পশ্চিম মেদিনীপুর, 11 জুলাই : মা দুর্গার আগমনে আর বেশি দেরি নেই ৷ প্রতিবছর এই সময়টাতে নাওয়া-খাওয়ার সময় থাকে না ঢাকি পাড়ায় ৷ তবে, এবছরে কোরোনা ভাইরাসের জেরে ঢাকি পাড়ার চিত্রটা একেবারেই অন্যরকম ৷ চেনা ছবির থেকে একেবারেই আলাদা ৷ ব্যস্ততার পরিবর্তে নিস্তব্দতার ছবি পশ্চিম মেদিনীপুরের ঢাকি পাড়ায় ৷
কোরোনা সংক্রমণের জেরে এবছর এক টাকাও বায়না হয়নি ৷ চিন্তায় পশ্চিম মেদিনীপুরের বাড়ুয়ার অন্তর্গত কালন্দী পাড়ার ঢাকিদের ৷ এই এলাকার 40টি ঘরের ঢাকির পরিবার ৷ পুজোর মরশুম আসার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যস্ততা বেড়ে যায় ঢাকি পাড়ায় ৷ গণেশ পুজো দিয়ে শুরু ৷ এরপর দুর্গাপুজো কালীপুজো, নিশ্বাস ফেলার সময় পাননা ঢাকিরা ৷ পাড়ি দেন ভিন রাজ্যেও ৷ প্রতিবছর, এই সময় বিভিন্ন সংগঠনের তরফে বায়না দেওয়া হয় ঢাকিদের ৷ মহারাষ্ট্র,দিল্লি,পুনে,কর্নাটক, ব্যাঙ্গালুরু-সহ বিভিন্ন রাজ্যে এই ঢাকিদের বেশ চাহিদা রয়েছে । তাই বাঙালিদের বারো মাসে তেরো পার্বণ শুরু হওয়ার আগেই ঢাকিরা তাঁর পরিবার পরিজন ছেড়ে পাড়ি দেয় ভিন রাজ্যে কাজের আশায় । তাই এই কয়েক মাস তাঁদের তাই ফুরসত থাকে না । তিন চার মাস এখানে কাজ করার পর তাঁরা ফিরে আসেন বাড়িতে ৷ এই কয়েকমাসে যে টাকা পান সেই টাকা দিয়েই তাঁরা বছরের বাকি সময় সংসার চালান । শুধু দুর্গাপুজো নয় ৷ সারা বছর ছোট বড়ো পুজো থেকে শুরু করে বিয়ে বাড়ি, অন্নপ্রাশন সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডাক পায় ঢাকিরা ৷
কিন্তু এ বছরের চিত্রটা একেবারেই ভিন্ন ৷ লকডাউন ও কোরোনা সংক্রমণের জেরে ঢাকিদের এখনও পর্যন্ত বায়না করেনি কেউ ৷ ভিন রাজ্য তো নয়ই, এমনকি জেলার কোনও পুজো সংগঠনের পক্ষ থেকেও ডাক পায়নি তাঁরা ৷ যার ফলে চরম সঙ্কটে দিন কাটাচ্ছেন ঢাকিরা ৷
এবিষয়ে ঢাকি অনিল কালন্দি বলেন, ''এই সময় আমরা বাড়িতে থাকার নয় । আমাদের ট্রেনের ভাড়া করে নিয়ে চলে যায় ভিন রাজ্যের মানুষজন । বাইরে বিশেষ করে বিরাট বড় উৎসব হয় গণেশ পূজো । সেই সময়ের আগে থেকেই আমরা ডাক পাই । পুনে, নাগপুর, মুম্বই, দিল্লি, অন্ধ্রপ্রদেশ বহু জায়গায় এবং সেখান থেকেই আমরা প্রায় পুজোর মরসুমে তিন-চার মাস কাটিয়ে দিই ৷ তাতে পকেটে জোটে মোটা অংকের টাকা । কিন্তু এবারে কোরোনার জেরে সব থমকে গেছে । পাইনি বায়না ।''
অপর ঢাকি রাজু কালন্দী বলেন, ''ঢাক বাজানো শিখেছি ছোটবেলা থেকে এবং শেখার দৌলতেই ভিন রাজ্যে থেকে ডাক আসে ৷ কিন্তু এবারে আর ডাক পেলাম না । তাই ঢাক বাড়ির ভেতরে রয়েছে বাইরে বের করিনি । আগামী দিনে কিভাবে চলবে সেই আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছি আমরা । বাঁশের জিনিসপত্র তৈরি করেছি কিন্তু বিক্রি করতে পারছি না কারণ কোনো গ্রামে আমাদের ঢুকতে দিচ্ছে না ।''
একই সুর ঢাকি শম্ভু ও নরেশ কালিন্দীর গলায় ৷ তাঁরা বলেন,''সরকারি সাহায্য বলতে চাল পেয়েছি রেশনে । তাই সেই চাল কোনোক্রমে ফুটিয়ে আলুভাতে খেয়ে দিন কাটাচ্ছি । কিন্তু এখন চলে গেলেও আগামী দিন কিভাবে চলবে সেই আশঙ্কা রয়েছি । মেলেনি আর কোনও সরকারি সাহায্য । এত বড় পরিবার কোথায় যাব কিভাবে চলবে সেই আশঙ্কা রয়েছে আমাদের । প্রথম প্রথম চাল ডাল অনেকে দু এক প্যাকেট দিয়ে গেছে তারপর সব বন্ধ । সরকার একটু নগদ যোগান দিলে সংসার চলবে । না হলে আগামী দিনে না খেতে পেয়ে মরতে হবে ।''
এমনই চিত্র গড়বেতা, কেশপুর, নেড়াদেউল, সালবনি, ধেড়ুয়া, গুড়গুড়ি, পালকেশিয়াড়ি, দাঁতন, পিংলা এলাকায় ৷ এই সমস্ত এলেকায় কমপক্ষে হাজার থেকে বারশো ঢাকির পরিবার রয়েছে ৷ ঢাক বাজিয়েই জীবন জীবিকা নির্বাহ করেন তাঁরা । কিন্তু এই লকডাউনের জেরে কপালে ভাঁজ পড়েছে তাঁদের ৷ লকডাউন কেটে গেলেও পরবর্তী সময় কাটাবেন কীভাবে? সে বিষয়ে সন্দীহান ঢাকিরা ৷