বর্ধমান, 21 ডিসেম্বর : একদিকে মাঝে মধ্যেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ ৷ সেইসঙ্গে পোকার আক্রমণে ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়া চাষিদের ক্ষেত্রে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে । সোনাদানা বন্ধক রেখে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে চাষ করতে হচ্ছে ৷ তাই ফসলের ক্ষতি হলে পড়তে হয় ভারী বিপদে ৷ যদিও সরকারের দাবি, সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা রাজ্যের প্রতিটি কৃষক পান ৷ ফসলের ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণ বাবদ টাকা সমেত শস্যবীমাও করিয়ে দেওয়া হয় তাঁদের ৷ এরপরও দেখা যাচ্ছে, পূর্ব বর্ধমান জেলায় কৃষক আত্মহত্যা ঘটনা ঘটছে, যা নিয়ে চিন্তিত প্রশাসনও (Increasing Farmer Suicides in Purba Bardhaman) ।
গত সপ্তাহেই পূর্ব বর্ধমান জেলায় দু'জন চাষি আত্মঘাতী হয়েছেন । এঁদের মধ্যে একজন মানিক শেখ । তাঁর পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, চড়া সুদে ঋণ নিয়ে 10 থেকে 12 বিঘা জমিতে তিনি আলু চাষ করেছিলেন । গত কয়েক দিনের নিম্নচাপের ফলে প্রচণ্ড বৃষ্টিতে সমস্ত জমি জলের তলায় চলে যায় । আলু গাছ নষ্ট হয়ে যায় । এদিকে যেহেতু তিনি ঋণ নিয়ে চাষ করেছিলেন সেই টাকা কীভাবে শোধ দেবেন তা নিয়ে তিনি চিন্তায় পড়েন । এরপর সেই চাপ সহ্য করতে না পেরে তিনি গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন ।
অন্যদিকে ধান ও আলুচাষে ক্ষতি হওয়ায় গত দু'দিন আগে মানসিক অবসাদে আত্মঘাতী হয়েছেন গণেশ নারায়ণ ঘোষ নামে এক চাষি । তাঁর বাড়ি বর্ধমান রায়না থানার হিজলনা এলাকায় । তাঁর পরিবারের দাবি, প্রায় 5 বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছিলেন গণেশ । এছাড়া বেশকিছুটা জমিতে আলু চাষ করেছিলেন । নিম্নচাপের জেরে যে বৃষ্টিপাত হয়েছিল, পূর্ব বর্ধমান জেলার মধ্যে রায়নায় সেই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল বেশি । ফলে আলু এবং ধান জলের তলায় চলে যায় । গণেশও বাজার থেকে ধার নিয়ে ধান আলু চাষ করেছিলেন । বাড়িতে রয়েছেন অসুস্থ স্ত্রী ও মা । তাঁদের ওষুধ কিনতে প্রতি মাসে অনেক টাকা খরচ হয় । কীভাবে তিনি সংসার চালাবেন তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান । এরপর তিনি আত্মঘাতী হন ।
কিন্তু কেন বাড়ছে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ? জেলা কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুযোগ-সুবিধা ছাড়াও কোনও চাষি ক্ষতির মুখে পড়লে তাঁদের যেমন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় সেইসঙ্গে শস্য বীমাও করিয়ে দেওয়া হয় । এরপরেও কৃষকরা কেন আত্মঘাতী হচ্ছে সেই বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছে প্রশাসন ।
যদিও কৃষকদের অভিযোগ, দিন দিন চাষের খরচ বেড়ে চলেছে । দাম বাড়ছে সারেরও । এছাড়া প্রতি বছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি পোকার আক্রমণে ধান, আলু-সহ অন্যান্য ফসল নষ্ট হচ্ছে । সরকার থেকে যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় তা খুবই কম । ফলে সেই ক্ষতিপূরণ পেয়ে কাজের কাজ কিছুই হয় না । এদিকে কেউ সোনা বন্ধক রেখে, আবার কেউ বাজার থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে চাষ করতে বাধ্য হন । কিন্তু ফসলের দাম না পাওয়ায় সেই টাকা শোধ করতে পারেন না । সেই চাপ সহ্য করতে না পেরেই অনেক চাষি আত্মহত্যা করছে ।
চাষি শেখ তোতন বলেন, ‘‘চলতি মরশুমে ধান চাষ করেছিলাম । নিম্নচাপের জেরে সমস্ত ধান নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সেই ধান ঘরে তুলতে পারিনি । এদিকে সেই সময় জমিতে আলু চাষ করতে শুরু করি । কিন্তু আলু জমি জলে ডুবে যাওয়ার আলু বীজও নষ্ট হয়ে যায় । আবার নতুন করে আলু চাষ করতে শুরু করেছি । দেরি করে আলু চাষ শুরু হওয়ায় আলুর ফলন অনেক কম হবে । এদিকে সরকারের তরফেও যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হল তা খুবই কম । তাতে চাষের কোন খরচই ওঠেনা । ফলে ক্ষতির মুখে পড়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে চাষিরা ।’’
আলু চাষি শেখ উজ্জ্বল বলেন, ‘‘এর আগে আলু বীজ বসিয়েছিলাম । কিন্তু প্রচুর বৃষ্টির কারণে সমস্ত জমি জলে ডুবে গিয়েছে । নতুন করে আবার আলু চাষ করতে শুরু করেছি । এক বিঘা জমিতে যে পরিমাণ ফলন পেতাম নতুন করে আলু চাষ করার ফলে সেই ফলন অর্ধেকেরও নিচে নেমে আসবে । অথচ আমরা কোন ক্ষতিপূরণও পাইনি ৷ সরকারের তরফেও যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় তা খুবই কম । এইভাবে কতদিন চাষবাস করা যাবে ? চাষি তো আত্মহত্যা করবেই ।’’
পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদের কৃষি কর্মাধ্যক্ষ মহম্মদ ইসমাইল বলেন, ‘‘বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুযোগসুবিধা কৃষকেরা তো হাতে পেয়েই থাকে । সেইসঙ্গে চাষে ক্ষতি হলে তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়, শস্য বীমা করে দেওয়া হয় । এরপরেও চাষিরা কেন আত্মহত্যা করছে, তা চাষের কারণেই নাকি অন্য কোনও কারণ আছে সেই সমস্ত বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে ।’’
আরও পড়ুন : Farmer suicide in Bardhaman : নিম্নচাপের বৃষ্টিতে চাষে বিপুল ক্ষতি, আত্মঘাতী কৃষক