গোটা শহরে চাপা উত্তেজনা । ইংরেজ আমল তায় বিপ্লবীদের গোপন আনাগোনা নিত্য ব্যাপার যখন, তখন পিন পড়লে যেখানে কান খাড়া হয়, সেখানে বোমা পড়ার খবরে কী হবে তা সহজেই অনুমেয়। রাত 9 টা বাজতে না বাজতেই ছোট্ট শহরে বেড়েছিল ভারী বুটের দাপাদাপি। কান ভারী হয়েছিল হুইসেলের তীব্র ফুঁয়ে। বন্ধ ঘর থেকেও অনুমান হচ্ছিল - গুরুগম্ভীর কিছু একটা হয়েছে। রাত যত বাড়ছিল, বাড়ছিল পুলিশি টহল। প্রত্যেকের দিকে সন্দেহজনক নজর পুলিশের । হেন কোনও রাস্তা ছিল না, যেখানে মোতায়েন ছিল না খাকি উর্দি। প্রহরা থেকে বাদ ছিল না রেল স্টেশনও। ঘন অন্ধকারের মতো গাঢ় ব্যস্ততায় যখন কার্যত মুড়ে যাচ্ছিল শহর, নিকষ কালোয় গা মিশিয়ে চুপিসাড়ে শহর ছাড়ার চেষ্টায় ছিলেন দু'জন। প্রফুল্ল চাকি আর ক্ষুদিরাম বসু। বিপ্লবী অপারেশনের সময় যাঁদের গুপ্তনাম ছিল দীনেশচন্দ্র রায় এবং হরেন সরকার।
খানিকদূর এগিয়ে রাস্তা বদল করেন দু'জন। জানা ছিল না, রাস্তা আর কখনও মিলবে কি না। জানা ছিল না, মিলবেন কি না আর কখনও । শুধু জানতেন, পুলিশ খুঁজছে তাঁদের। নিয়তিও ছিল জানা।
প্রফুল্ল চাকি তখন সঙ্গ ছেড়ে গিয়েছেন অনেকটা দূরে। হাঁটছেন ক্ষুদিরাম। জানতেন, পুলিশ ওৎ পেতে থাকবে কাছাকাছি স্টেশনে। তাই সিদ্ধান্ত নেন ট্রেনে চাপবেন না তখনই। হাঁটতে থাকেন রাস্তা ধরে। অন্ধকারে। সারারাত হাঁটার পর রাস্তা যখন পেরিয়ে এসেছে প্রায় 25 মাইল, একটা স্টেশন নজরে পড়ে ক্ষুদিরাম বসুর। ওয়াইনি। ক্লান্ত-শ্রান্ত। ছাতি ফাটছে তেষ্টায়। ...একগ্লাস জল, স্থানীয় দোকানে যখন চাইছেন ক্ষুদিরাম, পাশাপাশি দু'একজনের চোখে পড়ে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, খালি পায়ে থাকা কিশোরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দু'জন পুলিশ।
কে ? কোথা থেকে আসা হচ্ছে ? --- এহেন দু'-একটি প্রশ্নের জবাবেই সন্দেহজনক কিছু খুঁজে পেয়েছিল ইংরেজ পুলিশ। তবে গ্রেপ্তার না কি নয়, সে প্রশ্নে দ্বিধায় ছিল তারা। তখন ঘটেছিল সেই ঘটনাটি--- যা কার্যত নিশ্চিত করে দিয়েছিল ক্ষুদিরাম বসুর ভবিষ্যৎ। আচমকা রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল লুকোনো রিভলভার। 1 লা মে, 1908 । শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়েছিলেন বছর 18-র কিশোর। সেদিন পুলিশ তাঁর হেপাজত থেকে পেয়েছিল 37 রাউন্ড গুলি। নগদ 30 টাকা। একটি রেল-ম্যাপ এবং ট্রেনের একটি টাইমটেবিল। পরের দিন 2 মে মুজফ্ফরপুর স্টেশনে নিয়ে আসা হয় ক্ষুদিরাম বসুকে। পরে নিয়ে যাওয়া হয় তৎকালীন স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট উডম্যানের বাড়িতে। দামাল এই বিপ্লবীকে একঝলক দেখতে ভিড় উপচে পড়েছিল শহরে। এক ইংরেজি দৈনিকে লেখা হয়েছিল, “The Railway station was crowded to see the boy. A mere boy of ১৮ or ১৯ years old, who looked quite determined. He came out of a first-class compartment and walked all the way to the phaeton, kept for him outside, like a cheerful boy who knows no anxiety…..on taking his seat the boy lustily cried ‘Vandemataram’.”।
বন্দেমাতরম। এই একটা মন্ত্র বদলে দিয়েছিল দিদি অপরূপার স্নেহের ক্ষুদিকে। ত্রৈলোক্যনাথ এবং লক্ষ্মীপ্রিয়ার তিন কন্যাসন্তানের কোলের দুই সন্তানের অকালমৃত্যুর পরে মা কালীর দুয়ার ধরেন লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী। তাঁর পরে কোলে আসেন ক্ষুদিরাম। তারপরও কোনও অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে মায়ের মন। এই ছেলেও বাঁচবে তো ... !
