ETV Bharat / state

Husking Pedal: পৌষ পার্বণের আগে ঢেঁকিতে পা, কালের নিয়মে ফিকে বাংলার ঐতিহ্য

পৌষ পার্বণের আগে গ্রাম বাংলার হাতে গোনা কিছু বাড়িতেই চলে ঢেঁকি (Husking Pedal during Poush Parbon) ৷ খোঁজ নিল ইটিভি ভারত ৷

use of Husking Pedal during Poush Parbon in Malda and Paschim Medinipur
পৌষ পার্বণের প্রস্তুতি !
author img

By

Published : Jan 14, 2023, 6:08 PM IST

কালের নিয়মে ফিকে বাংলার ঐতিহ্য

মালদা ও চন্দ্রকোনা, 14 জানুয়ারি: বিজ্ঞান এগোচ্ছে ৷ আর পিছিয়ে পড়ছে বাংলার নানা প্রাচীন ঐতিহ্য ৷ একটা সময় ছিল, যখন পৌষ পার্বণের দিনগুলিতে নাওয়া খাওয়া মাথায় উঠত বাঙালি মেয়ে-বউদের ৷ শেষ রাত থেকে কানে আসত তাঁদের সমবেত টুসু গানের সুর ৷ সঙ্গে ধুপ ধাপ শব্দ ! লেপমুড়ি দিয়েই বোঝা যেত, ঢেঁকিতে চালের গুঁড়ো তৈরি করা হচ্ছে ৷ সেই চালের গুঁড়োর সঙ্গে নলেন গুড়ের মাখামাখিতে তৈরি হত হরেক কিসিমের পিঠে ৷ নিজেদের শীত পার্বণটা এভাবেই রসেবশে পালন করত আমবাঙালি !

সময়ের সঙ্গে বাঙালি হারিয়েছে অনেক কিছু ৷ তার মধ্যে রয়েছে তার সাধের ঢেঁকিও ! নারদের পৌরাণিক যান এখন কার্যত মিউজিয়ামে জায়গা খুঁজছে ! তার মধ্যেও কোনও কোনও জায়গায় প্রদীপের টিমটিমে শিখার মতো এখনও টিকে রয়েছে বাবলা কাঠের তৈরি প্রাচীন বাংলার এই গেরস্থালির যন্ত্র ৷ গ্রামাঞ্চলের পাশাপাশি কিছু কিছু শহরাঞ্চলেও দেখা মেলে তার ৷ পৌষের শেষ দিন এগিয়ে আসতেই সেই ঢেঁকিতে পা পড়েছে (Husking Pedal during Poush Parbon) ৷ সেই ছবিই ধরা পড়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার চন্দ্রকোনার রাইলা গ্রাম থেকে শুরু করে পুরাতন মালদা পৌরসভার 2 নম্বর ওয়ার্ডে ৷

আরও পড়ুন: মকর সংক্রান্তি রবিবার, বিশদে জেনে নিন ইতিহাস থেকে নির্ঘণ্ট

পুরাতন মালদা পৌরসভার নবাবগঞ্জের বাঁশহাটিতে বাড়ি নিতাই হালদারের ৷ এখন তাঁর পরিবারের মেয়ে-বউদের দম ফেলার সময় নেই ! চলছে ঢেঁকি, গুঁড়ো হচ্ছে চাল ৷ প্রস্তুতি চলছে পিঠে তৈরির ৷ গৃহকর্ত্রী কৃষ্ণা হালদার জানালেন, "পূর্বপুরুষের আমল থেকেই ঢেঁকিতে চালের গুঁড়ো তৈরি করে পৌষ পার্বণের পিঠে তৈরি হয় ৷ এখনও তাতে ছেদ পড়েনি ৷ আগে আমাদের বাড়ি ছিল বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে ৷ সেখানেও এভাবেই পিঠে তৈরি হত ৷ আগামিকাল অনেক ধরনের পিঠে তৈরি হবে ৷ সেই পুরোনো রীতি মেনে !"

ঢেঁকিতে পা দিতে দিতে পরিবারের আর এক সদস্য সরস্বতী জানালেন, "আমাদের পূর্বপুরুষদের আমল থেকেই বাড়িতে ঢেঁকি আছে ৷ এখন পৌষ পার্বণের পিঠে তৈরির জন্য চালের গুঁড়ো করছি ৷ আমার জন্ম এখানে ৷ কিন্তু মা-বাবা বাংলাদেশে ছিলেন ৷ পারিবারিক রীতি মেনে আগামিকাল আট থেকে দশ রকমের পিঠে তৈরি হবে ৷ আমরা প্রথমে দোকান থেকে চাল কিনে আনি ৷ সেই চাল ধুয়ে, ছেঁকে, শুকনো করার পর ঢেঁকিতে গুঁড়ো করি ৷ সেই গুঁড়োও চেলে নিতে হয় ৷ তারপর ওই গুঁড়ো দিয়ে তৈরি হয় নানারকমের পিঠে ৷"

