পুরুলিয়া, 14 জুলাই : দেখতে বাংলার আর পাঁচটা সাধারণ গ্রামের মতোই । কিন্তু তফাত রয়েছে । এই গ্রামে ঢোকা বা বেরোনোর কোনও রাস্তা নেই । মানে ! এও আবার হয় নাকি ! গ্রামে ঢোকার রাস্তা না থাকলে মানুষ থাকে কীভাবে এখানে ?
শুনলে অবাক হবেন, কিন্তু এটাই সত্যি । গ্রামটা যেন একেবারে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো । পুরুলিয়ার 1 নম্বর ব্লকের গারাফু সরা গ্রাম পঞ্চায়েতের শ্যামপুর গ্রাম । এই গ্রামে ঢোকার কোনও রাস্তা নেই । পুরুলিয়া বাস স্ট্যান্ড থেকে রাঁচি রোড ধরে কিছুটা এগিয়ে, তারপর ধানবাদ রোড । সেখান থেকে আরও কিছুটা এগিয়ে ডানদিকের রাস্তা ধরে এগোলেই গ্রামের রাস্তা । এরপর যত এগোবেন, তত রাস্তার প্রকৃতি বদল হতে থাকবে । কালো পিচের রাস্তা ছেড়ে গ্রামের রাস্তা ।
একের পর এক গ্রাম পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে যেতে কিছুদূর পর্যন্ত গিয়েই রাস্তা শেষ । বাকিটুকু মেঠো পথ । ব্যস ! আর রাস্তা নেই । রাস্তা যেন এখানে কর্পূরের মতো উবে গিয়েছে । খাতায় কলমে এখান থেকেই শ্যামপুর শুরু হচ্ছে । কিন্তু সামনে শুধুই চাষের জমি । সবুজ খেত এখানে পায়ের তলা থেকে গিয়ে সোজা আকাশে মিশেছে । এই চাষ জমির ওপারে রয়েছে শ্যামপুরের বসতি । সবার থেকে বিচ্ছিন্ন একটি গ্রাম । অথচ এই শ্যামপুরেই কম-বেশি হাজার জন মানুষের বাস ।
তাহলে কীভাবে যাতায়াত করেন এখানকার মানুষরা ?
শ্যামপুরের মানুষ এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় যেতে পারেন ঠিকই । তার জন্য রাস্তাও রয়েছে । কিন্তু সমস্যাটা হয় গ্রামের থেকে বেরোনোর সময় । স্বাধীনতার এত বছর পরেও গ্রামে ঢোকার বা বেরোনোর নেই কোনও নির্দিষ্ট রাস্তা । সমস্যাকে সঙ্গী করেই এখানে দিন কাটে শ্যামপুরবাসীর । এদেরও জেলা সদর পুরুলিয়া । গ্রামের কেউ অসুস্থ হলে ভরসা পুরুলিয়ার সদর হাসপাতাল । তবে হঠাৎ করে কারও শরীর খারাপ হলে, অ্যাম্বুলেন্সের দরকার পড়লে; নাজেহাল অবস্থা হয় গ্রামবাসীদের । গ্রামে আগুন লেগে গেলে নেই অগ্নিনির্বাপণ গাড়ি ঢোকার পর্যাপ্ত জায়গাও । আসলে গ্রামে ঢোকার কোনও নির্দিষ্ট সরকারি রাস্তাই নেই এখানে ।
কখনও প্রতিবেশীদের জমির উপর দিয়ে যেতে হচ্ছে । আবার কখনও চাষ জমির আলপথ দিয়ে যেতে হচ্ছে । বছরের পর বছর ধরে একই জায়গার উপর দিয়ে যেতে যেতে ঘাস উঠে গিয়েছে । বেশ চওড়াও হয়েছে । কিন্তু এটিকে রাস্তা ভেবে ভুল করবেন না । এগুলি সবই কোনও না কোনও গ্রামবাসীরই জমি । কোথাও কোথাও যাঁদের রায়ত সম্পত্তি, তাঁরা নিজেদের জায়গা জমি চষে দিলে মানুষ পড়ে যান বিপদে । গাড়ি নিয়ে পার হওয়া তো দূর, হেঁটেই পার হওয়া দুর্বিষহ হয়ে যায় । গ্রামে ঢুকতে গেলেও পোহাতে হয় হাজার ঝক্কি । গাড়ি এসে পথ বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে থাকে রাঁচি রোডের পাশে আইমন্ডি মোড়ে ।
সমস্যা আরও অনেক । শ্যামপুরের এই গ্রামে কেউ মেয়ের বিয়ে দিতে চান না । তাঁদের বক্তব্য, রাস্তা নেই ঠিকঠাক... মেয়ের বিয়ে দেবে কেন এই অজ গাঁয়ে !