লোক-বিশ্বাস মেনে নিজের মেয়ের কাছে ছেলেকে বিক্রি করেন লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী। বিশ্বাস ছিল, এতে করে অকাল প্রাণহানি থেকে রক্ষা পাবে ছেলে। বড়দিদি অপরূপা তিন খুদের (চালের ভাঙা অংশ) বিনিময়ে মায়ের কাছ থেকে কেনেন তাঁকে। জনশ্রুতি - খুদের বিনিময়ে কেনা, তাই ত্রৈলোক্যনাথ এবং লক্ষ্মীপ্রিয়ার পুত্রসন্তানের নাম হয়েছিল ক্ষুদিরাম।
সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বছর ছয় বয়স যখন, মাতৃহারা হন ক্ষুদিরাম। একবছর পরে চলে যান বাবা। দেনার দায়ে পৈত্রিক বাড়ি নিলামে ওঠে। ছোট্ট অনাথ ভাইয়ের দায়িত্ব পুরোপুরি নিজের কাঁধে তুলে নেন দিদি অপরূপা। দিদির শ্বশুরবাড়ি দাসপুর থানার হাটগাছিয়াতে বেড়ে উঠতে থাকেন ক্ষুদিরাম বসু। কোর্টে কাজ করতেন ক্ষুদিরামের জামাইবাবু অমৃতলাল রায়। কিছুদিন পরে কাজের সূত্রে হাটগাছিয়া থেকে তাঁকে চলে যেতে হয় তমলুকে। তমলুকে নতুন ঠিকানায় নতুন করে পথচলা শুরু হয় ক্ষুদিরামের। 1901 সাল। ভরতি হন তমলুকের হ্যামিলটন স্কুলে । শুরুতে তেমন মন না থাকলেও পরে মাস্টারমশাইয়ের বকুনিতে পড়াশোনায় তাঁর মন বসে বলে বিভিন্ন লেখাজোখায় উঠে আসে।
বছর দু'য়েক পরে বদলির সূত্রে আবার বাসা বদল করতে হয় অমৃতলাল রায়কে। মেদিনীপুর শহরে চলে আসতে হয় তাঁদের। মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে ভরতি হন ক্ষুদিরাম বসু। তখন থেকেই ধীরে ধীরে দেশপ্রেমে ডুবে যেতে শুরু করে তাঁর মন। হাতে আসে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আনন্দমঠ। তাঁর মনে প্রভাব বিস্তার করে এই বই। স্থানীয় লাইব্রেরি থেকে দেশপ্রেম সংক্রান্ত নানা বই পড়তে শুরু করেন ক্ষুদিরাম। সঙ্গে শুরু করেন শরীরচর্চা।
ওই সময়ই মেদিনীপুর এসেছিলেন অরবিন্দ ঘোষ (ঋষি অরবিন্দ)। বেশ কয়েকটি প্রকাশ্য জনসভায় অংশ নিয়েছিলেন। মারাত্মক প্রভাবিত হয়ে পড়েন ক্ষুদিরাম বসু। সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন দেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য সঁপে দেবেন জীবন। শোনা যায়, শিক্ষক হেমচন্দ্র কানুনগোর কাছে নাকি একটি রিভলভার দেওয়ার অনুরোধও করেছিলেন। ফোর্থ ক্লাসে পড়াকালীন ছেড়ে দেন পড়াশোনা। তখন বয়স 16। পুরোপুরি দেশের জন্য সমর্পিত প্রাণ - ক্ষুদিরাম।
বিপ্লবী কর্মকাণ্ডকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরেন। যোগ দেন অনুশীলন সমিতিতে। 1908 সালে কাঁধে আসে বড় দায়িত্ব। ক্যালকাটা প্রেসিডেন্সির ম্যাজিস্ট্রেট অত্যাচারী কিংসফোর্ডকে চরম শাস্তি দিতে হবে। প্রফুল্ল চাকিকে সঙ্গে নিয়ে রওনা দেন মুজ়ফ্ফরপুরের দিকে। বুকে বল আর মুখে বন্দেমাতরম নিয়ে। গন্ধ পেয়েছিল পুলিশ। কিংসফোর্ডকে হত্য়ার চক্রান্ত হচ্ছে - খবর গিয়েছিল মুজ়ফফরপুরের সুপারিনটেন্ডেন্টের কাছে। তবে বিপ্লবী-পরিকল্পনা আঁচ করতে পারেনি পুলিশ।
