মেদিনীপুর, 25 মে : মেদিনীপুর শহরের পাটনা বাজার এলাকায় সোনার কারিগরদের কে না চেনে ৷ এলাকায় পাটনা বাজার স্যাঁকরা পাড়া বলেই পরিচিত । আর এই লকডাউন জীবন অতিষ্ঠ করেছে স্বর্ণকারদের । জীবন জীবিকার পরিবর্তন করে কেউ সবজি বেচছেন তো কেউ ডিম। লকডাউন ওঠার পর পরিবার নিয়ে কীভাবে বাঁচবেন সেই নিয়েই আতঙ্কিত তাঁরা ৷ সরকার সাহায্য না করলে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হবে বলে জানাচ্ছেন এলাকার ছোট কারিগর থেকে বড় স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা ।
জঙ্গলমহল অধ্যুষিত পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পাটনা বাজারে প্রায় 1200 মানুষ সোনার গয়না তৈরির কাজের সঙ্গে যুক্ত । এই সোনার কাজ করেই তাঁরা সংসার চালান ৷ পূর্ব পুরুষ আমল থেকে পাওয়া একাজ আজও চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা । এক সময় এই পাটনা বাজার এলাকায় প্রতিটা মানুষ এই সোনার কাজ করে জীবন-জীবিকার নির্বাহ করতেন ৷ মূলত তাঁরা অন্যান্য জীবিকা ছেড়ে দিয়ে এই জীবিকাকে বেছে নেয় ভবিষ্যতের লক্ষ্য পূরণ করার জন্য।
বাড়িতে ছোট-বড় দোকান খুলে এবং বাড়িতে বসেই কানের দুল নাকছাবি সোনার গয়না তৈরি করে তাঁদের জীবন-জীবিকা চালিয়ে নিতেন । কিন্তু বর্তমানে ঘোরতর সমস্যার মুখে পড়েছেন তাঁরা ৷ লকডাউনের আগেই সোনার দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা একপ্রকার বন্ধের মুখে হয়ে পড়েছিল । বহু দোকান-পাট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং সোনার কাজ প্রায় হত না বললেই চলে । তাও ঘরে বসেই বেশকিছু সোনার কাজ করতেন কারিগররা । কিন্তু 60 দিনের দীর্ঘ লকডাউনে জীবনটাই একদম বদলে গিয়েছে ।
জেলার আড়াই তিন হাজার সোনার ছোটো-বড় কারিগরের পরিবার-পরিজন মিলিয়ে বর্তমানে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন । কারণ সোনার দাম আকাশ ছুঁই ছুঁই এবং দীর্ঘ লকডাউন মানুষের হাতে আর টাকা নেই । এই সময় বিয়ের মরশুম ছিল ৷ কিন্তু কোরোনার জেরে লকডাউন ৷ আর তার জেরে বন্ধ বড়-ছোটো জমায়েত ৷ তাই এই মরশুমে কার্যত কর্মহীন তাঁরা ৷ বিয়ে বন্ধ,তাই সোনার টুকটাক কাজেরও অর্ডার আর আসেনি। এরপর লকডাউন উঠলে মানুষ বিয়ে বাড়িতে লাখ লাখ টাকার সোনার গহনা কিনবে এরকম ভাবাটা অস্বাভাবিক ।
দীর্ঘদিন কারিগরদের হাতুড়ির আওয়াজ পাননি পাড়ার বাসিন্দারাও । পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় এই সোনার ছোটো-বড় কারিগরের সংখ্যা প্রায় 3000 হাজারের মতন। এর সঙ্গে রয়েছে তাঁদের পরিবার-পরিজন । মূলত এই কাজের উপর নির্ভর করেই তাঁদের জীবন জীবিকা চলে। বর্তমানে তাঁরা সংসার চালানোর জন্য রাস্তার ধারে পাঁউরুটি, ডিম, সবজি বেচছেন ৷ কেউবা সাইকেলে কেটলি বসিয়ে চা বিক্রি করছেন। মহামারির কারণে ও পরিস্থিতির চাপে জীবিকা বদলাতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা ৷
এবিষয়ে এলাকার এক স্বর্ণ কারিগর রিন্টু রানা বলেন, ‘‘লকডাউনের আগেই আমাদের সোনার কাজ অর্ধেক কমে গেছে । অনেকে কাজ করাতেন না । যেহেতু সোনার দাম বেশি ছিল । কিন্তু লকডাউনে ঘাড় ভেঙে গেছে আমাদের । এখনতো বিক্রিবাট্টাও নেই । কীভাবে চলবে তা নিয়ে আতঙ্কে আছি । আগামী দিনে লকডাউন ওঠার পর মানুষ আগের মতন সোনার গহনা কিনবে কীনা সেটাই প্রশ্নের । তাই আরো 5 বছর পিছিয়ে গেলাম আমরা । সরকার থেকে যদি কোন সহযোগিতা না করে তাহলে আমাদের না খেতে পেয়ে মরতে হবে । তাই আমাদের অনেকে জীবিকা পরিবর্তন করে ডিম, সবজি বিক্রি করছেন । আগামী দিনে যদি সরকারিভাবে সাহায্য না পাই তাহলে আমাদের আত্মহত্যা ছাড়া কোন উপায় নেই ।’’
বঙ্গীয় স্বর্ণশিল্পী সমিতির সম্পাদক মানিক পাত্র বলেন, ‘‘এই স্বর্ণশিল্পী তথা স্যাঁকরা পাড়ার জীবন-জীবিকা একদমই শেষ তলানীতে । আগে আমাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠেছিল । লকডাউন আমরা মৃতপ্রায় । লকডাউন ওঠার পর আর কোনওদিন সোনার কাজ কেউ করাবে বা আমাদের মতন ছোট ছোট স্যাঁকরাদের এই সোনার কাজ হবে এটা অবাস্তব । আমাদের পরিবার পরিজন আছে যাঁদের আমরা এই কাজের উপর ভিত্তি করে দুমুঠো খাবার তুলে দিয়ে থাকি ৷ হয়তো সবাইকে না খেতে পেয়ে মরতে হবে । আমরা আবেদন করেছি রাজ্য এবং কেন্দ্রের কাছে যাতে আমাদের সাহায্য করা হয় ।’’
স্যাকরা পাড়ার মানুষজনের অভিযোগ স্বীকার করে নিয়েছেন বিজেপি শ্রমিক সংগঠন নেতা শংকর দাস । তিনি বলেন এই স্বর্ণ শিল্পীদের জীবন-জীবিকা সত্যিই ভয়ঙ্কর জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ।