শুরু হবে ফুটবল খেলা ৷ ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা ৷ বল পায়ে মাঠে নেমেছিলেন মেদিনীপুরের জেলাশাসক বার্জ ৷ সামনে থেকে চলল গুলি ৷ মাটিতে পড়ে গেলেন অত্যাচারী শাসক৷ তাঁর বুকের উপর চড়ে বসলেন দুই যুবক৷ হাতে থাকা পিস্তল খালি করে দিলেন শাসকের বুকে ৷ দ্রাম দ্রাম দ্রাম ৷ রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ৷ চারদিকে তখন ছুটোছুটি ৷ চিৎকার ৷ মাঠ ছেড়ে পালাচ্ছে দর্শক ৷ তখনই আরও কয়েকটা গুলি ছুটে এল দূর থেকে৷ অত্যাচারী জেলাশাসকের বুকের উপর বসে থাকা দুই যুবকের শরীরে লাগল সেই গুলি ৷ তাঁরাও মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন ৷ একজন ঘটনাস্থানেই মারা যান ৷ অন্যজনকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে ৷ প্রথমজন অনাথবন্ধু পাঁজা, দ্বিতীয়জন মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত ৷ স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মেদিনীপুরের সশস্ত্র সংগ্রামে শহিদ বিপ্লবীদের মধ্যে তাঁরাও অন্যতম ৷
খবর চাউর হতে সময় লাগল না ৷ কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল ইংরেজ শাসকদের ৷ বিপ্লবীদের খনি মেদিনীপুর বরাবরই চিন্তায় ফেলেছে তাদের ৷ এপ্রিল 1931 থেকে- 1932-এর এপ্রিল ৷ মাত্র এক বছরের মধ্যে দুই জেলাশাসক জেমস পেডি ও ডগলাসকে খতম করেন বিপ্লবীরা ৷ ডগলাসের জায়গায় এসেছিলেন বার্জ ৷ তাঁর জন্য বাড়ানো হয়েছিল নিরাপত্তা ৷ নিজের কাছেও পিস্তল রাখতেন তিনি ৷ তারপরও কীভাবে যে বিপ্লবীরা তাঁর নাগাল পেলেন তা বুঝে উঠতে পারল না ব্রিটিশ শাসক ৷ 1933-র 2 সেপ্টেম্বরের সেই ঘটনা ইতিহাসে বার্জ হত্যা নামে খ্যাত ৷
তবে বার্জ নিজের কবর নিজেই খুঁড়েছিলেন ৷ ডগলাসকে খতম করেছিলেন বিপ্লবী প্রভাংশু পাল ও প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্য ৷ ডগলাসের জায়গায় কে আসবেন মেদিনীপুরের জেলাশাসকের পদে, তা নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হয় ৷ শোনা যায়, কোনও ইংরেজ আধিকারিক মেদিনীপুরের দায়িত্ব নিতে চাননি ৷ শেষে রাজি হন বার্জ ৷ তবে এসেই ভুল করে বসেন ৷ ফাঁসির মঞ্চে বেত্রাঘাত করেন প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্যকে ৷ তখন থেকেই তিনি ঢুকে পড়েন বিপ্লবীদের খতম তালিকায় ৷
বিপ্লবীদের টার্গেটে ঢুকলেও বার্জকে খতম করা অত সহজ ছিল না ৷ কারণ, পেডি ও ডগলাসের হত্যা থেকে শিক্ষা নিয়ে বার্জের নিরাপত্তা ব্যাপক বাড়িয়ে দেয় ইংরেজ প্রশাসন ৷ তাঁকে দেওয়া হয় সশস্ত্র দেহরক্ষী ৷ বার্জ নিজের কাছেও আগ্নেয়াস্ত্র রাখতেন ৷ অপরিচিত কাউকে ঘেঁষতে দিতেন না কাছে ৷ রুটিন মেনে কাজ করতেন ৷ অফিসে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হত বিভিন্ন সময় ৷ বিপ্লবীরা যাতে তাঁর নাগাল না পান সেজন্য এই ব্যবস্থা ৷ এইরকম আঁটসাট নিরাপত্তার মধ্যে থাকা বার্জকে খতম করার দায়িত্ব সঁপে দেওয়া হয় অনাথবন্ধু পাঁজা ও মৃগেন্দ্রনাথ দত্তকে ৷