30 এপ্রিল, 1908। অন্ধকারের গা ঘেঁষে এক গাছের আড়ালে শিকারির মতো নিস্তব্ধ হয়ে কিংসফোর্ডের ঘোড়ার গাড়ির অপেক্ষায় ছিলেন ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকি। তবে একটু ভুলচুক হয়ে গিয়েছিল। গাড়িতে বাড়ি ফিরছিলেন না কিংসফোর্ড। বদলে যে গাড়িটি আসছিল তাতে ছিলেন জনৈক প্রিঙ্গল কেনেডির স্ত্রী ও মেয়ে।
রাত তখন প্রায় সাড়ে 8 টা। অন্ধকার। ভালো করে ঠাওর করা যাচ্ছিল না কিছুই। গাড়ি কিংসফোর্ডের বাড়ির চত্বরের কাছাকাছি আসতেই, দৌড়ে গিয়েছিলেন ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকি। দেরি করেননি এক মুহূর্ত। তারপর - প্রবল বিস্ফোরণ। সশব্দে কেঁপে উঠেছিল এলাকা।
না, বিস্ফোরণে কিংসফোর্ড মারা যাননি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মারা গিয়েছিলেন মিস কেনেডি । পরের দিন সকাল পর্যন্ত মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে মারা গিয়েছিলেন তাঁর মা, মিসেস কেনেডি । তারপরে কী হয়েছিল, শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে।
এবার বিচার। 21 মে 1908৷ বিচারপতি কর্ন ডফ, নাথুনি প্রসাদ ও জনক প্রসাদের এজলাসে ক্ষুদিরাম বসুর বিচার শুরু হয় । ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে ময়দানে নেমেছিলেন মান্নুম ও বিনোদবিহারী মজুমদার নামে দুই আইনজীবী । ক্ষুদিরাম বসুর হয়ে লড়েছিলেন একঝাঁক বাঙালি আইনজীবী ৷ তাঁরা হলেন কালীদাস বসু ,উপেন্দ্রনাথ সেন, কেশরীনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ পরে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন কুলোকমল সেন, নগেন্দ্রনাথ লাহিড়ি এবং সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী। ক্ষুদিরামের জবানবন্দী নেওয়া হয় ।
13 জুন ছিল রায়দান । সেদিনই বিচারপতি ও ব্রিটিশ সরকারের হয়ে সওয়ালকারি আইনজীবীদের উদ্দেশে একটি চিঠি আসে । চিঠিতে বলা হয়, ওই ইংরেজ সাহেবকে হত্যার জন্য আরও একটি বোমা পাঠানো হয়েছিল ৷ তবে বাঙালি নয়, কাজটি করার কথা ছিল একজন বিহারীর। এই চিঠি ক্ষুদিরাম বসুর তরফের আইনজীবীদের উজ্জীবিত করেছিল। তাঁদের বক্তব্য ছিল, চিঠিতে স্পষ্ট গাড়িতে বোমা মারার ঘটনায় অন্য কোনও বড় মাথা জড়িত ৷ তাঁরা কিশোর ক্ষুদিরামকে কাজে লাগিয়েছিল । সুতরাং- ক্ষুদিরাম বসুকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায় না । না, আইনজীবীদের যুক্তি মানেননি বিচারপতি ৷ কিশোর বিপ্লবীকে মৃত্যুদণ্ডই দেওয়া হয় ৷ যদিও এরপর মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল হয় ।
