই ধরনের তেল এড়িয়ে যাওয়াই বাঞ্ছনীয় কারণ প্রতিটি তেলের নিজস্ব ‘হিটিং পয়েন্ট’ তথা তাপাঙ্ক রয়েছে। তাই অনেক তেল মেশালে স্বাস্থে্যর উপর তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
ফ্যাটি অ্যাসিড
—প্রতিটি তেলের আলাদা আলাদা ফ্যাটি অ্যাসি়ড রয়েছে।
—আমরা যখন তেল নিয়ে কথা বলছি, তখন এটাও জানা দরকার যে তেলে অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে এবং এগুলি কখনও কঠিন আকার ধারণ করে না। ব্যতিক্রম নারকেল তেল।
—ফ্যাটি অ্যাসিড নানা ধরনের হয়। তবে সামগ্রিকভাবে আমরা তাদের সম্পৃক্ত এবং অসম্পৃক্ত, এই দুই ভাগে ভাগ করতে পারি।
—অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডকে আবার মোনো—আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (MUFA) এবং পলি—আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (PUFA)—তে ভাগ করা যেতে পারে। আবার PUFA—তে ওমেগা—থ্রি এবং ওমেগা—সিক্স থাকে।
যদি কোনও তেলে ওমেগা—থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের মাত্রা বেশি থাকে, তাহলে তাতে অ্যান্টি—অক্সিডেটিভ গুণাগুণ বেশি থাকবে এবং এটি হার্ট ভাল রাখার পাশাপাশি কোলেস্টরলের মাত্রা কম করতেও সাহায্য করবে। তাছাড়া এটি শরীরে ইনসুলিন ক্ষরণ বাড়াতেও সহায়ক হবে। সুতরাং, আমরা এমন তেলই বেছে নেব যেখানে বেশিমাত্রায় ওমেগা—থ্রি রয়েছে।
আমাদের শরীরে সম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয়তা হল ১০ শতাংশ, যা সাধারণত আমরা রোজকার যা খাবার খাই, তার থেকেই মেলে। কিন্তু যদি বেশি মাত্রায় তা গৃহীত হয়, তখন তা শিরায় খারাপ কোলেস্টরল হিসাবে জমতে থাকে। যার জন্য রান্নায় ঘি—এর (‘ক্ল্যারিফায়েড বাটার’) থেকে তেল ব্যবহারের পরামর্শই বেশি দেওয়া হয়।
কোন তেল রান্নায় ব্যবহার করা উচিত?
—দীর্ঘ সময় ধরে একই ধরনের তেল রান্নায় ব্যবহার করা উচিত নয়।
—যে তেলে বেশি মাত্রায় অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে, তা বেছে নেওয়া উচিত।
—প্রতিটি তেলের নিজস্ব পুষ্টিগত গুরুত্ব আছে এবং সেইসব পুষ্টিগুণ আমাদের শরীরের জন্য জরুরি।
—তেলে ফ্যাট দ্রবণীয় ভিটামিন থাকে, যা আমাদের লিভারে জমা হয়।
সুতরাং, প্রতি িতন মাস অন্তর আমাদের রান্নার তেল বদলে ফেলা উচিত।
কী কী ধরনের তেল রয়েছে?
নানা ধরনের বিকল্পের মধে্য আমাদের বিশেষজ্ঞ বাজারে সাধারণভাবে যা বেশি বিক্রি হয়, তেমন কিছু তেলের বিবরণ দিয়েছেন।
১. নারকেল তেল
পঁাচ বছর পর্যন্ত বয়স যে সব শিশুদের, তাদের জন্য নারকেল তেল ভাল। এই তেলে মিডিয়াম চেন ট্রাইগ্লিসারাইডস রয়েছে এবং তাদের হজমশক্তির জন্য ভাল কারণ ওই বয়স পর্যন্ত তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি সম্পূর্ণভাবে গড়ে ওঠে না। যদিও বড়দের এই তেল রান্নায় ব্যবহার করা উচিত নয় কারণ এতে সম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি, ৯০—৯২ শতাংশ পর্যন্ত, যা কঠিনে পরিণত হতে পারে।
২. কর্ন অয়েল তথা ভুট্টার তেল
কর্ন অয়েল ভুট্টার অঙ্কুর থেকে নিঃসরণ করা হয়। এর ‘স্মোকিং পয়েন্ট’ অত্যন্ত বেশি, যার জন্য এতে ‘অক্সিডেশন’ ঘটে না আর তাই এই তেলের মান নষ্ট হয় না। হার্টের সুস্বাস্থে্যর জন্য কর্ন অয়েল ভাল।
৩. লিনসিড অয়েল
লিনসিড অয়েল নিঃসরণ করা হয় ফ্ল্যাক্সসীড তথা তিসি বীজ থেকে। এর ‘অক্সিডেশন’—এর হার বেশি কিন্তু এতে MUFA এবং ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের মাত্রা বেশি। তাই এই তেল শরীরে লো ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (LPL) কমাতে এবং হাই ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (HDL) বাড়াতে সাহায্য করে।
৪. অলিভ অয়েল
এই তেল অন্যান্য তেলের থেকে একটু আলাদা এবং এর একটা ঝঁাঝালো গন্ধ এবং স্বাদ আছে, অনেকটা সরষের তেলের মতো। অলিভ অয়েলে MUFA—র পরিমাণ এবং ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ, দুইই বেশি, যা স্বাস্থে্যর জন্য ভাল।
৫.সরষের তেল
এই তেল স্বাদ এবং গন্ধে বেশ ঝঁাঝালো এবং শীতকালে রান্নায় এই তেলের ব্যবহার বেশি হওয়া উচিত কারণ এই তেল এমনিতেই উষ্ণ প্রকৃতির। এতে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে, যা স্বাস্থে্যর জন্য ভাল।
অন্যান্য যে সব তেলে উচ্চ মাত্রায় অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে, তা হল
৬. সোয়াবীন অয়েল
৭. সানফ্লাওয়ার অয়েল
৮. ক্যানোলা অয়েল
৯. পিনাট অয়েল
১০. সিসামে অয়েল
যে সব তেলে উচ্চ মাত্রায় ওমেগা থ্রি ফ্যাসি অ্যাসিড থাকে, তা ক্যানসার কোষের বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করে। ঋতুগতভাবে বলতে গেলে, শীতকালে সরষের তেল বা অলিভ অয়েল ব্যবহার করা যেতে পারে, গ্রীষ্মে কর্ন বা সানফ্লাওয়ার তেল আর বর্ষায় সয়াবীন অথবা পিনাট অয়েল ব্যবহার করা যেতে পারে। সুতরাং, এমন তেল রান্নায় ব্যবহার করার জন্য বেছে নেওয়া উচিত, যা সহজে কঠিন হয়ে যায় না এবং প্রতি তিন মাস অন্তর রান্নার তেল বদল করা প্রয়োজন।