আসানসোল, 14 নভেম্বর: 33 বছর কম কথা নয় । তবু স্থানীয়দের মনে হয়, এই তো হালফিলের ঘটনা । 1989 সালে 15 নভেম্বর রাতভর লড়াইয়ের পর 16 নভেম্বর ভোরবেলা রানিগঞ্জের মহাবীর খনি (Mahaveer Mine) থেকে অভিনব উপায়ে 65 জন শ্রমিককে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা গিয়েছিল । আর এই অপারেশনের হিরো ছিলেন খনি ইঞ্জিনিয়ার যশবন্ত সিং গিল (Jaswant Singh Gill)। তিনি বোর হোল দিয়ে একটি ক্যাপসুলের মাধ্যমে খনি গর্ভে নেমে আটকে পড়া 65 জন শ্রমিককে উদ্ধার করেন । সম্প্রতি গিল সাহেবকে নিয়ে একটি চলচিত্র নির্মিত হচ্ছে । গিল সাহেবের ভূমিকায় অভিনয় করছেন অক্ষয় কুমার (Akshay Kumar)। তা শুনেই আরও একবার প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে ওই দিনের স্মৃতি তরতাজা হয়ে উঠেছে । সেই স্মৃতির সাক্ষী ইটিভি ভারত ।
দিনটা ছিল 1989 সালের 11 নভেম্বর । সে দিন গভীর রাতে মহাবীর খনির 21 এবং 42 নম্বর সেকশনে কয়লা কাটার কাজ চলছিল । 21 নম্বরে 61 জন এবং 41 নম্বরে 10 জন শ্রমিক ছিলেন । বিস্ফোরণের কারণে খনির দেওয়াল ভেঙে যায় । পাশেই পুরনো ব্রিটিশ আমলের খনির জমা জল ছিল । প্রায় 11 লক্ষ গ্যালন জল ঢুকে পড়ে মহাবীর খনিতে । 6 জন এই জলের তোড়ে ভেসে যান । পরে তাঁদের মৃতদেহ উদ্ধার হয় । কয়েকজন তড়িঘড়ি উপরে উঠে এলেও, খনির ভিতর আটকে পড়েন 65 জন শ্রমিক । তাঁরা কোনওভাবে একটি উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছিলেন । খনির ভিতরে বিদ্যুৎ সংযোগ চলে যায় । অন্ধকার খনি গর্ভে তখন 65 জন । পাশাপাশি লোককেও দেখা যায় না । খাবার নেই, জল নেই এক ভয়াবহ অবস্থা । তবু ক্ষীণ ভাবে চালু ছিল খনির ভিতরের টেলিফোন লাইন । তাতেই শ্রমিকরা কোনও ভাবে জানাতে পেরেছিলেন খনির কোন অংশে আটকে আছেন তাঁরা ।
ইসিএলের দক্ষ সার্ভেয়াররা মাটির উপর থেকেই স্থানটিকে খুঁজে বের করেন নির্ভুল ভাবে । এরপর 13 নভেম্বর প্রথম বোর হোল করা হয় । তা দিয়েই শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যায় । পাঠানো হয় খাবার ও জল । আসে ধানবাদ থেকে বিশেষ উদ্ধারকারী টিম । কিন্তু কীভাবে উদ্ধার করা যাবে শ্রমিকদের ! খনি ভরে আছে জলে, নামা সম্ভব নয় । সেই মুহূর্তে উদ্ধার নিয়ে মাথায় হাত সবার ।
আরও পড়ুন: 'দেউচা-পাচামিতে কয়লা খনি হতে দিবক লাই', রাজপথে হুঁশিয়ারি আদিবাসীদের
অন্যদিকে খনিতে আটকে থাকা শ্রমিকদের পরিবারের লোকেরা ধৈর্যহীন হতে শুরু করেন স্বাভাবিক ভাবেই । সেই সময় ত্রাতার ভুমিকায় এগিয়ে আসেন খনি ইঞ্জিনিয়ার যশবন্ত গিল (J S Gill) । তিনি বলেন, বোর হোলের মাধ্যমে ক্যাপসুল ঢুকিয়ে শ্রমিকদের উদ্ধার করা সম্ভব । সেইমতো ইসিএলের নিয়ামতপুর ওয়ার্কশপে 14 নভেম্বর তড়িঘড়ি লোহার চাদর দিয়ে ক্যাপসুল তৈরি হয়ে যায় ।
15 নভেম্বর রাত থেকেই হাজার হাজার লোক জমা হয়ে যায় রানিগঞ্জের নারায়ণকুড়ি এলাকায় । ক্যাপসুল তৈরি হয়ে এসেছে ততক্ষণে । কিন্তু নামবে কে ? প্রাণের ভয় সবারই আছে । একদিকে বোর হোলের মধ্যে ক্যাপসুল আটকে যেতে পারে । খনির ভিতরে বিপজ্জনক গ্যাস থাকারও সম্ভাবনা । যশবন্ত গিল বলেন, "আমিই নামব নিচে"। এরপর ক্যাপসুলে তিনি নিচে নামেন । একে একে তাঁর চেষ্টায় 65 জন শ্রমিক উঠে আসেন সারারাত ধরে ।
16 নভেম্বর ভোরের আলো যখন ফুটছে, তখন সব শেষে উঠে আসেন যশবন্ত গিল । সবাইকে নিরাপদে উঠিয়ে শেষে উঠেছিলেন নিজে । এই খবরে সারা দেশ তোলপাড় হয়ে যায় । রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এসে গিল সাহেবকে শুভেচ্ছা জানান ৷ শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিয়ে খোঁজ নিয়ে যান । জাতীয় বীরের উপাধি পান যশবন্ত গিল । বছর তিনেক আগে পঞ্জাবে মৃত্যু হয়েছে গিল সাহেবের ।
মহাবীর খনির সেই দুর্ঘটনা ও উদ্ধারকাজ নিয়ে চলচিত্র নির্মিত হচ্ছে, যার নাম ক্যাপসুল গিল (Capsule Gill)। গিল সাহেবের ভুমিকায় অভিনয় করছেন অক্ষয় কুমার । শোনা যাচ্ছে, তিনি শুটিং করতে আসবেন রানিগঞ্জের মহাবীর খনিতে । সে জন্য উচ্ছ্বসিত হয়ে অপেক্ষা করছেন খনি শ্রমিক ও এলাকাবাসীরা ।
তবে ওই দুর্ঘটনার পর বন্ধ হয়ে গিয়েছে মহাবীর খনির উৎপাদন । বন্ধ খনির শ্রমিক থেকে শুরু করে স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, ঐতিহাসিক এই খনিটি আবার চালু করা হোক । খনিতে 100 বছরের কয়লা মজুত আছে । খনিটি পুনরায় চালু হলে, তবেই প্রকৃত মর্যাদা দেওয়া হবে যশবন্ত গিল সাহেবকে ।