কেশপুর, 19 জুন: পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন পর্বে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গা থেকে সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠেছে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ৷ শাসক ও বিরোধী দলের বেশ কয়েকজন নিহতও হয়েছেন ৷ পরিস্থিতি এমনই যে অনেক জায়গায় ভোটের লড়াইয়ের ময়দান থেকে সরে যেতে দেখা যাচ্ছে বিরোধী দলের প্রার্থীদের ৷ এই অবস্থায় সিপিএমেরই এক প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিয়ে বলছেন, ‘‘শুনছি সবাইকে ভয় দেখাচ্ছে তৃণমূল ! দেখি কার হিম্মত আছে ? কে আমাকে আটকায় !’’
যাঁর কথা হচ্ছে, তাঁর নাম হাদিয়া খাতুন ৷ বছর সাঁইত্রিশের এই গৃহবধূ এবার পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশপুর থেকে জেলা পরিষদের 58 নম্বর আসনে প্রার্থী হয়েছেন ৷ যদিও তিনি প্রার্থী হিসেবে সিপিএমের প্রথম পছন্দ ছিলেন না ৷ ওই আসনে প্রথমে প্রার্থী হিসেবে নাজেমা খাতুনের নাম ঘোষণা করে সিপিএম ৷
অভিযোগ, নাম ঘোষণার পরই শুরু হয় প্রার্থীর বাড়িতে হুমকি দেওয়া । তৃণমূলের বিরুদ্ধেই অভিযোগ ৷ সিপিএমের দাবি, তার পরও দমে যাননি নাজেমা ৷ তিনি প্রার্থী হতে রাজি ছিলেন ৷ পরে পরিবারের কথা ভেবে সিপিএমই তাঁর নাম প্রত্যাহার করে নেয় ৷ এর পরও কেন্দ্রে মেহেরুনা খাতুনকে প্রার্থী করা হবে বলে জানানো হয় ৷ অভিযোগ, তাঁকেও তৃণমূলের হুমকির মুখে পড়তে হয় ৷ ফলে তিনি সরে দাঁড়ান ৷
আরও পড়ুন: চন্দ্রকোনায় সিপিএম ও আইএসএফ প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে চাপ দেওয়ার অভিযোগ তৃণমূলের বিরুদ্ধে
অথচ বাম জমানায় এই কেশপুরেই বিরোধীদের দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হত ৷ সেখানে সিপিএমের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগও উঠেছে বহুবার ৷ সেখানেই এই হাল সংগঠনের ৷ ফলে ওই আসনে লড়াইয়ের সিপিএম ছেড়েই দিয়েছিল বলে জানা গিয়েছে ৷ কিন্তু তখনই সামনে আসেন হাদিয়া খাতুন ৷ তিনি প্রার্থী হতে রাজি হয়ে যান ৷ গত বৃহস্পতিবার স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে মেদিনীপুর সদর মহকুমা শাসকের অফিসে মনোনয়ন জমা দেন ৷
তার পর ছিপছিপে চেহারার এই মহিলা বলেন, ‘‘আমিই কেশপুরে সিপিএমের জেলা পরিষদ প্রার্থী । মনোনয়ন জমা দিয়ে এলাম ।’’ এর পরই সরাসরি হুঁশিয়ারি দেন শাসক দলের উদ্দেশ্যে ৷ বলেন, ‘‘শুনছি সবাইকে ভয় দেখাচ্ছে তৃণমূল ! দেখি কার হিম্মত আছে ? কে আমাকে আটকায় ! সিপিএমের হয়ে প্রচার করব, ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করব ।’’
হাদিয়া কেশপুরের শাঁকপুর গ্রামের মেয়ে ৷ শ্বশুরবাড়ি স্থানীয় জগন্নাথপুরে ৷ স্বামী শেখ আব্দুল হামিদ বিভিন্ন দোকানে বই সরবহারের কাজ করে সামান্য আয় করেন । সংসার সামলে সেই কাজে স্বামীকে সাহায্য করেন ৷ তিনি নিজে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর পাস করেছেন ৷ কিন্তু চাকরি পাননি৷ রুজিরুটির জন্য একশো দিনের কাজও করেছেন ৷ সেই টাকাও পাননি বলে অভিযোগ ৷ তাই রাজনীতির ময়দানে নেমে প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন বলে তাঁর দাবি ৷
আরও পড়ুন: সুরক্ষা কবচে তাঁর বাড়িতে রাত্রিবাস করেন জুন, তৃণমূলের সেই একনিষ্ঠ কর্মী টিকিট না পেয়ে বাম প্রার্থী
তবে তিনি একা প্রতিবাদী নন ৷ তাঁর স্বামী শেখ আব্দুল হামিদও এবার ভোটের ময়দানে রয়েছেন ৷ হামিদ প্রার্থী হয়েছেন কেশপুর ব্লকের কেশপুর 10 নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের 170 নম্বর বুথ থেকে ৷ সেখান থেকে তিনি সিপিএমের প্রার্থী হিসবে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন । বৃহস্পতিবার স্ত্রীর মনোনয়নের সময় তিনিও হাজির ছিলেন ৷ পরে স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘আমরা গরিব মানুষ । সিপিএমকেই ভালোবাসি । শাসকের অনেক শাসানি, রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দু’জনেই মনোনয়ন জমা দিয়েছি । প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করব ।’’
তাঁদের সাহস দেখে অবাক সিপিএমের নেতারাও ৷ তাঁদের এই মনোবল রাজ্যের অন্যান্য অংশ সিপিএমের প্রার্থীদের মনের জোর বৃদ্ধি করবে বলেই পার্টির নেতাদের অভিমত ৷ তাই আপাতত নেতারা সর্বতোভাবে হাদিয়া ও হামিদের পাশে থাকতে তৎপর ৷ সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য তাপস সিনহা বলেন, ‘‘এরাই প্রকৃত পার্টি দরদী । বামপন্থাকে ভালোবেসে এই দুর্দিনে দলের প্রার্থী হতে এসেছে । পার্টির সুদিনে তো প্রার্থী হওয়ার জন্য পার্টি অফিসের সামনে অনেক সুযোগসন্ধানীর লাইন পড়ে যেত । আজ তাঁদের দেখা নেই । তাঁরা আজ মোবাইলের সুইচড অফ করে ঘরে বসে আছে । প্রকৃত বামপন্থী এঁরাই । আমরা আমাদের পার্টিগতভাবে হাদিয়ার পাশে রয়েছি । সব রকম সাহায্য করা হবে ৷ প্রয়োজনে করা হবে আইনি সাহায্য ।’’
যদিও সিপিএমের আশঙ্কা কাটেনি ৷ কারণ, বিভিন্ন জায়গায় মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের জন্য তৃণমূল চাপ দিচ্ছে বলে অভিযোগ ৷ তাই শেষপর্যন্ত মনের জোর ধরে রাখতে পারবেন তো হাদিয়া ! এই প্রশ্নই ঘুরে বেড়াচ্ছে সিপিএমের অন্দরে ৷ আগামিকাল, মঙ্গলবার মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষদিন ৷ তার পরই বোঝা যাবে হাদিয়া ভোটের লড়াইয়ে থাকলেন নাকি অন্য দু’জনের মতো সরে গেলেন !
আরও পড়ুন: বোমা-গুলি-লাঠি নয়, চা'য়ে পে চর্চায় সম্প্রীতির বার্তা মনোনয়নে