তার উপর এখন আবার বর্ষাকাল । মেঠোপথ এখন আর পথ থাকে না । মাটি-জল মিলেমিশে একাকার । পুরো কাদায় মাখামাখি । গাড়ি নিয়ে যাওয়া তো দূর, হেঁটে যেতে গেলেই পা ঢুকে যায় কাদায় ।
স্থানীয় পঞ্চায়েতের কাছে বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার জানানো হয়েছে । কিন্তু পঞ্চায়েতও নিজেদের ঘাড় থেকে দায় এড়িয়ে গিয়েছে । বলা হচ্ছে, যেহেতু এখানে নির্দিষ্ট কোনও রাস্তা নেই, তাই তাঁরা কিছুই করতে পারবেন না । অগত্যা, অন্যের রায়ত জমির ওপর দিয়েই যাতায়াত চলছে শ্যামপুরবাসীর ।
কিন্তু কেন রাস্তা নেই শ্যামপুরে ?
কখনও আলপথ, কখনও মাঠের উপর দিয়ে, আবার কখনও কারও জমির উপর দিয়ে... এভাবেই যাওয়া আসা চলে শ্যামপুরের গ্রামবাসীদের । পায়ে চলার পথও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে এতদিনে । কিন্তু সেটা তো আর রাস্তা হল না ! সমস্যাটা হল এই মৌজাটি যখন তৈরি হয়, তখন এর মধ্যে পাশের মৌজার কিছু অংশ ঢুকে পড়ে । শ্যামপুর মৌজায় কিছুটা অংশে সরকারি রাস্তা থাকলেও পাশের মৌজায় রাস্তার জন্য সরকারি কোনও জায়গা নেই ।
অর্থাৎ, এখানকার মানুষ এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় যেতে পারেন । কিন্তু গ্রামের বাইরে বেরোতে গেলেই সমস্যা ! গ্রামের বসতি যেখানে শেষ হচ্ছে, সেই পর্যন্ত রাস্তা রয়েছে । কিন্তু তারপরই চাষের জমি । সেখান দিয়ে আর রাস্তা বের করা সম্ভব হয়নি এতদিনে ।
সমাধানের পথ খুঁজছে শ্যামপুর
শ্যামপুর থেকে পাশের গ্রামে বেরোতে গেলে যেখান দিয়ে রাস্তা তৈরি করা যেতে পারে, তার পুরোটাই ডাঙা জমি । আর সেই কারণে সরকারিভাবে খাতায় কলমে রাস্তা তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না । শ্যামপুরের বাসিন্দারা একাধিকবার আবেদন জানিয়েছেন পঞ্চায়েত অফিসে । যদি রাস্তার একটি ব্যবস্থা করা হয় । পঞ্চায়েত থেকে বলা হচ্ছে, গ্রামবাসীরা যেন নিজেদের থেকে কিছুটা করে জমি ছেড়ে দেন রাস্তার জন্য । তাহলেই রাস্তা তৈরি হয়ে যাবে । কিন্তু তাতেও রাজি নন শ্যামপুরের একাংশ । গ্রামেরই বেশ কয়েকটি পরিবার জমি ছাড়ার বিষয়ে বেঁকে বসেছেন । আর এই সমস্যার মধ্যেই নাজেহাল শ্যামপুর ।