কালনা, 10 অগস্ট: চারিদিকে গাছগাছালি দিয়ে ঘেরা একটা মঠ । নাম জ্ঞানানন্দ মঠ । পূর্ব বর্ধমানের কালনা শহরের এই মঠকে বাইরে থেকে আপাতদৃষ্টিতে দেখলে সাধারণ বলে মনে হবে । কিন্তু এই মঠ স্বাধীনতা সংগ্রামের সাক্ষী ৷ এক সময় এই মঠই ছিল বিপ্লবীদের গোপন আস্তানা ৷ এখান থেকেই চলতো তাঁদের শলা-পরামর্শ । এখানে যাতায়াত ছিল নেতাজি থেকে মাস্টারদা সূর্য সেনেরও ।
এই মঠ তৈরি করেছিলেন স্বামী নিত্য গৌরবানন্দ অবধূত মহারাজ ৷ বর্তমানে আশ্রমের মহারাজ নিত্য প্রেমানন্দ অবধূত বলেন, ‘‘1930 সালের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে মাস্টারদার সহযোগী ছিলেন উপেন্দ্রনাথ পাল ৷ যিনি পরবর্তীকালে গৌরবানন্দ অবধূত মহারাজ হিসেবে পরিচিত হন ।’’ তিনি কালনা শহরে গড়ে তোলেন জ্ঞানানন্দ মঠ ।
উপেন্দ্রনাথ পাল থেকে স্বামী নিত্য গৌরবানন্দ অবধূত মহারাজ: 1889 সালে বাংলাদের বরিশালে জন্ম উপেন্দ্রনাথ পালের । বরিশালে স্কুল জীবন শেষ করে তিনি কলকাতার একটা কলেজে ভরতি হন । মাত্র 20 বছর বয়সে উপেন্দ্রনাথ পাল উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় এসেছিলেন । সেখানে তিনি ছিলেন অ্যাকাউন্টান্সির ছাত্র ।
যেহেতু তাঁর জন্ম হয়েছিল পূর্ববঙ্গের বরিশাল জেলায়, তাই তাঁর সঙ্গে প্রথম থেকেই যোগাযোগ ছিল মাস্টারদা সূর্য সেনের । মাস্টারদার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে মাস্টারদার সহযোগী হিসেবে অংশ নেন । তাই কলকাতায় এসেও দেশসেবা করার জন্য তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন । পরে বিপ্লবী চিন্তাহরণ মুখোপাধ্যায়, শরৎ পালেদের মাধ্যমে হুগলির চক বাজারে নিত্যানন্দ মঠে যান । সেখানে স্বামী নিত্যগোপাল মহারাজের হাত ধরে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন । উপেন্দ্রনাথ পাল হয়ে ওঠেন স্বামী নিত্যানন্দ অবধূত মহারাজ ।
আরও পড়ুন: মাস্টারদা'র সহযোগী অনুরূপ চন্দ্র সেনকে ভুলতে বসেছে বুড়ুল গ্রাম
কীভাবে জ্ঞানানন্দ মঠ গড়ে উঠল: স্বামী নিত্য গৌরবানন্দ অবধূত মহারাজের অন্যতম শিষ্যা ছিলেন সুশীলাদেবী । সেই সুশীলাদেবীর অনুরোধে কালনায় আসেন বিপ্লবী উপেন্দ্রনাথ । কালনা তখন ঘন জঙ্গলে ঘেরা । সুশীলাদেবী তাঁকে আশ্রম তৈরির জন্য কালনায় একটা জায়গা দান করেন । গড়ে ওঠে জ্ঞানানন্দ মঠ । সেই মঠ থেকেই চলতে থাকে বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ ।
যে মঠ হয়ে উঠেছিল বিপ্লবীদের গোপন আস্তানা । সেই মঠে আসতেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু থেকে মাস্টারদা সূর্য সেন-সহ আরও অনেকে । সেই মঠে আজও রয়েছে সুভাষচন্দ্রের ব্যবহৃত বেশ কিছু জিনিসপত্র । যা যত্নের সঙ্গে রক্ষা করছেন আশ্রমের মহারাজেরা ।
মঠের সঙ্গে নেতাজি-মাস্টারদার যোগাযোগ: ওই আশ্রমে আসতেন মাস্টারদা সূর্য সেন-সহ অন্যান্য বিপ্লবীরাও । ওই আশ্রম বিপ্লবীদের গোপন আস্তানা গড়ে ওঠে । সেখানে রাতে বসতো বিপ্লবীদের গোপন বৈঠক । মাস্টারদার সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র ধরেই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে উপেন্দ্রনাথ পালের পরিচয় হয় । তিনি যখন জ্ঞানানন্দ মঠ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই মঠ তখন বিপ্লবীদের আখড়া হয়ে উঠেছিল ।
সেখানে এসে তাঁদের পরামর্শ দিয়ে যেতেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু । সেখানে রাত্রিবাসও করেছেন নেতাজি । সুভাষচন্দ্র যে চেয়ারে বসতেন, যে খাটে রাতে শুতেন, সেই চেয়ার-খাট আজও যত্নের সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণ করছেন আশ্রমের মহারাজেরা ।
আরও পড়ুন: দীপ্ত চোখে স্বাধীনতার স্বপ্ন, 21-এ ফাঁসির মঞ্চে রামকৃষ্ণ বিশ্বাস
স্বাধীনতা সংগ্রামে স্বামী নিত্য গৌরবানন্দ অবধূত মহারাজের অংশগ্রহণ: বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ-এর সন্ন্যাসীগণ বন্দেমাতরম মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশমাতৃকাকে দেবীর আসনে বসিয়েছিলেন । সন্ন্যাসীদের আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ছিল সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ । বর্ধমান জেলায় যেসব সন্ন্যাসীদের নাম স্বাধীনতা সংগ্রামে উঠে আসে, তাঁদের মধ্যে গৌরবানন্দ অবধূত মহারাজ অন্যতম ।
বর্তমানে আশ্রমের মহারাজ নিত্য প্রেমানন্দ অবধূত আক্ষেপ করে বলেন, ‘‘যে মঠ একদিন ভারতকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিল সেই মঠের পরিকাঠামো দিনে দিনে ভেঙে পড়ছে ।’’ যদিও তাঁর পরিকল্পনায় আছে ওই মঠে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের স্মৃতি বিজড়িত মিউজিয়াম, পরীক্ষার্থীদের পড়াশোনা শেখানো-সহ অন্যান্য শিক্ষামূলক ব্যবস্থা করার । কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে তাঁরা কোনও কাজই করতে পারছেন না ।
ইতিমধ্যেই তাঁরা রাজ্যের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথের কাছে সরকারি সাহায্যের জন্য আবেদন করেছেন । সরকার যদি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় তাহলে এই মঠ নতুন করে ছাত্রছাত্রীদের পথ দেখাবে এমনটাই আশা মহারাজদের ।
আরও পড়ুন: নেতাজির প্রথম মূর্তি ও তার নেপথ্য কাহিনি