দুর্গাপুর, 30 অগস্ট: দুর্গাপুরে নিষিদ্ধপল্লি থেকে নাবালিকা উদ্ধারের তদন্তে নেমে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাতে এসেছে পুলিশের ৷ জানা গিয়েছে, বাংলাদেশের ওই নাবালিকাকে ভুয়ো আধার ও প্যান কার্ড তৈরি করে দিয়ে এ দেশে দেহ ব্যবসায় ব্যবহার করা হয়েছে ৷ এই ঘটনায় ধৃতদের জেরা করে আন্তর্জাতিক নারী পাচার চক্রের নানা রহস্য উন্মোচিত হচ্ছে পুলিশের সামনে ৷
নিজের নাম বলতে না চাওয়া আসানসোল দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের এক পুলিশকর্তা জানান, "এই চক্রে অনেকেই জড়িত আছে । আমরা সবার নাম এবং ঠিকানা জানতে দিনরাত এক করে দিচ্ছি ।"
নাবালিকা উদ্ধারের ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছেন তিন জন । তাঁদের মধ্যে একজন কাদারোড যৌনপল্লিতে যে যৌন কর্মীর বাড়িতে ওই নাবালিকাকে এনেছিলেন তাঁর নাম ফতেমা বিবি (নাম পরিবর্তিত)৷ পানাগড়ে ডাঙাপাড়ায় সেনাছাউনির পাশেই একটি বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয় তাঁর স্বামী মুস্তাক আহমেদকে । আর সোমবার দুর্গাপুর নিষিদ্ধ পল্লি থেকে ফতেমা বিবিকে গ্রেফতার করে দুর্গাপুর থানার পুলিশ ।
অভিযোগ, এক 14 বছর বয়সি নাবালিকাকে নিষিদ্ধ পল্লিতে বিক্রি করতে নিয়ে এসেছিলেন ফতেমা । নাবালিকাটি বাংলাদেশের বলে জানা গিয়েছে । বাংলাদেশ থেকে সে কীভাবে এল ? কোথায় রাখা হয়েছিল তাকে ? তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে কাঁকসা থানার অন্তর্গত 19 নং জাতীয় সড়কের ধারে সেনাছাউনির কাছাকাছি ডাঙাপাড়ায় একটি বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন ফতেমা এবং সেখানেই ওই নাবালিকাকে রাখা হয়েছিল ।
আরও পড়ুন: দুর্গাপুরের নিষিদ্ধ পল্লি থেকে উদ্ধার বাংলাদেশি নাবালিকা ! গ্রেফতার 3
সোমবার সন্ধ্যায় পুলিশ ফতেমার স্বামী মুস্তাক আহমেদকে সেই বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে । এলাকার মানুষ এই ঘটনায় আতঙ্কিত । তাঁরা জানিয়েছেন, দু-তিন মাস আগে মুস্তাক ও ফতেমা বিবি এই বাড়িটিতে ভাড়া নেন । তাঁদের সঙ্গে একটি বছর চোদ্দর মেয়েও ছিল, যাকে নিজের বোন বলে পরিচয় দিয়েছিল ফতেমা । কিন্তু সেই নাবালিকাকে এলাকার কারও সঙ্গে মিশতে দেওয়া হত না ৷ তাকে বাড়ি থেকে খুব বেশি বেরও করতেন না ফতেমা ।
কিন্তু কে এই মুস্তাক আহমেদ ?
