জাড়া (পশ্চিম মেদিনীপুর), 13 সেপ্টেম্বর : একসময় রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর এবং পরবর্তীতে মহানায়ক উত্তমকুমারের স্মৃতিবিজড়িত জাড়ায় জমিদার পরিবারের 222 বছরে দুর্গাপুজো আড়ম্বরহীন । এক সময় রুপোর পালকিতে করে শোভাযাত্রা করে গ্রামের পুকুরে নবপত্রিকাকে স্নান করিয়ে হত পুজোর সূত্রপাত । বর্তমানে যদিও জমিদারি নেই, তবে রয়ে গিয়েছে বিশাল প্রাসাদ, যা এখন ভগ্নপ্রায়, আগাছায় ঢাকা । জমিদার বাড়ির 21টি পরিবার এখনও বসবাস করেন কিন্তু তাঁদের অধিকাংশই এখন কর্মসূত্রে ভিনরাজ্য বা ভিনদেশের বাসিন্দা ৷
পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলার ঘাটাল মহকুমার চন্দ্রকোনা-1 ব্লকের জাড়া গ্রামের জমিদার বাড়ির রায় পরিবার বধিষ্ণু পরিবার হিসাবে আজও পরিচিত । রাজা রামমোহন রায়ের বন্ধু ছিলেন জমিদার রাজীবলোচন রায় । জাড়া গ্রামে যাতায়াত ছিল রাজা রামমোহন রায়ের । তেমনই জাড়া জমিদার বাড়ির সঙ্গে সখ্যতা ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের-ও । জমিদার পরিবারের আমন্ত্রণে জাড়া স্কুলের স্থাপনা করেছিলেন তিনি ৷ তৎকালীন সময়ে জমিদার বাড়িতে আরও নাকি বেশ কয়েকবার এসেছিলেন বিদ্যাসাগর ৷
পাশাপাশি এই বাড়িতে মহানায়ক উত্তমকুমার তাঁর 'অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি' ছবির শুটিং করেছিলেন ৷ সেই সিনেমার একটি গান এখানে শুট করা হয়- 'কি করে বললি জগা জাড়ার গোলক বৃন্দাবন, যেখানে বামুন রাজা চাষি প্রজা, চারিদিকে তার বাঁশের বন' । এই জাড়ার জমিদার বাড়িতে কবি গানের আসর বসত ৷ বিখ্যাত কবিয়াল ভোলা ময়রা নাকি এই গান বেঁধেছিলেন, যা 'অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি' ছবিতেও তুলে ধরা হয় । এমনই স্মৃতি বিজড়িত জাড়া জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজোও হত মহাসমারোহে । জমিদার বাড়িতে দুর্গাপুজোর পাশাপাশি কালী, বিষ্ণুদেবতা, শিব-সহ একাধিক দেবদেবীর মূর্তি ও মন্দির রয়েছে । এখনও তিন বেলা ভোগ চড়িয়ে নিত্যসেবা করা হয় ।
1155 বঙ্গাব্দে (1748 খ্রিস্টাব্দ) জমিদারির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রামগোপাল রায় । পরবর্তীতে তাঁর ছেলে রাজা রাজীবলোচন রায় বর্ধমান রাজার থেকে 'রাজা' উপাধি পেয়েছিলেন ৷ তারপর থেকে জমিদারি আরও বিস্তৃত হয় ৷ তিনিই জমিদার বাড়িতে দুর্গাপুজোর সূচনা করেন । তৎকালীন সময়ে পুজোয় বহু মনীষীও আমন্ত্রিত হিসাবে আসতেন ৷
আগে পুজোর সময় কবি গানের আসর, যাত্রাপালা, নঙ্গর খানা চলত পুজোর 6-7 দিন ৷ পাশাপাশি 10-15টি গ্রামের মানুষ ভিড় জমাতেন পুজোয় ৷ চলত নরনারায়ণ সেবা । রুপোর পালকিতে করে গ্রামের একটি পুকুরে শোভাযাত্রা করে নবপত্রিকাকে স্নান করানো হত । বর্তমানে জমিদারি নেই তবে রয়ে গিয়েছে জমিদার বাড়ির বিশাল প্রাসাদ, যা এখন ভগ্নপ্রায়, আগাছায় ঢাকা । জমিদার বাড়ির 21টি পরিবার এখনও বসবাস করেন এখানে, তবে সবক'টি পরিবারেরই অধিকাংশ সদস্যই এখন কর্মসূত্রে থাকেন ভিনরাজ্য বা ভিনদেশে । তবে পুজোর সময় অনেকেই জমিদার বাড়িতে ফেরেন ৷
এবছর জাড়া জমিদার বাড়ির দুর্গা পুজো আনুমানিক 222তম বর্ষে পদার্পণ করবে । পুজোয় আগের মতো জৌলুস না থাকলেও আগের মতোই সমস্ত রীতিনীতি মেনেই পুজোর আয়োজন হয় ৷ জমিদার বাড়িতে পুজোর দিনগুলিতে মায়ের জন্য ভোগ রান্না থেকে নাড়ু তৈরি একমাত্র অগ্রাধিকার পান পরিবারের মহিলারই । দূরদুরান্তের মানুষ ভিড় জমান পুজোর ক'দিন ৷ তাঁদের জন্যও খিচুড়ি প্রসাদের আয়োজন থাকে । এছাড়াও নরনারায়ণ সেবারও ব্যবস্থা করা হয় পুজোয় । বৈষ্ণব মতে পুজো হওয়ায় কোনও বলি হয় না । তবে নবপত্রিকাকে স্নান করাতে নিয়ে যাওয়া হয় শোভাযাত্রা করে ৷ শোভাযাত্রা হয় বিসর্জনেও ৷ গ্রামের পুকুরেই প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় ৷
পুজোর আর ক'টা দিন বাকি ৷ তাই এখন থেকেই জাড়া জমিদার বাড়িতে প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গিয়েছে জোরকদমে । করোনার জেরে এবছরও সরকারি বিধি-নিষেধ মেনে সমস্ত কিছুর আয়োজন করা হচ্ছে বলে জানান পরিবারের সদস্যরা । বাইরে থেকে প্রতিমা আনা হয় না ৷ দালান বাড়িতেই বংশপরম্পরা মৃৎশিল্পী দিয়ে একই মেড়ে তৈরি হয় দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ । প্রতিমা তৈরির কাজও চলছে জোরকদমে । পুজোর আগে সেজে উঠছে জাড়া গ্রামের জমিদার বাড়ি ।