বাঁশহাটির হালদার পরিবারের সঙ্গে ঢেঁকির মাহাত্ম্য সগৌরবে ধরে রেখেছে চন্দ্রকোনার রাইলা গ্রামের ঘোষ পরিবারও ৷ এই পরিবারের ঢেঁকি এখন গোটা গ্রামের ভরসা ! বস্তুত, এখন গোটা গ্রাম ভিড় করেছে এই বাড়িতে ৷ তাঁদের বাড়িতেও তো পিঠে তৈরি হবে ! তাই চালের গুঁড়োটা ঘোষেদের ঘর থেকেই করে নিয়ে যান তাঁরা ! কারণ, গ্রামে আর কোনও বাড়িতে আজ আর ঢেঁকি নেই ৷

মানুষের ভিড়ে এখন সরগরম রাইলা গ্রামের গোপাল ঘোষের বাড়ি ৷ চার পুরুষের পুরোনো ঢেঁকিটা এখনও তিনি রেখে দিয়েছেন সযত্নে ৷ পৌষ পার্বণের কয়েক দিন আগেই সেই ঢেঁকি ধুয়ে, মুছে পরিষ্কার করা হয় ৷ শুরু হয়ে যায় চাল কোটা ৷ ঘোষ পরিবারের সদস্য থেকে গ্রামবাসী, সকলেরই এক কথা, মেশিনের চালগুঁড়ো থেকে পিঠে তৈরি হয় বটে ৷ কিন্তু তাতে সেই স্বাদ কোথায় ! ঢেঁকিকোটা চালগুঁড়োয় তৈরি পিঠের স্বাদই আলাদা ! তাই পৌষের শেষ এলেই সবাই চলে আসেন এই বাড়িতে ৷

যুগ বদলের সঙ্গে বাঙালি হারিয়েছে বিজয়া দশমীর ঘরে তৈরি মোয়া-নাড়ু, লক্ষ্মীপুজোর মুড়কি থেকে শুরু করে আরও অনেক কিছুই ৷ এবার হারিয়ে যাওয়ার পথে পা রেখেছে পৌষ পার্বণের ঢেঁকিও ৷ বিজ্ঞান এগিয়ে যাক, কিন্তু ঐতিহ্য যাতে নিশ্চিহ্ন না হয়ে যায়, সেদিকেও নজর রাখা প্রয়োজন ৷ হাতে সময় কিন্তু আর বেশি নেই !

কালের নিয়মে ফিকে বাংলার ঐতিহ্য

মালদা ও চন্দ্রকোনা, 14 জানুয়ারি: বিজ্ঞান এগোচ্ছে ৷ আর পিছিয়ে পড়ছে বাংলার নানা প্রাচীন ঐতিহ্য ৷ একটা সময় ছিল, যখন পৌষ পার্বণের দিনগুলিতে নাওয়া খাওয়া মাথায় উঠত বাঙালি মেয়ে-বউদের ৷ শেষ রাত থেকে কানে আসত তাঁদের সমবেত টুসু গানের সুর ৷ সঙ্গে ধুপ ধাপ শব্দ ! লেপমুড়ি দিয়েই বোঝা যেত, ঢেঁকিতে চালের গুঁড়ো তৈরি করা হচ্ছে ৷ সেই চালের গুঁড়োর সঙ্গে নলেন গুড়ের মাখামাখিতে তৈরি হত হরেক কিসিমের পিঠে ৷ নিজেদের শীত পার্বণটা এভাবেই রসেবশে পালন করত আমবাঙালি !

সময়ের সঙ্গে বাঙালি হারিয়েছে অনেক কিছু ৷ তার মধ্যে রয়েছে তার সাধের ঢেঁকিও ! নারদের পৌরাণিক যান এখন কার্যত মিউজিয়ামে জায়গা খুঁজছে ! তার মধ্যেও কোনও কোনও জায়গায় প্রদীপের টিমটিমে শিখার মতো এখনও টিকে রয়েছে বাবলা কাঠের তৈরি প্রাচীন বাংলার এই গেরস্থালির যন্ত্র ৷ গ্রামাঞ্চলের পাশাপাশি কিছু কিছু শহরাঞ্চলেও দেখা মেলে তার ৷ পৌষের শেষ দিন এগিয়ে আসতেই সেই ঢেঁকিতে পা পড়েছে (Husking Pedal during Poush Parbon) ৷ সেই ছবিই ধরা পড়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার চন্দ্রকোনার রাইলা গ্রাম থেকে শুরু করে পুরাতন মালদা পৌরসভার 2 নম্বর ওয়ার্ডে ৷