মুস্তাক আহমেদ প্রথমে পুলিশের কাছে নিজেকে পশ্চিম মেদিনীপুরের বাসিন্দা বলে পরিচয় দেন । কিন্তু গ্রেফতার হওয়ার পর এখনও পর্যন্ত মুস্তাক আহমেদ নিজের বাবার নামটুকু ছাড়া আর কিছু বলেননি । পশ্চিম মেদিনীপুর পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে দুর্গাপুর থানার পুলিশ ৷ মুস্তাক তাঁর বাবার যে নাম বলেছেন, সেই নামে আদৌ কেউ আছেন কি না, মুস্তাক সত্যি বলছেন কি না, তা যাচাই করা হচ্ছে ৷ মুস্তাক আহমেদ গ্রেফতার হওয়ার পর সাংবাদিকদের সামনে এমন কথাও বলেন যে, ওই বাংলাদেশি নাবালিকাকে তিনি ভালোবেসে বিয়ে করে এই রাজ্যে নিয়ে এসেছেন । তাঁদের একটি ছোট্ট সন্তানও রয়েছে । কিন্তু এরপরেই দুর্গাপুর থানার পুলিশ তদন্তে নামলে তাদের চোখ কপালে ওঠে ।
পুলিশ জানতে পারে, বাংলাদেশের দুই দালাল ওই নাবালিকাকে ভুবনেশ্বরের এক নারী পাচারকারীর হাতে তুলে দেয় । সেই দুই দালালের একজনের নাম 'জনি' বলে জানা গিয়েছে ৷ এরপর ওই নাবালিকাকে নিয়ে আসা হয় দুর্গাপুরের একটি বিউটি পার্লারে । নাবালিকাকে দুর্গাপুরের সিটি সেন্টারের একটি শপিং মলের সামনে থাকা এক হোটেল মালিক (তদন্তের স্বার্থে নাম গোপন রাখা হল) চড়া টাকার বিনিময়ে ভুয়ো আধার কার্ড ও প্যান কার্ড করিয়ে দেন । এরপরে ওই বাংলাদেশি নাবালিকা ফতেমা বিবির হাতে এলে তার সঙ্গেই থাকত নাবালিকা ৷ পুলিশ সূত্রে খবর, তাকে দিয়ে দেহ ব্যবসা করাতে থাকেন ফতেমা ৷ বিভিন্ন হোটেলে পাঠিয়ে এসকর্ট সার্ভিস দিতে হত নাবালিকাকে ৷
আরও পড়ুন: স্বামীর মৃত্যুর পর মেয়েকে বিক্রি করে প্রেমিককে বিয়ে! মায়ের খোঁজে পুলিশ
ফতেমার স্বামী মুস্তাক আহমেদের বাড়ি কি এই রাজ্যেই ? নাকি তিনিও বাংলাদেশের নাগরিক ? এই নিয়ে পুলিশ এখন তদন্তে নেমেছে । মুস্তাক গত সোমবার দুর্গাপুরের ভিড়িঙ্গি মোড়ে ওই বাংলাদেশি নাবালিকাকে চার চাকা গাড়িতে করে পৌঁছে দেন । তারপর ভিড়িঙ্গি থেকে পাপ্পু রজক ওই নাবালিকাকে পৌঁছে দেন ফতেমা বিবির কাছে । সেখানে ওই নাবালিকা যৌনপল্লির রাস্তায় বেরিয়েছিল এলাকা ঘুরে দেখার জন্য ৷ তখনই তাকে দেখে সন্দেহ হয় যৌন পেশার সঙ্গে যুক্ত অন্যান্যদের । এরপরে সব সত্যি বেরিয়ে আসে ।
কিন্তু বাংলাদেশ থেকে হাত বদল হয়ে এ রকম কতজন এ দেশে দেহ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে ?
পুলিশ মুস্তাক আহমেদ ও ফতেমা বিবির মোবাইল বাজেয়াপ্ত করে আসানসোল ও দুর্গাপুরের মোট 20টি হোটেলের নাম পেয়েছে । এই সমস্ত হোটেলে প্রথমে দেহব্যবসার সঙ্গে যুক্ত মহিলাদের ক্যাটালগ পাঠানো হয় । তারপর গ্রাহকদের পছন্দমতো মহিলাদের পাঠানো হয় সেই সমস্ত হোটেলে । 'ব্লু-মুন' নামের একটি হোটেলে সবচেয়ে বেশি মহিলাদের পাঠানো হয়েছে বলে পুলিশি জেরায় জানিয়েছেন মুস্তাক ও ফতেমা ।
বাংলাদেশ থেকে এ রকম কতজনকে নিয়ে আসা হয়েছে এই রাজ্যে, পুলিশ এখন তার তদন্ত চালাচ্ছে ? শুধু কি বাংলাদেশ, নাকি উত্তর-পূর্ব ভারতের বেশকিছু রাজ্যের মেয়েদেরও নিয়ে আসা হয়েছে দেহ ব্যবসার জন্য ? তারই তদন্ত করছে পুলিশ ৷ আপাতত পুলিশের রাতের ঘুম উঠেছে সমস্ত তথ্য হাতে পাওয়ার পর । তবে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর বিষয়, কে বা কারা কীভাবে এদেরকে ভুয়ো নথি তৈরি করে দিচ্ছে ? দুর্গাপুর থানার পুলিশ তাদের খোঁজে তল্লাশি শুরু করেছে ।
আন্তর্জাতিক নারী পাচার চক্রে প্রতিনিয়ত তদন্তে উঠে আসছে নতুন নতুন তথ্য । আর সেই তথ্য ধরেই নারী পাচার চক্রের রহস্যের জাল খুলতে চাইছে দুর্গাপুর থানার পুলিশ ।