পুরুলিয়া, 19 অক্টোবর : শরতের আকাশে ভাসছে পেঁজা তুলো মেঘের ভেলা ৷ বাতাসে শিউলির গন্ধ ম ম করছে ৷ পুজো পুজো গন্ধে মাতোয়ারা চারিদিক ৷ কিন্তু কোরোনার থাবা পড়েছে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজোতে ৷ এবছরে জাঁকজমকপূর্ণ দুর্গাপুজোর প্রস্তুতিতেও ভাটা পড়েছে ৷ কোরোনা আবহে পুজো কমিটিগুলি বাজেটে কাটছাঁট করেছেন । যার জেরে যথেষ্ট কদর পাচ্ছেন না প্রতিমা শিল্পীরা ৷ ডাক শিল্পীদের বরাত জুটেছে যৎসামান্য ৷ আর তাই পুরুলিয়ার ডাকশিল্পীদের মধ্যে ব্যস্ততা একেবারে নেই বললেই চলে ৷ এই পরিস্থিতিতে নিজেদের পেশা ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন রীতিমতো ৷
পুরুলিয়ার আড়ষা থানার বামুনডিহা গ্রাম ডাক শিল্পের জন্য বিখ্যাত ৷ বাইরে থেকে কাঁচামাল কিনে এনে নজরকাড়া ডাক শিল্পের জিনিসপত্র তৈরি করেন শিল্পীরা ৷ এখানে প্রায় 20 থেকে 25টি পরিবার এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ৷ প্রতিবছর পুজোর দেড় থেকে দু'মাস আগে বরাতের কাজে লেগে পড়েন শিল্পীরা ৷ নাওয়া-খাওয়ার সময় থাকে না ৷ এমন কী সময়মতো বরাত যোগাতেই রাতের ঘুম উড়ে যায় ৷ বছরের অন্যান্য সময়ে টুসু, ছৌ, বাই, করম, ঘোড়া, নাটুয়া নাচের সব সামগ্রী বানিয়ে সংসার চালান ৷
জেলার বিভিন্ন প্রান্ত তো বটেই ! পার্শ্ববর্তী রাজ্য ঝাড়খণ্ড থেকে ডাক শিল্পের অর্ডার পেয়ে থাকেন শিল্পীরা ৷ শিল্পীরা পুজোর মরসুমে 30 থেকে 50 হাজার টাকা ঘরে তোলেন ৷ কিন্তু এবছরে কোরোনা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷ হাতে গোনা মাত্র কয়েকটা অর্ডার পেয়েছেন শিল্পীরা ৷ বাইরের অর্ডার তো দূর হস্ত ! জেলার অর্ডারগুলোই এসেছে অর্ধেক দামে ৷ এছাড়া বিগত কয়েক মাস কোরোনার জন্য টুসু-ছৌ-বাই তো বন্ধ ৷ সাজ সরঞ্জামের জিনিসপত্র তৈরির অর্ডার নেই বললেই চলে ৷ তার উপর দাম বেড়েছে কাঁচামালের ৷ এই অবস্থায় সংসার চালানোই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে শিল্পীদের ৷ তাঁদের বক্তব্য, প্রশাসন যদি পাশে দাঁড়ায় তবেই এই চরম আর্থিক অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন ৷
দিলীপ যোগী নামে বামুনডিহার এক ডাক শিল্পী বলেন, "এবছরে কোরোনার জন্য দুর্গাপুজোর মরশুমে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছি ৷ প্রতিবছরের তুলনায় এবছর অর্ডার পেয়েছি খুবই কম ৷ বাইরের জেলা থেকে এবার একটিও অর্ডার পাইনি ৷ যারা আগাম অর্ডার দিয়ে রেখেছিল তাও বাতিল হয়ে গেছে ৷ অন্যদিকে কাঁচামালের দামও বেড়েছে, কিন্তু সেই অনুপাতে পুজো কমিটির কাছ থেকে সাজসরঞ্জামের দাম মিলছে না ৷ এখন পারিশ্রমিকের টাকাটুকু উঠবে কি না তাতে সন্দেহ রয়েছে ৷"
সুশান্ত-রাখাল-পাগল-স্বপনরা জানান, "পূর্বপুরুষানুক্রমে আমরা ডাকের কাজ করে আসছি ৷ সারা বছর ধরেই বামুনডিহার 20-25টা ঘর ডাকের নকশা তোলে ৷ বিগত বছরগুলোতে ভালোই লাভ হয়েছে ৷ প্রত্যেকের ঘরে পুজোর সময় প্রায় 40-50 হাজার টাকা ওঠে ৷ এবার অর্ডার তেমন একটা নেই ৷ মরশুমে 10 হাজার টাকাও উঠবে কি না সন্দেহ রয়েছে ৷ এবছর কোরোনার জন্য নাচের অনুষ্ঠান বন্ধ রয়েছে ৷ নাচের সামগ্রী তৈরির অর্ডারও মিলছে না ৷ এভাবে চলতে থাকলে জানিনা এই পেশায় কতদিন আর থাকতে পারব ৷ এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশা বেছে নিতে হতে পারে ৷"
কোরোনা আবহে ডাকশিল্পীদের বরাত মিলেছে কম ৷ সেই সম্পর্কে পুরুলিয়া জেলা পরিষদ সভাধিপতি সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ডাকশিল্পীরা সম্পূর্ণ বরাত পাননি তা নয় ৷ কিন্তু আপনারা জানেন আমাদের এখানকার দুর্গাপুজো কিংবা বাইরের পুজোয় বরাত পেয়ে থাকেন তাঁরা ৷ আমাদের এখানকার শোলার কাজ বিখ্যাত ৷ প্রচুর পরিমাণে তা বিকোয় ৷ এবছর সেভাবে তা বিক্রি হয়নি ৷ আমরা দেখছি কীভাবে সরকার ডাকশিল্পীদের পাশে দাঁড়াতে পারে ৷"
শিল্পীদের এই কোরোনা আবহের কারণে কী ঐতিহ্যবাহী ডাকশিল্প ধ্বংস হয়ে যেতে চলেছে ? অনেকেই ইতিমধ্যে এই শিল্পের কাজ ছেড়ে বিকল্প পদ্ধতিতে পয়সা রোজগারের জন্য পথ খুঁজে নিয়েছেন ৷ নতুন প্রজন্ম এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হতে চাইছেন না ৷ সংকটে শিল্পীরা ৷ দিশেহারা কিছু ডাকশিল্পীরা এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন ৷ তাঁরা কেবল সরকারি সহায়তার জন্য দিন গুণে চলেছেন ৷