বর্ধমান, 2 নভেম্বর : বর্ধমান শহরের বোরহাট এলাকায় রয়েছে কমলাকান্ত কালীবাড়ি । বর্ধমান স্টেশন থেকে টোটো বা রিকশায় চেপে যাওয়া যায় । স্টেশন থেকে দক্ষিণ দিকে প্রায় দেড় কিলোমিটার গেলে মিলবে কার্জনগেট । সেই কার্জনগেট ধরে পশ্চিম দিকে উত্তর ফটক রাজবাড়ি পেরিয়ে সোজা গেলেই বোরহাট মোড় । সেখান থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যেই বাঁদিকে রয়েছে কমলাকান্ত কালীবাড়ি ।
বর্ধমানের মহারাজা তখন রাজা তেজচাঁদ । রাজার উদ্যোগে বর্ধমান শহরের বোরহাট এলাকায় কমলাকান্তের সাধনার জন্য তৈরি হয় কালী মন্দির । কে এই কমলাকান্ত ? সাধক হিসেবে অধিক পরিচিত হলেও কমলাকান্ত ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক ও সুরকার ৷ সুকণ্ঠের অধিকারীও ছিলেন তিনি ৷ রচনা করেছিলেন একাধিক পদাবলী ৷ কমলাকান্তের গানে মুগ্ধ হয়ে তদানীন্তন বর্ধমানের রাজা তেজচাঁদ তাঁকে সভাপণ্ডিত করে বর্ধমানে নিয়ে আসেন ৷ সালটা ছিল 1216 বঙ্গাব্দ ৷ তখনই তাঁকে এই মন্দির গড়ে দেন রাজা ৷
আরও পড়ুন : Dakatia Kali Puja: অমাবস্যার রাতে বর্ধমানের রাজাকে চাঁদ দেখিয়েছিলেন সাধক
অনেকের মনেই প্রশ্ন কেন এই কালী কমলাকান্তের নামে নামাঙ্কিত ৷ এর পিছনেও রয়েছে একটি কাহিনি ৷ তখনকার দিনে মায়েরা সাধারণত পরিচিত হতেন ছেলের নামে ৷ যেমন - রামের মা, শ্যামের মা ইত্যাদি ৷ ঠিক তেমনই সেই সময় কমলাকান্ত বলতেন, "আমি কালীর ব্যাটা কমলাকান্ত" ৷ তাই তখন থেকেই ছেলে কমলাকান্তের নামে পরিচিত হন মা কালী ৷ নাম হয় কমলাকান্ত কালী ৷
কথিত আছে, একদিন অমাবস্যার রাতে মহারাজ তেজচাঁদকে পূর্ণিমার চাঁদ দেখিয়ে অবাক করে দিয়েছিলেন কমলাকান্ত ৷ এমনকি মা কালীরও যে প্রাণ আছে তা রাজাকে দেখাতে গিয়ে দেবী মূর্তির পায়ে বেল কাঁটা ফুুটিয়ে দেন সাধক ৷ রাজা তখন দেখেন কালীমূর্তির পা বেয়ে রক্ত ঝরছে ৷ একবার রাজা কোনওভাবে জানতে পারেন যে কমলাকান্ত সুরা পান করছেন ৷ তখন তিনি এই বিষয়টির সত্যতা জানতে চাইলে কমণ্ডলু থেকে সুরা রাজার হাতে ঢেলে দেন কমলাকান্ত ৷ রাজা দেখেন সুরা নয়, কমণ্ডলু থেকে দুধ বের হচছে ৷ এরকমই আরও নানান অলৌকিক কাণ্ডকারখানার কথা শোনা যায় ৷
এই মন্দিরে পঞ্চমুন্ডির আসনে বসেই সাধক কমলাকান্ত সিদ্ধিলাভ করেছিলেন ।
আরও পড়ুন : Kali Puja 2021 : বাঁকুড়া থেকে চিরতরে বর্গীদের বিদায় দেন মাঁ-ই-ত কালী
কমলাকান্ত কালীবাড়ির ট্রাস্ট বোর্ডের সভাপতি প্রশান্ত কোনার জানান, কৃষ্ণসায়রের পাশে একবার এক সন্ন্যাসী এসেছিলেন ৷ কমলাকান্ত তখন এই মন্দিরেই পুজো করছিলেন ৷ সন্ন্যাসী এসেছে শুনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান কমলাকান্ত ৷ সেই সময় ওই সন্ন্যাসী তাঁকে একটি কাচের পুতুল দেন ৷ কাচের পুতুলটি পাওয়ার পরই কমলাকান্তের মনে ভাবের পরিবর্তন হয় ৷ ফিরে এসেই তিনি বলতে থাকেন আমার যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে, আমি চললাম, মহারাজকে খবর দিয়ে দাও ৷
