কালনা, 24 অগাস্ট : প্রায় আড়াই মাস বন্ধ ছিল তাঁত । ভিন জেলা থেকে যাঁরা কাজ করতে এসেছিলেন তাঁরাও ফিরে গেছেন । একদিকে লকডাউন অন্যদিকে পাওয়ার লুমের সস্তার শাড়ির সঙ্গে লড়াই । এই দুইয়ের মুখে পড়ে রীতিমতো সমস্যায় পূর্ব বর্ধমানের জামদানি শাড়ি তৈরির সঙ্গে যুক্ত শিল্পীরা।
জামদানি শাড়ির জন্য পূর্ব বর্ধমান জেলার কালনা, পূর্বস্থলী, ধাত্রীগ্রামের নাম সবাই জানে । রীতিমতো অর্ডার আসে কলকাতা, আসানসোল, বর্ধমান, দুর্গাপুর সহ অন্যান্য শহর থেকে । উত্তরবঙ্গ থেকে হাজার হাজার তাঁত শ্রমিক আসতেন কালনা মহকুমাতে । জামদানির পাশাপাশি বালুচরি, টাঙ্গাইল, তসর সহ অন্যান্য শাড়ির জোগান দিতে হিমশিম খেতেন তাঁত শিল্পীরা । এবার লকডাউনের জেরে সব শেষ । তবে সরকারি তরফে এই পরিস্থিতিতেও সপ্তাহে দু'দিন হাটের ব্যবস্থা করায় কিছুটা হলেও রোজগার হচ্ছে তাঁতশিল্পীদের ।
দুর্গাপুজোর অষ্টমীতে অঞ্জলি দেওয়া হোক কিংবা দশমীতে সিঁদুর খেলা । এইসব বিশেষ বিশেষ দিনে বাঙালির কাছে তাঁতের শাড়ির কোনও বিকল্প নেই । আর যদি সেই তাঁত জামদানি হয় তাহলে তো কথাই নেই । ক্রেতার চাহিদা পূরণ করতে পূর্ব বর্ধমান জেলার কালনা, সমুদ্রগড় ,ধাত্রীগ্রাম ,পূর্বস্থলী সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় তাঁতিপাড়ায় দিনরাত শোনা যেত খট খট খট খট তাঁতের শব্দ । একটা সময় পূর্ববঙ্গ থেকে হাজার হাজার মানুষ কালনা, ধাত্রীগ্রাম ,সমুদ্রগড়, পূর্বস্থলী, শ্রীরামপুর সহ বিভিন্ন এলাকায় এসে ঘর বেঁধেছিলেন । নদীমাতৃক এলাকা হওয়ায় ধান চাষ, পাট চাষের পর তাঁরা জোর দিয়েছিলেন তাঁতের উপর । চাষের পাশাপাশি তাঁরা এখানে গড়ে তোলেন তাঁত শিল্প ।
পাওয়ার লুমের সস্তার শাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতার বাজারে এঁটে উঠতে পারছে না জামদানি কালনা মহকুমা জুড়ে প্রায় 50 হাজার তাঁত রয়েছে । ওই সব তাঁতের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় দু'লাখ মানুষ নির্ভরশীল । প্রথম প্রথম তাঁত বোনার জন্য গর্ত বিহীন কাঠের ফ্রেম ব্যবহার করা হলেও পরে হাতে টানা তাঁত যন্ত্র বসানো হয় । ফলে শাড়ির রঙের পরিবর্তন করা সহজ হয় । তাঁতে জামদানি, টাঙ্গাইল, বালুচরি, তসর সহ একাধিক তাঁতের শাড়ি তৈরি হলেও জামদানি শাড়ির দাম সবচেয়ে বেশি । কারণ ওই শাড়ির তৈরির খরচ বেশি । সময়ও ব্যয় হয় অনেকটা। এক একটি জামদানি বুনতে সময় লেগে যায় দু'তিনদিন । বর্তমানে লকডাউনের জেরে এমনিতেই প্রথম দিকে প্রায় আড়াই মাস তাঁত বন্ধ ছিল । উত্তরবঙ্গ সহ ভিন রাজ্য থেকে আসা তাঁত শ্রমিকরা তাঁত শিল্পীদের ঘরেই আটকে ছিলেন । পরে সরকারি উদ্যোগে তাঁরা বাড়ি ফিরে যান । এদিকে শ্রমিক না থাকায় অনেক তাঁত বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে । যে তাঁতগুলিতে কাপড় বোনা হচ্ছে সেখানে আর জামদানি বোনা হচ্ছে না । কারণ চাহিদা নেই ।সরকারি উদ্যোগে কালনার ধাত্রীগ্রাম ও শ্রীরামপুরে তাঁত হাটের ব্যবস্থা করা হয়েছে । সেই হাটে এখন যেসব ক্রেতা আসছেন তারা কম দামি তাঁতের শাড়ি খুঁজছেন । ফলে জামদানির চাহিদা কমছে । অন্যদিকে পাওয়ার লুমের তৈরি কম দামের শৌখিন শাড়িতে বাজার ছেয়ে গেছে । এই পরিস্থিতিতে জামদানি শাড়ি প্রতিযোগিতার বাজারে এঁটে উঠতে পারছে না ।
