রামজীবনপুর, 3 মার্চ : খট খট খট খট ৷ পশ্চিম মেদিনীপুরের রামজীবনপুরে গেলেই কানে আসত এই শব্দ ৷ কিন্তু, এখন তা অতীত ৷ যে শ্রমিকরা তাঁত বোনার কারণে এক সময় দম ফেলার ফুরসত পেতেন না, সেই তাঁদেরই আজ কাজের অভাব ৷ বাড়িতে সেই পুরোনো তাঁতের কল রয়েছে, তবে কাজ নেই ৷ ফলে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে শ্রমিকদের ৷ পেট চালানোর একমাত্র মাধ্যম তাঁতের কল বসে যাওয়ায় শ্রমিকরা দিশেহারা ৷
চন্দ্রকোনা এক নং ব্লকের রামজীবনপুর পৌরসভার 3 নম্বর ওয়ার্ডের গনেশজননী পল্লি ৷ বলা চলে এই এলাকা এক সময় পরিচিত ছিল হাতে তৈরি তাঁতের হাব হিসেবে ৷ কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি বদলেছে ৷ বদলেছে প্রযুক্তিও ৷ বাজারে এসছে নতুন ধরনের মেশিন ৷ সেইসব মেশিনে কম সময়ে, কম খরচে তাঁত বোনা যাচ্ছে সহজেই ৷ বোনা যাচ্ছে অন্য ফ্যান্সি শাড়িও ৷ তাই কলের সাহায্যে তাঁত বোনাও প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে ৷ বাজারে নিত্য নতুন শাড়ি আসছে ৷ কম দামে মিলছে সেইসব শাড়ি ৷ পকেটের কথা ভেবে সেইসব শাড়ির দিকেই ঝুঁকছেন ক্রেতারা ৷ আর তাই চাহিদা কমেছে কলের সাহায্যে হাতে বোনা তাঁতের শাড়ির ৷ আর কাজ প্রায় নেই বললেই চলে ৷
কষ্টের মধ্যে দিয়েই দিন গুজরান করছেন রামজীবনপুরের তাঁত শিল্পীরা ৷ এক-আধটা শাড়ি বিক্রি করতে পারলেও তাতেও লাভ প্রায় নেই বললেই চলে ৷ দেড়-দু'দিন ধরে বাড়িতে জোড়া তাঁতের শাড়ি তৈরি করে মজুরি হিসেবে মহাজনের দয়ায় মিলছে মাত্র ৫০০-৫৫০ টাকা ৷ আগে পরিস্থিতিটা এরকম ছিল না ৷ ভালোই মজুরি পেতেন তাঁরা ৷ লাভও হত ৷ তাঁত শিল্পীদের অভিযোগ, সরকারি সাহায্যও মিলছে না ৷ বারবার আবেদন করা সত্ত্বেও সরকারের পক্ষ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না কোনওরকম আর্থিক সাহায্যও ৷ গুটি কয়েক কারিগরকে সরকারের দেওয়া মেশিন দেওয়া হয়েছে ৷ কয়েকবার মিলেছে অল্প আর্থিক সাহায্য ৷ কিন্তু তা সাময়িক ৷ অন্যদিকে রয়ছে আরও একটি সমস্যা ৷ এই কাজের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে নতুন প্রজন্ম ৷ এই শিল্পের সাথে যুক্ত হতে আগ্রহী নয় তারাও ৷ কারণ কঠোর পরিশ্রম, সময়সাধ্য ও লাভের পথ কমে যাওয়া ৷ শিল্পীদের কথায়, পরিকাঠামোগত উন্নয়ন হলে, সরকারি উদ্যোগে তাঁতের শাড়িকে বাজারজাত করার ব্যবস্থা হলে বাংলার এই তাঁত শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব ৷ না হলে হয়ত অচিরেই হারিয়ে যাবে এই শিল্প ৷
এক তাঁত শিল্পীর কথায়, "বাজারে অনেক ধরনের কম দামি ফ্যানসি শাড়ি এসে গেছে ৷ তাই হাতে বোনা তাঁতের শাড়ির চাহিদাও কমে গেছে ৷ আগের মতো বিক্রিও আর হয় না ৷ এই এলাকায় হাতে বোনা তাঁত শিল্পও আর আগের মতো নেই ৷ অনেকটাই কমে গেছে ৷ শুধুমাত্র কয়েকটি পরিবার তাঁদের বংশপরম্পায় এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন ৷ তাঁরাই টিঁকিয়ে রেখেছেন এই শিল্পকে ৷ কিন্তু নতুন প্রজন্ম মুখ ফেরাচ্ছে এই শিল্পের থেকে ৷ এই অবস্থায় সরকারি সাহায্যও মিলছে না ৷ একবার দু'বছর আগে সমিতির থেকে সামান্য কিছু আর্থিক সাহায্য মিলেছিল ৷ কিন্তু তারপর আর কিছু মেলেনি ৷" অন্য এক তাঁত শিল্পীর কথাও একই ৷ তিনি জানিয়েছেন, "চাহিদা অল্প-আদটু থাকলেও সেই অনুযায়ী মজুরি নেই ৷ বংশপরম্পরাতেই এই কাজ করছি ৷ বয়স হয়েছে ৷ লাভ না হলেও কিছু করারও নেই ৷ সরকারি সাহায্যও পাই না ৷"
অন্যদিকে এবার পৌর নির্বাচনে অন্যান্য ইশুর পাশাপাশি রামজীবনপুরের তাঁত শিল্পকে হাতিয়ার করে এগোতে চাইছে রামজীবনপুর মণ্ডল BJP ৷ রামজীবনপুর পৌরবোর্ডে ক্ষমতায় এলে তাঁত শিল্প পুনরুদ্ধার ও তাঁতিদের নিয়ে ভাবার কথা জানিয়েছেন BJP-র রামজীবনপুরের মণ্ডল সভাপতি নন্দ নিয়োগী ৷ তিনি বলেন, "নতুন প্রজন্ম তাঁত শিল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ৷ তার কারণ একটাই ৷ রাজ্যসরকারের উদাসীনতা ৷ রামজীবনপুরের চেয়ারম্যান নির্মল চৌধুরির উদাসীনতাও এর জন্যও দায়ী ৷ তাঁত শিল্পীরা সত্যিই খুব কষ্টের মধ্যে রয়েছেন ৷ আগে একটি সমিতি ছিল ৷ সেই সমিতিও বর্তমানে বন্ধ হয়ে গেছে ৷ আমি চাই সরকার শিল্পীদের নিয়ে চিন্তা ভাবনা করুক ৷ তাঁতিরা যাতে নূন্যতম সাহায্য পায় তার দিকে সরকার নজর দিক ৷ নন্দবাবুর অভিযোগ উড়িয়ে নির্মলবাবুর বক্তব্য, "রামজীবনপুরের তাঁত শিল্প দীর্ঘদিন ধরে খ্যাতির সঙ্গে, সুনামের সঙ্গে বজায় রয়েছে ৷ তাঁতিদের অবস্থা সত্যিই আর্থিকভাবে খারাপ ৷ তাঁদের আর্থিক অনুদান, তাঁত বোনার সুতো ও একটি ভালো বাজার তৈরি করে দেওয়া হলে তাঁরা মহাজন প্রথার বাইরে বেরিয়ে এসে নিজেদের তৈরি সামগ্রীগুলো বিক্রি করতে পারবেন ৷ তাঁতিদের পাশে রামজীবনপুর পৌরসভা ছিল ৷ আগামী দিনেও সরকারের সহযোগিতায় তাঁত শিল্পীদের আরও সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করব ৷"