খবর পাওয়ার পরই রাজা তেজচাঁদ অন্তর্জলি যাত্রার জন্য কমলাকান্তকে কাশী নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন ৷ তখনকার দিনে মৃত্যুর আগে গঙ্গার ধারে নিয়ে যাওয়ার রীতি ছিল ৷ একেই বলা হত অন্তর্জলি যাত্রা ৷ তখন কমলাকান্ত বলেছিলেন, না আমি মাকে ছেড়ে কোথাও যাব না ৷ আমাকে মায়ের থেকে আলাদা করবেন না ৷ আশ্চর্যজনকভাবে তখন মন্দিরের মাটি ভেদ করে জলধারা বেরোতে থাকে ৷ তখন থেকেই মনে করা হয় ওটাই গঙ্গা ৷ কমলাকান্ত না যাওয়ায় গঙ্গা নিজেই এসে উপস্থিত হয়েছে বলে মনে করেন সবাই ৷ পরবর্তীতে মন্দিরের সেই জায়গায় একটি কুয়ো খনন করা হয় ৷ এখনও সেই কুয়োর জলকে গঙ্গার জল হিসেবে মায়ের ভোগ থেকে পুজো সব কিছুতেই ব্যবহার করা হয় ৷
এমনকি গানের মাধ্যমেও তিনি রাজাকে বুঝিয়েছিলেন কতটা মা কালী অন্তপ্রাণ ছিলেন তিনি ৷ তাঁর শেষ গান ছিল - "কী গরজ আমি গঙ্গাতীরে যাব, কালো মায়ের কালো ছেলে বিমাতার কি শরণ নেব ?" 1821 খ্রিষ্টাব্দে এই গান গাইতে গাইতেই তিনি দেহত্যাগ করেন ৷ কমলাকান্ত যেহেতু নিজে বলে গিয়েছিলেন যে, তাঁকে যেন মায়ের থেকে আলাদা না করা হয় তাই তাঁর সমাধির উপরেই মায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয় ৷
এর আরও একটি কারণ শোনা যায়, কমলাকান্ত বৈষ্ণব ছিলেন বলে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় ৷ ছেলেবেলায় তিনি যে মায়ের মূর্তি পুজো করতেন তাতে কোনও শিব ছিল না ৷ নিজের বুকের উপর মা কালীকে বসিয়ে তিনি পুজো করতেন ৷ তাই পরবর্তীতে তাঁর সমাধির উপরেই মায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পুজো করা হয় ৷
আরও পড়ুন : Kali Puja Singur : মা সারদার মধ্যে কালীর দর্শন পেয়ে ডাকাত সর্দার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ডাকাতে কালীর
উনি যেহেতু বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত ছিলেন তাই এখানে মায়ের মূর্তিতে অনেকটা কৃষ্ণের আদলও রয়েছে ৷ তিনি কালী এবং কৃষ্ণ দুভাবেই মায়ের সাধনা করেছিলেন ৷
মন্দিরের পুরোহিত চন্দন বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, সারাবছর মায়ের নিত্যপুজো চললেও দীপান্বিতা অমাবস্যার মহানিশায় এখানে তন্ত্র মতে ও বৈদিক সমর্থনে পুজো করা হয় ৷ রাত বারোটায় পুজো শুরু হয় ৷ চলে সকাল ছ'টা পর্যন্ত ৷ চালকুমড়ো ও আখ বলি দেওয়া হয় । আর যেহেতু কমলাকান্তের প্রিয় ছিল মাগুর মাছ ৷ তাই মায়ের ভোগে অবশ্যই দিতে হয় মাগুর মাছের ঝোল । এছাড়াও ভোগে থাকে অনেকরকম ভাজা, তরকারি, খিচুড়ি, চাটনি ও পায়েস ৷
আরও পড়ুন : Kali Pujo 2021: 500 বছরের আদি করুণাময়ী কালীমন্দির, বংশ পরপম্পরায় মন্দিরের পুরোহিত সাধক বামাক্ষ্যাপার বংশধররা