আসানসোল, 7 মার্চ :কথায় আছে, ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয় । মনে অদম্য জেদ ও কিছু করার ইচ্ছে থাকলে যে কোনও বাধা অতিক্রম করা যায় । তার আদর্শ উদাহরণ হলেন আসানসোলের বাসিন্দা সাইনুর তরফদার । সাইনুর শুধুই উদাহরণ নয়, আগামীর পথ চলায় অনেকেরই পথ প্রদর্শক, অনুপ্রেরণা হলেন সাইনুর ।
সাইনুর তরফদার । জন্ম উত্তর 24 পরগনার হিঙ্গলগঞ্জ থানা এলাকার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে । সেখানেই বেড়ে ওঠা । গ্র্যাজুয়েশন করা । স্বপ্ন ছিল উচ্চশিক্ষার ৷ কিন্তু নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে উচ্চশিক্ষা যেন বিলাসিতা । তাই বাড়ি থেকে বিয়ে ঠিক করে দেয় সাইনুরের । কিন্তু পাত্রের বয়স সাইনুরের থেকে অনেক বেশি ৷ শিক্ষা ততটাই কম । বেঁকে বসেন সাইনুর । বিয়ে করতে চান না । আরও উচ্চশিক্ষিতা হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ইচ্ছা তাঁর ৷ কিন্তু পরিবারের লোকেরা তাঁর কথা শুনতে রাজি হয়নি । আর ঠিক সেই সময়েই কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন সাইনুর । বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি । শুধুমাত্র পড়াশুনা করবে বলে একটা নিশ্চিত জীবনের হাতছানি ছেড়ে, কঠিন জীবনকে বেছে নেন । কিন্তু বাড়ি ছেড়ে যাবে কোথায় ? কোথায় গেলে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে ? ওই যে কিছু করার ইচ্ছে থাকলে উপায় ঠিকই বেরিয়ে যাবে ৷ ঠিক সেরকমই হয়েছিল ৷
দুর্গাপুরের এক বন্ধুর মারফত আসানসোলের স্বশক্তি হোমের ঠিকানা পান সাইনুর । সমস্ত কিছু গোপন রাখা হবে এমন শর্তে পাশে পান এলাকার এক জনপ্রতিনিধিকেও । তারপর সেই জনপ্রতিনিধির সাহায্যে একদিন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন সাইনুর । আশ্রয় পান আসানসোলের স্বশক্তি স্বধার গৃহ হোমে । মায়ের মতো পাশে পান হোমের ইনচার্জ সেরিনা মণ্ডলকে ।
আরও পড়ুন, মেদিনীপুরে জনতার মাঝে সাবলীল প্রচার আনকোরা জুনের
হোম মানেই উদ্ধার হওয়া অনাথ কিশোরী ৷ মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলাদের আশ্রয়স্থল । সেক্ষেত্রে পড়াশোনা করার জন্য অনেকটাই প্রতিকূল পরিবেশ ছিল । কিন্তু সাইনুরের জেদের কাছে সব হার মানে । বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন । ইচ্ছে ছিল আরও পড়ার । বিএড করার । কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় অর্থ । হোমেই আসতেন সমাজকর্মী শুক্লা চট্টোপাধ্যায় ও অন্যান্য । তাঁদের পাশে পান সাইনুর । বিএড করতে ভর্তি হন পুরুলিয়ায় । সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ন হন তিনি । প্রাথমিক শিক্ষকের পরীক্ষায় পাশও করেছিলেন বলে জানান তিনি ৷ কিন্তু পরবর্তীকালে আইনি জটিলতায় নিয়োগ থমকে যায় । তাও কোনওভাবে সাইনুরকে দমাতে পারেনি । পরে চাইল্ড লাইনে চাকরি পান । সেইসময় প্রচুর নাবালিকা মেয়ের বিয়ে আটকেছিলেন তিনি ৷ বর্তমানে নিজের প্রিয় জায়গা স্বশক্তি হোমেই চাকরি করছেন ।
বর্তমানে বিয়েও করেছেন সাইনুর । একটি ছোটো ছেলেও আছে তাঁর । সেই ছেলেকে নিয়েই হোমে আসেন । হোমের অফিসের কাজকর্ম করেন । আবাসিকদের পড়ান । আরও নানান কাজ করেন । সাইনুর জানিয়েছেন, প্রায় চারবছর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখিনি । যখন পড়াশোনা শেষের দিকে তখন বাড়িতে সব জানান । সাইনুরের এই সাফল্যে খুশি পরিবারের লোকেরাও । অন্যদিকে, স্বশক্তি স্বধার গৃহ হোমের সেরিনা মণ্ডল জানালেন, " শুধু পড়ার জন্য ও যেভাবে বাড়ি থেকে চলে এসেছিল তা সত্যিই প্রশংসনীয় । তবে শুক্লাদিদের মতো সমাজকর্মীরা ওর পাশে না থাকলে হয়তো লড়াইটা আরও কঠিন হত ।" সমাজকর্মী শুক্লা চট্টোপাধ্যায়, সাইনুরের সাহসকে সেলাম । আমরা আগামী দিনেও ওর মতো অনেকের পাশে থাকার চেষ্টা করব ।
সাইনুরের মতো অনেক মেয়েকে আজ পরিস্থিতির চাপে পড়ে ছোটো বয়সে সংসারের জাঁতাকলে পিষতে হচ্ছে । অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে তাঁদের স্বপ্ন । তবে সাইনুরের জীবনের গল্প প্রেরণা দেবে সেইসব নারীদের । নতুন করে বাঁচতে শেখাবে ।