লকডাউন ঘোষণার পর থেকেই কদর কমেছে জামদানির তাঁতিদের মতে, পাওয়ার লুমে যেখানে দিনে দু'টি শাড়ি বোনা যায় সেখানে একটি জামদানি শাড়ি বুনতে প্রায় দুই দিন লেগে যায় । যে শাড়ি তৈরি করতে মজুরি বেশি পড়ে সেই শাড়ির দামও বেশি হয় । স্বাভাবিকভাবেই জামদানি শাড়ির দাম অন্যান্য শাড়ির চেয়ে তুলনামূলক অনেকটাই বেশি । সেই তুলনায় পাওয়ার লুমের শাড়ি অনেক বেশি শৌখিন । ফলে ক্রেতারাও আকৃষ্ট হচ্ছে সেই দিকে । শিল্পীদের মতে, সরকারি তরফে সাহায্য যে একেবারেই মেলেনি তা নয় । সরকারি তরফে তাঁতি সাথী প্রকল্পে বেশ কয়েকজনকে তাঁত দেওয়া হয়েছিল । তবে তা পর্যাপ্ত নয় বলে জানা গেছে । তাঁতের বাজারের ক্ষেত্রে সঠিক প্রচারের অভাব রয়েছে বলে মনে করছেন তাঁত মালিকরা ।কালনা ব্লকের ধাত্রীগ্রামের তাঁত শিল্পী কৃষ্ণচন্দ্র বসাক বলেন, "বর্তমানে তাঁত শিল্পীদের অবস্থা খুবই খারাপ । এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে নোট বাতিল, GST-র পর থেকে । এরপর লকডাউনের জেরে অবস্থা আরও তলানিতে । সরকারি উদ্যোগে যে তাঁতের হাট করা হয়েছে সেখানে কম দামের তাঁতের শাড়ি বিক্রি করে দু'বেলা ভাতের সংস্থান হচ্ছে । এই মুহূর্তে শাড়ি নয় দামটাই বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনিতেই ক্রেতা নেই । তাই জামদানি শাড়ির কদর নেই । ক্রেতা এখন কম দামি শাড়ির খোঁজ করছে । লকডাউনে মানুষের হাতে টাকা-পয়সা নেই । সেই সঙ্গে বাজারে এখন কম দামি বাংলাদেশি ও পাওয়ার লুমের শাড়ি খুব চাহিদা । ফলে ক্রেতারা সেই শাড়ি কিনছে । বাজার হারাচ্ছে জামদানি শাড়ি ।"তাঁত শিল্পী রাজেন বসাক বলেন, "বর্তমানে তাঁত শিল্পীদের পরিস্থিতি খুব খারাপ । কম দামের শাড়ি বুনে এখন হাটে বিক্রি করতে হচ্ছে । ক্রেতা আসছে না । দু'একটা কাপড় বুনছি । অনেক কষ্ট করে চলছে । জামদানি শাড়ি তৈরির খরচ এত বেশি যে সেই শাড়ি বুনে লাভ হচ্ছে না । তাই কম দামি শাড়ি বুনতে হচ্ছে । "তাঁত শিল্পী গোপীনাথ বসাকের মতে, "অবস্থা খুব খারাপ । বাজারে খদ্দের নেই । আগে যে দামে কাপড় বিক্রি হচ্ছিল সেই দাম তো পাওয়াই যাচ্ছে না । অন্যদিকে পাওয়ার লুমের বাজার হওয়ায় প্রতিযোগিতায় জামদানি হারিয়ে যাচ্ছে । আগে শাড়ি বুনতে যে খরচ হত সেই দামেই এখন বিক্রি করতে হচ্ছে । "পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদের সহ সভাধিপতি দেবু টুডুকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, "এই পরিস্থিতিতে সরকার তাঁত শিল্পীদের পাশে দাঁড়িয়েছে । তাদের জন্য হাটের ব্যবস্থা করা হয়েছে । তাদের কাছ থেকে সরকার শাড়ি কিনছে ।"