আসানসোল, 14 অক্টোবর: আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। কাশ ফুলের দোলা আর শিউলির গন্ধের সঙ্গে রেডিয়োতে মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্রপাঠ দিয়েই বাঙালির দুর্গাপুজো শুরু। মহালয়া জানিয়ে দেয় 'মা আসছেন'। আশ্চর্য হওয়ার মতো বিষয় এই যে মহালয়ার সঙ্গে দুর্গাপুজোর কোনও যোগসূত্র নেই। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুরমর্দিনী ছাড়া এই মহালয়ার সঙ্গে দুর্গাপুজোর অন্য কোনও যোগও নেই। আর তাই সোশাল মিডিয়াজুড়ে চলছে বিতর্কের ঝড়। প্রশ্ন একটাই- মহালয়া শুভ না অশুভ!
হিন্দু রীতি অনুযায়ী মহালয়া হল একটি বিশেষ দিন। এদিন হিন্দুরা তাঁদের পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্য জলদান করেন বা তর্পণ করেন। অবশ্য পণ্ডিতদের মতে, তর্পণ এক পক্ষকাল অর্থাৎ গোটা পিতৃপক্ষজুড়েই করতে হয়। মহালয়া হল পিতৃপক্ষের শেষ দিন। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপ্রতিপদ তিথিতে এক পক্ষকালজুড়ে পিতৃপুরুষকে তিল-জল দান করার রীতি রয়েছে। আশ্বিন মাসের অমাবস্যা তিথিতে মহালয়ায় শেষ জলদান করা হয়। মহাভারতে এ প্রসঙ্গে কর্ণকে নিয়ে একটি গল্প বহুল চর্চিত। কর্ণ নাকি স্বর্গ থেকে যমরাজের নির্দেশে ফিরে এসে পিতৃপুরুষকে এই এক পক্ষকালজুড়ে জল দান করেছিলেন। তখন থেকেই এই তর্পণ রীতি হয়ে আসছে।
- মহালয়া শুভ না অশুভ!
এ বিষয়ে আমরা বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ির কাছে জানতে চেয়েছিলাম। নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ি জানালেন,
মহালয়া পিতৃপক্ষের শেষ দিন। পিতৃশ্রাদ্ধের পক্ষে শুভ যোগ। পিতৃশ্রাদ্ধের দিন মানেই অশুভ হবে এটা ভাবার কোনও কারণ নেই। আবার এটাকে অত্যন্ত শুভ ভেবে 'শুভ মহালয়া' বলারও কোনও মানে নেই। শ্রাদ্ধ করা মানে সেই মানুষটাকে শ্রদ্ধা জানানো। তখন সেটা একটা উদযাপন। আবার সেই উদযাপন এমন নয় যে শুভ মহালয়ার শুভেচ্ছা জানাতে হবে। মহালয়ায় শ্রাদ্ধ সবসময় করতে পারি না আমরা। তাই তর্পণ করি।
- কেন মহালয়া এত গুরুত্বপূর্ণ?
নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ির কথায়, "পৌরাণিক ভাবনায় বলা হয় এই দিনটিতে অন্তরীক্ষলোকে আমাদের যে পূর্বপুরুষরা রয়েছেন তাঁরা কাছে নেমে আসেন। সেখানে একটা আলয় সৃষ্টি হয়। আলয় মানে বাসস্থান। পিতৃলোকরা আসেন বলেই এটা মহান আলয়। সেখান থেকেই মহালয়। তিথিটা যেহেতু স্ত্রী লিঙ্গ। তাই এটা মহালয়া তিথি।"
তবে এই মহালয়ার সঙ্গে দুর্গাপুজোর কোনও যোগ নেই। কিন্তু বাঙালিদের মহালয়া থেকেই দুর্গাপুজো শুরু হয়ে যায়। এর পিছনে রয়েছে কিংবদন্তি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুরমর্দিনী। 1932 সালে প্রথম দুর্গাপুজার মহাষষ্ঠীর দিন ভোরবেলা কলকাতা বেতার থেকে সম্প্রচার করা হয় আগমনী গীতি আলেখ্য মহিষাসুরমর্দিনী। কিন্তু পরের বছরেই (1933) সেই অনুষ্ঠান মহালয়ার ভোরে অর্থাৎ পিতৃপক্ষের শেষদিনে সেই মহিষাসুরমর্দিনী বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়। ব্যস! সেই থেকেই মহালয়ার সঙ্গে ঢুকে গেল বাঙালির দুর্গাপুজো।
নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ির মতে, "মহালয়ার দিন সেই অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত করার পর সেটা ক্লিক করে গেল। সেটা এমনভাবে ক্লিক করে গেল যে আজও পর্যন্ত অপরিবর্তনীয় রয়ে গেল। আমরা আজও সেটা পালটাতে পারিনি। হয়তো আর পালটাবও না। এই যে একটা কিংবদন্তি বিষয় তৈরি হয়ে গেল, ফলে দুর্গাপুজোর যে একটা উদযাপনের ব্যাপার সেটা এসে ঢুকল পিতৃপক্ষের মধ্যে। সেইদিন থেকে দুর্গাপুজোর একটা সূচনা হয়ে যায় বলে অনেকে মনে করছেন এখন। সেটা কিন্তু বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের জন্য। আর কোনও কারণ নেই। যেদিন থেকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের মহিষাসুরমর্দিনী ক্লিক করেছে আর আজও তা হয়ে চলেছে...সেদিন থেকেই দেবীপক্ষের সূচনাটা পিতৃপক্ষের পরের দিন না-হয়ে শেষদিনই মানুষের মনে গেঁথে গিয়েছে এটাই দেবীপক্ষের সূচনা। ফলে এইদিন থেকেই একটা উদযাপন শুরু হয়ে যায় যে মা আসছেন। তাই পিতৃপক্ষের শেষদিনকে কখনই অশুভ বলা যায় না।"
আরও পড়ুন: মহালয়ার শুভ লগ্নে কোন কোন রাশির উন্নতির যোগ, জানুন রাশিফলে