বর্ধমান, 24 অগাস্ট : দা লেজেন্ড অফ মাইক ডজের কথা মনে আছে ? একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে সাড়া জাগানো সিরিজ় ছিল সেটি । আর মাইক ডজকে মনে আছে ? সাদা গাল ভরতি দাড়ি । আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া থেকে নিষ্কৃতি পেতে প্যাসিফিক নর্থ-ওয়েস্ট রেনফরেস্টের কাছে ঘর বেঁধেছিলেন তিনি । গাছের ডালে বাসা বেঁধে থাকতেন । খেতেন পোকা । জন্তুরা ছিল তাঁর পরম বন্ধু । কী ভাবছেন টিভিতেই এমন হয় ? না, বাস্তবেও হয় । এই রাজ্যের বর্ধমানেই রয়েছেন এমন এক ব্যক্তি । প্রায় 20 বছর ধরে গাছে মাচা বেঁধেই থাকেন তিনি । গাছগাছালি, পাখপাখালি, জন্তু-জানোয়ার নিয়েই তাঁর পরিবার । সাপেরা তাঁর বন্ধু । পূর্ব বর্ধমান জেলার পালিতপুরের লোকু রায় (52) মিলেমিশে তাঁদের সঙ্গে থাকেন বাঁশ বাগানে ।
পালিতপুরের ওই গ্রামে ঢুকলেই বাঁশ বাগান । সেখানে আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে আগাছা, মাঝে বস্তা আর কিছু প্লাস্টিক জড়ো করে রাখা । কিন্তু প্লাস্টিক সরালেই দেখা যাবে একটি ছোট্ট ঘর । উঁকি মারলেই দেখা মিলবে অগোছালো বিছানার । এখানেই এক চিলতে জায়গায় বাস লোকু রায়ের ।
স্ত্রী মারা গেছেন প্রায় 20 বছর আগে । স্ত্রী'ই ছিলেন তাঁর একমাত্র সঙ্গী । তিনি মারা যাওয়ার পর তাই একা হয়ে যান লোকু । ছেলে-মেয়েদের কীভাবে মানুষ করবেন তা জানা ছিল না । তাঁর মা'ই তাঁদের দেখভাল করতেন । গ্রামে জমি ছিল অনেক । চাষবাস করেই দিন কাটত তাঁর । গাছপালার প্রতি সেখান থেকেই প্রেম । স্ত্রী চলে যাওয়ার পর প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভেঙে যায় বাড়ির একাংশ । তারপর থেকে বাঁশ বাগানেই ঘর বাঁধা । মাটিতে বাড়ি করতে খরচ বেশি । আর পাছে আবার ভেঙে যায়, সেজন্যই গাছে বাঁশের মাচা করে, তাতে বস্তা আর প্লাস্টিক দিয়ে ছোট্ট কুঠুরির মতো ঘর বানিয়ে সেখানেই থাকা শুরু । বছর 27-এর ছেলে থাকেন ভিন রাজ্যে । মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে । তাঁরা ডাকলেও তাঁদের বাড়িতে গিয়ে থাকেন না লোকু রায় ।
ঘরের পাশেই ক্যানেলে বসানো রয়েছে জাল । যাতে রোজই ছোটো ছোটো মাছ উঠে আসে । তা দিয়েই খাওয়াদাওয়া সেরে নেন তিনি । দরকারে গ্রামে ঘুরে বেরিয়েও খাবার জোগার করেন । প্রয়োজনে পাশের গ্রামে ছোটোখাটো কাজও করেন । তবে, তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, রাতে ফেরেন সেই এক চিলতে গাছের ঘরে । সেখানে নেই আলো, নেই পাখা । গরমে অসুবিধা হয় না ? লোকু রায়কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান, আলো আছে । টর্চ । আর প্রকৃতির হাওয়াই তো আসল । ভালো লাগে পাখির কিচিরমিছিরে ঘুম ভাঙতে । ভালো লাগে সূর্যের প্রথম আলো যখন কুঠুরিতে ঢোকে । ভালো লাগে পাখি, পোকা-মাকড়, জীবেদের সঙ্গে বাস করতে । আর এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছেন বর্ধমানের গাছ বাবা ।
পালিতপুরের গ্রামে এখন সুন্দর সাজানো সংসার তাঁর । গাছের মাথায় সাপ বা গা দিয়ে বেয়ে আসা পিঁপড়েরা তাঁর বন্ধু । তাঁর কথা জানেন গ্রামের সবাই । অনেকে বলেন, তিনি সুস্থ নয় । অনেকে আবার বলেন এইভাবেই তো দেখছি বহুবছর ধরে তাঁকে । আছেন তো বেশ । প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে আজ আর ক'জনই বা পারে ।
গ্রামবাসী সুধীর রায় বলেন, "তাঁর স্ত্রী মারা যাওয়ার পরই মনমরা হয়ে যান লোকু । কাজ করতেও যেতেন না । সারাদিন বাঁশের বনে মনখারাপ করে বসে থাকতেন । মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, ছেলে বাইরে কাজ করে । ঘর ভেঙে গেছে । তাই এই বাঁশ গাছেই নিজের ছোট্ট কুটির বানিয়ে তুলেছেন তিনি ।"
আর এবিষয়ে লোকু রায় কী বলছেন ? লোকু রায়ের মতে, এই নির্জন জায়গায় ঘর তৈরির জন্য আমার কাছে টাকা পয়সা ছিল না । এছাড়া বাঁশের ঝাড়ের পাশ দিয়ে ক্যানেলের জল বয়ে যাচ্ছে । সেই কারণে বাঁশ গাছের উপরেই ঘর বানিয়ে থাকি । সেই গাছে সাপ থাকলেও কিছু করে না আমাকে । আমরা সবাই মিলেমিশে থাকি ।সকাল হলেই ক্যানেলের জলে স্নান সেরে মাঠের কাছে বেরিয়ে পড়ি ।
সারাদিন কাজ শেষে কোথাও দু'মুঠো ভাত খেয়ে মাঠের আল ধরে ঘরে ফেরেন তিনি । আর তাঁর অপেক্ষায় বসে থাকেন সাপ-পাখি-কাঠবেড়ালিরা ।