অনাথবন্ধু পাঁজা ৷ মেদিনীপুরের এই বীর সন্তানের জন্ম সবং থানার জলবিন্দু গ্রামে 1911-র 19 অক্টোবর ৷ আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না পরিবারের ৷ হতদরিদ্রই বলা চলে ৷ অবস্থা আরও তলানিতে ঠেকে যখন বাবা সুরেন্দ্রনাথ পাঁজা মারা যান ৷ তখন অনাথবন্ধুর বয়স মাত্র তিন বছর ৷ সংসারের হাল ধরার মতো কেউ নেই ৷ অসহায় বিধবা কুমুদিনীদেবী সন্তানদের নিয়ে চলে আসেন মেদিনীপুর শহরে ৷ শহরের টাউন স্কুলে পড়াশোনা শুরু অনাথবন্ধুর ৷ সেখান থেকেই বিপ্লবী কাজকর্মে হাতেখড়ি ৷ স্কুলছাত্র অনাথবন্ধু যোগ দেয় বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সে ৷ নেয় প্রশিক্ষণ ৷ দেশপ্রেমের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে সে ৷ পড়াশোনার সঙ্গে বিপ্লবী কাজকর্ম চলতে থাকে ৷ তবে অভাব তার পড়াশোনার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় ৷ পড়াশোনা সেভাবে থেমে থাকলেও বিপ্লব থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেননি যুবক অনাথবন্ধু ৷
সেই সময় বিপ্লবীরা নিজেরাই সামর্থ্যমতো বিপ্লবের কাজে অর্থসাহায্য করতেন ৷ অনাথের পরিবারের কোনও উপার্জন ছিল না ৷ তাঁদের কিছু কৃষিজমি ছিল ৷ সেখান থেকেই সংসার চলত ৷ একবার জমি থেকে ওঠা সমস্ত ধান বিক্রি করে দেন তিনি ৷ সেই টাকা তুলে দেন বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের ফান্ডে ৷ এদিকে সংসারে অভাব ৷ মা' কে অনাথবন্ধু জানালেন, ''ধান বিক্রির টাকা পকেটমারি হয়ে গেছে ৷'' দেশমাতৃকাও মায়ের মতো, এই শিক্ষা পেয়েছিলেন অনাথবন্ধু ৷ দেশের স্বাধীনতার জন্য সবকিছু করতে রাজি ছিলেন তিনি ৷ যে কোনও গুরুদায়িত্ব পালনে পিছপা হবেন না, নেতৃত্বের মনে এই আশ্বাস দিতে পেরেছিলেন মাত্র বছর কুড়ির এই যুবক ৷
লড়াকু মনোভাব, দেশপ্রেমের ভাবনায় উদ্বুদ্ধ অনাথবন্ধু ও মৃগেন্দ্রনাথ দত্তকে দায়িত্ব দেওয়া হয় বার্জকে খতম করার ৷ যেন এতদিনে স্বপ্নপূরণ হতে চলেছে অনাথবন্ধুর ৷ একেই ফাঁসির মঞ্চে প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্যকে বেত্রাঘাত করেছিলেন বার্জ ৷ তার উপর দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি বিপ্লবীদের ব্যাপকভাবে ধরপাকড় শুরু করেন ৷ চালান অকথ্য নির্যাতন ৷ সেই বার্জকে খতম করার সুযোগ পেয়ে চেষ্টায় কোনও খামতি রাখতে চাননি অনাথবন্ধু ৷ অপারেশন সাকসেসফুল করার লক্ষ্যে রিভলভার চালানো শিখতে মৃগেন্দ্রনাথ, নির্মলজীবন ঘোষ, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী ও রামকৃষ্ণ রায়ের সঙ্গে কলকাতায় যান । শেষ করেন শিক্ষা ৷ কলকাতা থেকে পাঁচটি রিভলভারসহ ফিরে আসেন মেদিনীপুরে ।
এবারে বার্জকে খতম করার শুভ দিনের অপেক্ষা করছিলেন বিপ্লবীরা ৷ কিন্তু, সুযোগ পাচ্ছিলেন না ৷ বার্জকে হত্যার প্রথম পরিকল্পনা করা হয় 1933-এর এপ্রিল মাসেই ৷ কিন্তু, তা ব্যর্থ হয় ৷ এরপর বার্জের নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হয় ৷ হাল ছাড়তে নারাজ অনাথবন্ধুরাও ৷ বিপ্লবীরা জানতে পারেন, 2 সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর পুলিশ গ্রাউন্ডে টাউন ক্লাবের হয়ে মাঠে নামবেন বার্জ ৷ ছকে ফেলা হয় পরিকল্পনা ৷ মাঠের একদিকে জেলখানা, অন্যদিকে পুলিশের অস্ত্রাগার ৷ কড়া নিরাপত্তা থাকবে বার্জের চারপাশে ৷ সুযোগ পাওয়া যাবে একবারই ৷ যখন তিনি খেলতে নামবেন, তখন৷ আর সেই সুযোগই কাজে লাগাতে হবে ৷ ঠিক করেন বিপ্লবীরা ৷ তবে পুলিশের নজর এড়িয়ে অপারেশনের পর সেখান থেকে পালানো কার্যত অসম্ভব ৷ জানতেন অনাথবন্ধু ও মৃগেন্দ্রনাথ ৷ জেনেও পিছপা হননি তাঁরা ৷ মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও বার্জকে খতম করার কাজে এগিয়ে যান তাঁরা ৷
