বর্ধমান, 6 জুন : কাটার পর মাঠেই স্তূপ করে রাখা ধান। আগে কাটা ধান ঘরে তুলতে না পারলে রাতের অন্ধকারে মাঠ ফাঁকা হয়ে যেত । এখন সেসবের বালাই নেই । কারণ এই ধান কেউ চুরি করবে না । ধানে ছোটো ছোটো কল বের হতে শুরু করেছে । ফলে ধান কাটার পর রাইস মিলে নিয়ে গেলেও মালিকরা ধান কিনতে চাইছেন না । এই ছবি পূর্ব বর্ধমানের গলসি, রায়না, খণ্ডঘোষ , আউশগ্রাম, মন্তেশ্বর সহ বিভিন্ন এলাকার । চাষিরা জানাচ্ছেন, ধানের প্রচুর ক্ষতি হয়েছে । সরকার যদি ক্ষতিপূরণ না দেয় সেক্ষেত্রে তাঁদের আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনও উপায় থাকবে না । এদিকে জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, লকডাউন ও আমফান মিলিয়ে ধানের যা ক্ষতি হয়েছে তার মূল্য প্রায় 300 কোটি টাকা।
লকডাউনে ধান কাটতে গিয়ে চরম সমস্যায় পড়েছিলেন পূর্ব বর্ধমান জেলার চাষিরা । প্রতি বছর ধান কাটার মরশুমে ভিন জেলা, ভিন রাজ্য থেকে শ্রমিকরা ধান কাটার কাজে জেলায় চলে আসেন । কিন্তু এবার সেই চেনা ছবি নেই। লকডাউনের জেরে যান চলাচল বন্ধ ছিল। আসতে পারেননি শ্রমিকরা । এই অবস্থায় হারভেস্টার মেশিন ভাড়া করে অনেকে ধান কেটেছেন । যেখানে ঘণ্টাপ্রতি ভাড়া গুনতে হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা করে । ধান চাষিরা ঘণ্টাপ্রতি পাঁচ হাজার টাকার কথা ভাবতে পারেন কি ? অতি কষ্টে ধান কাটার কাজ শেষ করেছিলেন । কিন্তু ধান কাটার পর সেই ধান মাঠ থেকে তোলার আগেই আসে আমফান । ফলে, কেটে রাখা বেশিরভাগ ধান নষ্ট হয়ে যায় । শুধু তাই নয়, আমফানের পরেও পরপর বৃষ্টিপাতের জেরে ধানের জমিতে জল জমতে শুরু করে । সেই ধান চাষিরা ঘরে তুলতে পারেননি । যেটুকু ধান তাঁরা হাতে পেয়েছেন তাতে সাদা সাদা কল বেরোতে শুরু করেছে । ফলে রাইস মিলগুলি সেই ধান কিনতে চাইছে না । এদিকে চাষিদের মধ্যে কেউ ঋণ নিয়ে কিংবা সোনা বন্ধক রেখে ঋণ নিয়ে ধান চাষ করেছেন । ফলে, কীভাবে ঋণ শোধ করে সোনা বাড়িতে ফিরিয়ে আনবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না ।
ধান কাটার সমস্যা মেটাতে উদ্যোগী হয়েছিল পূর্ব বর্ধমান জেলা প্রশাসন । ভিন জেলা থেকে কিংবা জেলা থেকেই শ্রমিকরা যাতে ধান কাটতে আসতে পারেন তাই লকডাউনে কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়েছিল । কিন্তু, ঘূর্ণিঝড় আমফানের আগে তাড়াতাড়ি ধান কাটার জন্য হারভেস্টার মেশিনের সাহায্যে চাষিরা ধান কাটতে শুরু করেন । বিঘা প্রতি ঘণ্টায় পাঁচ হাজার টাকা করে দিতে হয় চাষিদের । এদিকে ধান কাটার পর তা ঘরে তোলার আগে আমফানের জেরে বেশিরভাগ ধান জলের তলায় চলে যায় । সেখান থেকে ধান তোলার জন্য শ্রমিকদের বাড়তি মজুরি দিতে হয় । এর মধ্যে ঘন ঘন বৃষ্টিপাতের জেরে বাকি ধানও নষ্ট হয়ে যায় ।
জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর , পূর্ব বর্ধমান জেলায় 42 হাজার হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে । ক্ষতির পরিমাণ প্রায় 300 কোটি টাকা । জেলার 23 টি ব্লকের মধ্যে 10টি ব্লকে বেশি ক্ষতি হয়েছে । এই বছরে জেলায় 1 লাখ 64 হাজার 205 হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ করা হয়েছিল । বেশিরভাগ জমির ধান কাটা হয়ে গিয়েছিল । বহু জায়গায় ধান কাটা অবস্থায় মাঠেই পড়ে ছিল । আমফানের দাপটে সেই ধান নষ্ট হয়ে যায় । বিভিন্ন এলাকায় চাষিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে । সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বর্ধমান 1 ও 2 , গলসি 1 ও 2, আউশগ্রাম 1 ও 2, কালনা 1 ব্লক, ভাতার , মঙ্গলকোট ও মন্তেশ্বর ব্লকে ।
গলসি এলাকার ধান চাষি ভরত মিত্র বলেন, "ঘূর্ণিঝড় আমফানের জেরে ও পরে বারবার বৃষ্টি হওয়ায় ধান নষ্ট হয়ে গেছে । সেই ধান ঘরে তোলা যাচ্ছে না । আর ওই ধান কেউ চুরিও করে নিয়ে যাবে না । অথচ ধান কাটতে বিঘা প্রতি ঘণ্টায় পাঁচ হাজার টাকা করে খরচ হয়েছে । ক্ষতিপূরণ না পেলে অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে । "
চাষি শেখ গুলজার হোসেন বলেন, "কৃষিঋণ নিয়ে ধান চাষ করেছি । এছাড়া ঘরে থাকা সোনা বন্ধক রেখে 52 হাজার টাকা ধার নিয়েছি । এদিকে ঘণ্টায় পাঁচ হাজার টাকার মজুরিতে কাটা ধান নষ্ট হয়ে গেছে । এখন ধার শোধ করব নাকি সোনা ছাড়াব । ক্ষতিপূরণ না পেলে আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনও উপায় থাকবে না ।"
পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদের কৃষি কর্মাধ্যক্ষ শেখ মহম্মদ ইসমাইল বলেন, " চাষিদের তালিকা তৈরি করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে । যেসব চাষি ক্ষতিপূরণ পাননি তাঁদের তালিকা নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে । যাতে কেউ ক্ষতিপূরণ পাওয়া থেকে বাদ না যান সেইভাবেই কাজ করা হচ্ছে ।"