1908 সালের 8 জুলাই ৷ হাইকোর্টে বিচারপতি বেল ও রাভেজের ডিভিশন বেঞ্চে মামলার শুনানি শুরু হয় । হাইকোর্টে ক্ষুদিরাম বসুর হয়ে সওয়াল করেন আইনজীবী নরেন্দ্রকুমার বসু । হাইকোর্টকে তিনি বলেন, নিম্ন আদালতের নির্দেশ আইন-সঙ্গত নয় ৷ ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে অভিযুক্তের জবানবন্দির বিষয়েও একাধিক প্রশ্ন তোলেন ক্ষুদিরামের আইনজীবী ৷ রায়ের পুনর্বিবেচনার দাবি জানান ৷ কিন্তু হাইকোর্টের বিচারপতি বক্তব্য ছিল, নিম্ন আদালত সমস্ত কিছু খতিয়ে দেখে রায় দিয়েছে ৷
এরপরেও নরেন্দ্রকুমার বসু আদালতকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, বোমা ক্ষুদিরাম নয়, ছুড়েছিলেন প্রফুল্ল ওরফে দীনেশ । ঘটনার পর আত্মঘাতী হন যিনি । নরেন্দ্রবাবু আরও বলেন, ক্ষুদিরামকে পুলিশের ভয় দেখিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল । বিচারপতির বক্তব্য ছিল, ক্ষুদিরাম নিজে তা বলেননি । তাছাড়া গ্রেপ্তারের সময় ক্ষুদিরামের কাছ থেকে দু'টি পিস্তল মিলেছিল । পিস্তল দু'টির মধ্যে একটি ছিল লোডেড, অন্যটি ফাঁকা ছিল । নরেন্দ্রকুমার জানান, ক্ষুদিরামের বয়স 19 হয়নি । সে বিবেচনাবোধহীন, অপরিপক্ক । বিচারপতি জবাব, ক্ষুদিরাম একেবারেই কাঁচা ছেলে না । একটা সুযোগের অপেক্ষায় তিনি ও তাঁর সহযোগী ঘটনার 20 দিন আগে থেকে মুজফ্ফরপুরে ছিলেন ৷ তাই তাঁকে বাচ্চা ছেলে বলা যায় না ৷
অতএব, মৃত্যুদণ্ড বহাল ৷ তবে রায় ঘোষণার আগে বিচারপতিরা "দোষী" কে প্রশ্ন করেন, ক্ষুদিরাম, তুমি কিছু বলতে চাও ? উত্তরে ক্ষুদিরাম বসু বলেছিলেন, আমাকে যদি সুযোগ দেওয়া হত, তাহলে আপনাকে বোমা বাঁধা শিখিয়ে দিতাম ।
11 আগস্ট, 1908-এর কাকভোরে ফাঁসি হয় ক্ষুদিরাম বসুর ৷ দেশমাতৃকাকে বিদায় জানান বিপ্লবী ৷ পরের দিন কাগজে কাগজে সংবাদ ৷ একটি ইংরেজি দৈনিকের শিরোনাম---Khudiram's End: Died cheerful and smiling"৷ সংবাদ এরকম---" Khudiram's execution took place at ৬ a.m. this morning. He walked to the gallows firmly and cheerfully and even smiled when the cap was drawn over his head." আরেক কাগজের খবর---"Khudiram Bose Was executed this morning... IT is alleged that he mounted the scaffold with his body erect. He was cheerful and smiling."
ইংরেজি দৈনিকগুলির সংবাদে স্পষ্ট, "হাসি হাসি পরব ফাঁসি" কেবল কথার কথা ছিল না, ছিল বাস্তব ৷ আশ্চর্য বাস্তব ! আর মিলে গিয়েছিল সেই রাস্তা। মৃত্যুর পরে মিলে গিয়েছিলেন প্রফুল্ল-ক্ষুদিরাম। মিলেছিল স্বাধীনতা।