আরও পড়ুন: মকর সংক্রান্তি রবিবার, বিশদে জেনে নিন ইতিহাস থেকে নির্ঘণ্ট

পুরাতন মালদা পৌরসভার নবাবগঞ্জের বাঁশহাটিতে বাড়ি নিতাই হালদারের ৷ এখন তাঁর পরিবারের মেয়ে-বউদের দম ফেলার সময় নেই ! চলছে ঢেঁকি, গুঁড়ো হচ্ছে চাল ৷ প্রস্তুতি চলছে পিঠে তৈরির ৷ গৃহকর্ত্রী কৃষ্ণা হালদার জানালেন, "পূর্বপুরুষের আমল থেকেই ঢেঁকিতে চালের গুঁড়ো তৈরি করে পৌষ পার্বণের পিঠে তৈরি হয় ৷ এখনও তাতে ছেদ পড়েনি ৷ আগে আমাদের বাড়ি ছিল বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে ৷ সেখানেও এভাবেই পিঠে তৈরি হত ৷ আগামিকাল অনেক ধরনের পিঠে তৈরি হবে ৷ সেই পুরোনো রীতি মেনে !"

ঢেঁকিতে পা দিতে দিতে পরিবারের আর এক সদস্য সরস্বতী জানালেন, "আমাদের পূর্বপুরুষদের আমল থেকেই বাড়িতে ঢেঁকি আছে ৷ এখন পৌষ পার্বণের পিঠে তৈরির জন্য চালের গুঁড়ো করছি ৷ আমার জন্ম এখানে ৷ কিন্তু মা-বাবা বাংলাদেশে ছিলেন ৷ পারিবারিক রীতি মেনে আগামিকাল আট থেকে দশ রকমের পিঠে তৈরি হবে ৷ আমরা প্রথমে দোকান থেকে চাল কিনে আনি ৷ সেই চাল ধুয়ে, ছেঁকে, শুকনো করার পর ঢেঁকিতে গুঁড়ো করি ৷ সেই গুঁড়োও চেলে নিতে হয় ৷ তারপর ওই গুঁড়ো দিয়ে তৈরি হয় নানারকমের পিঠে ৷"

বাঁশহাটির হালদার পরিবারের সঙ্গে ঢেঁকির মাহাত্ম্য সগৌরবে ধরে রেখেছে চন্দ্রকোনার রাইলা গ্রামের ঘোষ পরিবারও ৷ এই পরিবারের ঢেঁকি এখন গোটা গ্রামের ভরসা ! বস্তুত, এখন গোটা গ্রাম ভিড় করেছে এই বাড়িতে ৷ তাঁদের বাড়িতেও তো পিঠে তৈরি হবে ! তাই চালের গুঁড়োটা ঘোষেদের ঘর থেকেই করে নিয়ে যান তাঁরা ! কারণ, গ্রামে আর কোনও বাড়িতে আজ আর ঢেঁকি নেই ৷

মানুষের ভিড়ে এখন সরগরম রাইলা গ্রামের গোপাল ঘোষের বাড়ি ৷ চার পুরুষের পুরোনো ঢেঁকিটা এখনও তিনি রেখে দিয়েছেন সযত্নে ৷ পৌষ পার্বণের কয়েক দিন আগেই সেই ঢেঁকি ধুয়ে, মুছে পরিষ্কার করা হয় ৷ শুরু হয়ে যায় চাল কোটা ৷ ঘোষ পরিবারের সদস্য থেকে গ্রামবাসী, সকলেরই এক কথা, মেশিনের চালগুঁড়ো থেকে পিঠে তৈরি হয় বটে ৷ কিন্তু তাতে সেই স্বাদ কোথায় ! ঢেঁকিকোটা চালগুঁড়োয় তৈরি পিঠের স্বাদই আলাদা ! তাই পৌষের শেষ এলেই সবাই চলে আসেন এই বাড়িতে ৷

যুগ বদলের সঙ্গে বাঙালি হারিয়েছে বিজয়া দশমীর ঘরে তৈরি মোয়া-নাড়ু, লক্ষ্মীপুজোর মুড়কি থেকে শুরু করে আরও অনেক কিছুই ৷ এবার হারিয়ে যাওয়ার পথে পা রেখেছে পৌষ পার্বণের ঢেঁকিও ৷ বিজ্ঞান এগিয়ে যাক, কিন্তু ঐতিহ্য যাতে নিশ্চিহ্ন না হয়ে যায়, সেদিকেও নজর রাখা প্রয়োজন ৷ হাতে সময় কিন্তু আর বেশি নেই !

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.