বারাসত, 27 জুন : দীর্ঘ লকডাউন কেড়েছে ওঁদের মুখের হাসি। রুটি রুজি হারিয়ে আজ সংকটের মুখে ওঁরা। দিন কাটছে চরম আর্থিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে। ওঁরা বারাসত স্টেশনের দোকানি ও হকার। রেলের চাকা ঘুরলেই পেট চলে তাঁদের। হাসি ফোটে মুখে। কিন্তু এই লকডাউন, স্টেশনের দোকানি ও হকারদের জীবনের সবকিছু ওলট-পালট করে দিয়েছে। একদিকে লকডাউনে বন্ধ তাঁদের কাজকর্ম। অন্যদিকে হাতে টাকা না থাকায় এখন পরিবার নিয়ে কষ্টের মধ্যে দিনযাপন করতে হচ্ছে তাঁদের। কোনওরকমে রেশনের চাল দিয়ে আধপেটা খেয়ে বেঁচে রয়েছেন স্টেশনের দোকানি ও হকাররা। এই মুহূর্তে অসহায় অবস্থায় রেলের দিকে তাকানো ছাড়া আর কোনও উপায় নেই তাঁদের। যদিও ইতিমধ্যেই রেল কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে অগাস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত সমস্ত লোকাল ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকবে। তাই স্টেশনের দোকানি ও হকারদের দুর্দশা যে এখনই ঘোচবার সম্ভবনা কম তা বলাই যায়।
বারাসত স্টেশনে রেল পরিষেবার সঙ্গে দোকানি ও হকারদের জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জংশন স্টেশন হওয়ায় প্রতিদিন ট্রেন ধরার জন্য বারাসতে স্টেশনে আসেন কয়েক হাজার যাত্রী। একইভাবে স্টেশনে নামতে দেখা যায় হাজার হাজার যাত্রীকে। সর্বক্ষণই যাত্রীদের আনাগোনা লেগে থাকে শিয়ালদা বনগাঁ ও হাসনাবাদ শাখার ব্যস্ততম এই স্টেশনে । আর যাত্রীদের কাছে সামগ্রী বিক্রি করার উপরই স্টেশনের দোকানি ও হকারদের উপার্জন হয় । সেই আয় থেকেই চলে তাঁদের সংসার । এতদিন এভাবেই হাসি মুখে দিন গুজরান করেছেন দোকানি ও হকাররা। কিন্তু, কোরোনা মোকাবিলায় লকডাউন জারি হওয়ার পর থেকেই তাঁদের জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার! কাজকর্ম বন্ধ থাকায় ঘোর অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে দোকানি ও হকারদের জীবন। লকডাউনের জেরে রুটি রুজি হারিয়ে কার্যত এখন পথে বসার জোগাড় তাঁদের। দীর্ঘ লকডাউন কাটিয়ে আনলক ওয়ান পর্ব শুরু হলেও এখনও স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি রেল পরিষেবা। কবে, রেল চলাচল শুরু হবে তাও অজানা স্টেশনের দোকানি ও হকারদের কাছে। এই পরিস্থিতিতে তাঁরা চাইছেন দ্রুত রেলের চাকা ঘুরুক আগের মতো। স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসুক তাঁদের জীবনে।
এই বিষয়ে বারাসত স্টেশনের দোকানি রজত রায় বলেন, "স্টেশনের তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে আমার ছোট্ট খাবারের দোকান রয়েছে। তার থেকে যেটুকু আয় হত তা দিয়েই সংসার চলত।কিন্তু লকডাউনের জন্য সেই আয়ও বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এভাবে কতদিন চলবে তার চিন্তায় রাতে ঘুম আসেনা! দ্রুত রেল পরিষেবা স্বাভাবিক না হলে আগামী দিনে পথে বসা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না। রেল কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ আমাদের বিষয়ে একটু চিন্তা করুন। নাহলে পরিবার নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে"।
একই সুর শোনা গিয়েছে ওই স্টেশনের এক হকারের গলাতেও। তাঁর কথায়, "স্টেশনে ও ট্রেনের মধ্যে ঝাল মুড়ি বিক্রি করে কোনওরকমে পরিবার নিয়ে সংসার চলত। কিন্তু লকডাউনের জেরে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার আয়ের পথও বন্ধ। খুব কষ্টের মধ্যে দিন গুজরান করতে হচ্ছে। রাজ্য সরকারের দেওয়া রেশনের চালই এখন ভরসা। যা পাওয়া যায় তা দিয়ে পাঁচজনের সংসারও চলে না ঠিকমতো। এই অবস্থায় রেল কর্তৃপক্ষ যদি আমাদের দিকে না তাকায় তাহলে মরা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না।"
এদিকে,স্টেশনের দোকানি ও হকারদের দুরবস্থার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকেই দায়ী করেছেন INTTUC-র বারাসত হকার্স ইউনিয়নের কার্যকরী সভাপতি মন্টা দাস। তিনি বলেন, "দীর্ঘ প্রায় তিনমাস হতে চলল লোকাল ট্রেন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ। যার ফলে রোজগার হারিয়েছেন স্টেশনের কয়েকশো দোকানি ও কয়েক হাজার হকার। তাঁরা কী অবস্থায় রয়েছে তা একবারের জন্যও খোঁজ নেয়নি স্টেশন কর্তৃপক্ষ। ফিরেও তাকায়নি তাঁদের দিকে। রাজ্য সরকার এই কঠিন পরিস্থিতিতে যদি সাধারণ মানুষের জন্য রেশনের ব্যবস্থা না করত তাহলে না খেয়ে মরতে হত তাঁদের । স্টেশনের দোকানি ও হকাররাও রেশনে চাল,আটা ও ডাল দিয়েই সংসার চালাচ্ছেন এখন। তবে দীর্ঘদিন এই অবস্থা চলতে পারেনা।" তাঁর মতে, "লকডাউন শিথিল হওয়ায় যদি অন্যান্য পরিষেবা যদি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে পারে তাহলে নিয়মবিধি মেনে ট্রেন পরিষেবা চালু করতে অসুবিধে কোথায়? প্রয়োজনে স্টেশনের দোকানি ও হকাররাও লকডাউন সুরক্ষা বিধি মেনেই তাঁদের কাজকর্ম শুরু করবে। তাও তো দুপয়সা আয় করতে পারবে তাঁরা। আমরা শীঘ্রই বিষয়টি রেল কর্তৃপক্ষের গোচরে আনবে"।
অন্যদিকে,বিষয়টি নিয়ে বারাসত স্টেশন ম্যানেজার জয়দেব মন্ডলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, "লোকাল ট্রেন চলাচলের বিষয়ে এখনও অবধি কোনও নির্দেশিকা আসেনি রেলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। ফলে,নির্দেশিকা না আসা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু করা যাবে না। দোকানি ও হকারদের সমস্যা হচ্ছে বুঝতে পারছি। কিন্তু, এই পরিস্থিতিতে কিছু করার নেই।"