2 সেপ্টেম্বর ৷ মহামেডান ও মেদিনীপুর টাউনক্লাবের সেই ম্যাচে সেদিন ভিড়ে থিকথিক করছে মাঠ ৷ ম্যাচ শুরু হবে ৷ মাঠে নেমেছে দুই ক্লাবই ৷ মেদিনীপুর টাউন ক্লাবের হয়ে বল পায়ে মাঠে বার্জ ৷ দর্শকাসনে বসেছিলেন অনাথবন্ধু ও মৃগেন্দ্রনাথ ৷ সুযোগ বুঝে মাঠে নেমে আসেন তাঁরা ৷ দুজনেই বোঝেন, উপস্থিত মাহেন্দ্রক্ষণ ৷ লুকিয়ে রাখা পিস্তল বের করেন ৷ তারপর সামনে থেকে বার্জকে গুলি ৷ দ্রাম দ্রাম দ্রাম ৷ বার্জ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ৷ রক্তে ভেসে যাচ্ছে মাঠ ৷ ততক্ষণে মাঠে শুরু হয়েছে ছুটোছুটি ৷ যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে ৷ অনাথবন্ধু ও মৃগেন্দ্রনাথ সেই সুযোগে পালাতে পারতেন ৷ কিন্তু, পালাননি ৷ শোনা যায়, দুজনেই চড়ে বসেছিলেন বার্জের বুকে ৷ সবকটা গুলি উজাড় করে দিয়েছিলেন অত্যাচারী শাসকের বুকে ৷ পুলিশ গুলি চালায় দুই বিপ্লবীকে লক্ষ্য করে ৷ ঘটনাস্থানেই শহিদ হন অনাথবন্ধু ৷ পরদিন হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন মৃগেন্দ্রনাথ ৷
মাত্র তিনবছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছিলেন অনাথবন্ধু ৷ অভাব, দারিদ্র ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী ৷ মাঝপথে ছাড়তে হয়েছিল লেখাপড়া ৷ তবে দু'চোখ জুড়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন অনাথবন্ধু ৷ দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন ৷ দেশের জন্য কিছু করার স্বপ্ন ৷ সেজন্য বার্জকে খতমের দায়িত্ব যখন তাঁকে দেওয়া হয়, রাজি হয়েছিলেন এককথায় ৷ বাড়িতে জন্মদাত্রী মা'কে রেখে দেশমায়ের জন্য শহিদ হন মাত্র 20 বছর বয়সে ৷
ঘটনার দিন রাতেই মেদিনীপুর শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে ইংরেজ পুলিশ ৷ অলিতে গলিতে, পাড়া-মহল্লায় ৷ গোটা এলাকায় তখন শুধুই ভারী বুটের দাপাদাপি ৷ পুলিশের গাড়ির শব্দ এলাকায় ঢোকামাত্র ভয়ে কেঁপে ওঠে সাধারণ মানুষ ৷ মনের মতো উত্তর না পেলেই করা হয় মারধর, গ্রেপ্তার ৷ তছনছ করে দেওয়া হয় ঘরবাড়ি ৷ রাতভর এই তল্লাশি অভিযানে পুলিশ গ্রেপ্তার করে বিপ্লবী রামশংকর চক্রবর্তী, নির্মল জীবন ঘোষ, রামকৃষ্ণ রায়-সহ 33 জনকে ৷ পরে কামাখ্যাচরণ ঘোষ, সুকুমার সেনগুপ্তদের মতো বিপ্লবীদেরও গ্রেপ্তার করা হয় ৷ শুরু হয় বিচার ৷ 1934-এর 11 ফেব্রুয়ারি ৷ প্রাণদণ্ড দেওয়া হয় নির্মল জীবন ঘোষ, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী ও রামকৃষ্ণ রায়কে ৷ নন্দদুলাল, কামাখ্যা ঘোষ, সুকুমার সেন এবং সনাতন রায়-এর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ড হয় ৷
আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে অত্যাচারী জেলাশাসকদের হত্যার মাধ্যমে সশস্ত্র আন্দোলনের ইতিহাসে এক অভূতপর্ব অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন মেদিনীপুরের বিপ্লবীরা ৷ সেই গৌরবময় অধ্যায় সফলতা পায় মৃগেন্দ্রনাথ ও অনাথবন্ধুর আত্মবলিদানের মাধ্যমে ৷