গোবরডাঙা, 19 অক্টোবর : নেই সেই জমিদারি । ঘোড়ায় টানা এক্কাগাড়ি, কামানের তোপধ্বনি, বাড়িময় লোক, মহাকালের নিয়মে সবই আজ বিলীন । কিন্তু ফি বছর উমার বন্দনায় বনেদিয়ানার ছাপ রাখত গোবরডাঙায় জমিদার পরিবার । কোরোনা আবহে এবার সেই ঐতিহ্যবাহী পুজোতেও ছন্দপতন । জমিদারবাড়িতে পুজো হবে না । উত্তর 24 পরগনার অন্যতম প্রাচীন দুর্গাপুজো গোবরডাঙার জমিদারবাড়ির পুজো । দুর্গামন্দিরের ঠিক পাশেই রয়েছে প্রসন্নময়ী কালীমন্দির ৷ এই মন্দিরের বারান্দাতেই ঘট পুজোর মাধ্যমে সারা হবে সমস্ত নিয়ম ৷
বাংলার বুকে তখন নবাবের শাসন । নদিয়া, অবিভক্ত 24 পরগনার বড় এক জনপদ নিয়ে ছিল গোবরডাঙার জমিদারি । তারাই 1711 সালে প্রথম দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন । দিনে দিনে ঐতিহ্য ও বনেদিয়ানায় জামিদারবাড়ির পুজোর জৌলুস বাড়তে থাকে । কালের নিয়মে নবাবি শাসনের বাঁধন দুর্বল হতে শুরু করে । বিদেশি বণিক, ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে । পলাশির যুদ্ধের পর গোটা বাংলায় অরাজকতা । পালা করে এল আরও বড় বিপর্যয় । ছিয়াত্তরের মন্বন্তর । গোটা বাংলার এক তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যু হল । শস্য শ্যামলা সবুজ বাংলা শ্মশানে পরিণত হল । সিপাহী বিদ্রোহ, বঙ্গভঙ্গ বা 1946 সালের দেশজোড়া রক্তক্ষয়ী হিংসা । কিন্তু জমিদারবাড়ির পুজো কখনও বন্ধ হয়নি । সেই পরম্পরার যবনিকাপতন । থেমে গেল তিনশো বছরের রীতি । কোরোনা আবহে এবার জমিদারবাড়িতে দুর্গাপুজো হবে না । পাশে প্রসন্নময়ী কালীমন্দিরে ঘটপুজো করে নিয়ম রীতি পালন করবে জমিদার পরিবার ।
অতীতে কেমন ছিল জমিদারবাড়ির পুজো ? সে এক সোনালি অতীত। তখন বাংলার বুকে হাতেগোনা কয়েকটা মাত্র দুর্গাপুজো । তাই আয়োজন থেকে মহোৎসবের মহরত । মহাষষ্ঠীর মাহেন্দ্রক্ষণে জমিদারবাড়ির উঠোনে কামানের তোপধ্বনিতে শুরু হত পুজো । সাতমহলার মানুষ সেই তোপধ্বনিতেই পুজোর বার্তা শুনতেন । তারপর পাঁচ দিন ধরে চলত পুজো । জমিদারির অন্তর্ভুক্ত প্রজারা পাঁচদিনই সেই পুজোয় শামিল হতেন । পাঁচদিনই থাকত পাত পেড়ে খাওয়া-দাওয়া । কলকাতা থেকে সাহেবরা আসতেন । সঙ্গে মেমসাহেবরা । আমলারা আসতেন । শেষের দিকে আসতেন চলচ্চিত্র তারকা ও নির্মাতারাও । কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ও দু'বার জমিদারবাড়ির পুজোয় এসেছেন । বিসর্জনের দিন জমিদাবাড়ির উঠোনে সারে সারে ঢাকের বাদ্যি । চলত সিঁদুরখেলা । তারপর যমুনায় দেবীর ভাসান । জমিদার পরিবারের অষ্টম বংশধর স্বপনপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় বললেন, "ছোটোবেলায় দেখেছি, আমাদের বাড়ির পুজোয় কত লোক আসতেন । বড় বড় আমলারা আসতেন । চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় দু'বার এসেছেন । পাঁচদিন ধরে বাড়িতে মহোৎসব চলত । সে সব বলে বোঝানো যাবে না ।"
কোরোনা পরিস্থিতিতে এবার পুজো হবে না জমিদার বাড়িতে । স্বপনবাবু বলেন, "তিনশো বছরের ঐতিহ্যবাহী পুজো । পলাশীর যুদ্ধ, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, সিপাহী বিদ্রোহ - আমরা কোনওদিন পুজো বন্ধ করিনি । এবার আর পারলাম না । কোরোনা পরিস্থিতিতে পুজো আমাদের বন্ধ রাখতেই হচ্ছে । ভীষণ কষ্ট হচ্ছে । কিন্তু কিছু করার নেই ।" জমিদার পরিবারের অন্যতম সদস্য নয়নপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় বলেন, "পুজো হবে না । কেবল ঘটপুজো করে নিয়ম পালন করতে হবে । ভীষণ মনখারাপ লাগছে । কিন্তু, কিছু করার নেই। কোরোনার বিপদ যে আরও বড় ৷"
জমিদারবাড়ির পুরোহিত সাধন ভট্টাচার্য বলেন, "যে যেখানেই ঠাকুর দেখুক, জমিদারবাড়ির দেবী মায়ের মুখ না-দেখলে পুজো অসম্পূর্ণ থেকে যেত । এতদিনের সেই পুজো এবার আর হবে না । এই প্রথম জমিদারবাড়ির পুজো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে । শুধু ঘটপুজো হবে। কত কথা মনে পড়ছে । মনটা ভীষণ খারাপ লাগছে ।"
জমিদারবাড়ির দশভুজাকে এবছর দেখা যাবে না । মুখভার দর্শনার্থীদেরও । স্থানীয় গৃহবধূ সুস্মিতা সাহা বলেন, "জমিদারবাড়ির পুজোয় আলাদা একটা গরিমা আছে । পাঁচদিনে আমরা যত ঠাকুরই দেখি না কেন, এই ঠাকুর না দেখলে মন ভরে না । শুনলাম, এবার সেই পুজো হবে না । মন খারাপ তো লাগছেই ।"