আসানসোল , 1 সেপ্টেম্বর : বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো । ইতিহাস এবং জনশ্রুতি মিলে দুর্গাপুজো ঘিরে তৈরি হয়েছে নানা মিথ । বিশেষ করে বনেদি বাড়ির পুজোয় । বিভিন্ন নিয়ম-কানুন এবং প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা বেশ কিছু রীতি এই পুজোগুলিকে অন্য পরিচয় দেয় । তেমনই একটি পুজো কুলটির মিঠানি গ্রামের চক্রবর্তী পরিবারের দুর্গাপুজো । এখানকার দুর্গাপুজোয় এক অদ্ভুত নিয়ম আছে । এখানকার সন্ধিপুজোয় সন্ধিক্ষণ নির্ধারিত হয় জলঘড়ির মাধ্যমে । যাকে সহজ বাংলায় বলা হয় "তামি"। শুধু তাই নয় , সন্ধিক্ষণ নির্ধারিত হলে , সেই বার্তা আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামে পৌঁছে যায় রিলে পদ্ধতির মাধ্যমে ।
কুলটির মিঠানি গ্রামের চক্রবর্তী পরিবার । প্রায় 400 বছরের পুরানো চক্রবর্তী বাড়ির এই পুজো । এই দুর্গাপুজোর একটি ইতিহাস আছে । পরিবার সূত্রে জানা গেছে , চাষ করতে গিয়ে বাড়ির লাগোয়া দুর্গামন্দিরের সামনে পাওয়া গিয়েছিল মায়ের অষ্টধাতুর মূর্তি । ওই মূর্তিকে দুর্গামন্দিরের বেদির তলায় প্রতিষ্ঠা করা হয় । এরপর থেকে ওই বেদির উপর দুর্গাপ্রতিমা তৈরি করে পুজো শুরু হয় । আজও চক্রবর্তী পরিবারে একইভাবে পুজো হয়ে আসছে । সাধারণত সাবেক প্রতিমা তৈরি করা হয় । তবে সেক্ষেত্রে একটি অভিনব দিক আছে । এখানকার প্রতিমায় গণেশ এবং কার্তিকের অবস্থান হয় উলটো দিকে । অর্থাৎ আমরা যেমন দেখতে পাই , এখানে ঠিক তার উলটো ।
শুধু তাই নয় , এই দুর্গাপুজোয় আরও কয়েকটি নিয়ম আছে । এখানে অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণ নির্ধারিত হয় জলঘড়ির মাধ্যমে । কী এই জলঘড়ি ? একে সহজ বাংলায় বলা হয় তামি । অর্থাৎ তামার একটি বাটি থাকে । সেই বাটির মধ্যে একটি ছিদ্র থাকে । জলভরতি মাটির পাত্রের মধ্যে সেই তামার বাটি ভাসিয়ে দেওয়া হয় । এরপর সেই বাটিটি যখন জলের মধ্যে ডুবে যায় , তখন তাকে এক তামি বলা হয় । পঞ্জিকা মতে , কত তামিতে সন্ধি হবে তা নির্ধারণ করা থাকে । আর সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের নিয়ম মেনে তামি সেই জলের উপর বসানো হয় ও সন্ধিক্ষণ নির্ধারণ করা হয় । চক্রবর্তী পরিবারের লোকেদের দাবি তামির সাহায্যে সন্ধিক্ষণ নির্ধারণ একেবারে নির্ভুল হয় । এই প্রসঙ্গে চক্রবর্তী পরিবারের এক সদস্য স্বরূপ চক্রবর্তী বলেন , " আগে কোনও ঘড়ি ছিল না । সেকারণেই তামি ব্যবহার করা হত । এক তামি হতে প্রায় 25-26 মিনিট সময় লাগে । পঞ্জিকায় যদি লেখা থাকে যে 17 তামিতে 4.45 মিনিটে সন্ধিপুজো হবে , তাহলে ওই সময়ই হয় । একেবারে নির্ভুল । "
এই তামির প্রথা কোথা থেকে এসেছে ? এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন , " এই পুজো সাধারণত তিন জায়গায় আছে । এক হচ্ছে কাশীপুরের রাজার পুজো , আমাদের পুজো এবং বর্ধমানে একটি পুজো আছে । তবে কোথা থেকে এই পুজো এসেছে তা জানি না । এই তামি বসায় গ্রহাচার্যরা । বংশ পরম্পরায় তাঁরাই এই দিকটা দেখে আসছেন । তাঁরাই সমস্ত নির্ঘণ্ট তৈরি করেন । "
শুধু তাই নয় , চক্রবর্তীদের পুজোয় আরও একটি অদ্ভুত নিয়ম আছে । সন্ধিক্ষণ নির্ধারিত হলে সেই সন্ধি ডাক আশপাশের আরও পাঁচটি গ্রামে পৌঁছে যায় রিলে পদ্ধতির মাধ্যমে । অর্থাৎ আশপাশে পাঁচটি গ্রাম থেকে চক্রবর্তী মন্দির পর্যন্ত গ্রামবাসী নির্দিষ্ট দূরত্বে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে । যেই সন্ধিপুজো শুরু হয় তখনই রিলে পদ্ধতির মাধ্যমে মুখে মুখে সেই বার্তা পৌঁছে যায় আশপাশের গ্রামগুলিতে । তারপরে ওই গ্রামে সন্ধিপুজোর বলিদান হয় । এখনও এই প্রথা চালু আছে । আর তাই চক্রবর্তী মন্দিরের সন্ধিপুজো দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ভিড় জমান । কিন্তু এই বছর কোরোনা পরিস্থিতির কারণে কী হবে তা এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি । সেই কারণে এখনও প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হয়নি । যদিও মন্দির চত্বরে খড় , মাটি রাখা আছে । দ্রুত সেই কাজ শুরু হবে বলে পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন ।
এই বিষয়ে চক্রবর্তী পরিবারের অপর এক সদস্য স্বরূপ চক্রবর্তী বলেন , " এখানকার পুজো শুধুমাত্র মিঠানি গ্রাম নয় , আশপাশের গ্রামের কাছে বড় উৎসব । তবে কোরোনা পরিস্থিতিতে এই বছর পুজো কেমন হবে জানি না । আশা করছি , মায়ের আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে । "
পুজো হবে কি না সেই বিষয়ে চিন্তায় রয়েছে গ্রামবাসীও । কারণ, চক্রবর্তী পরিবারের সন্ধিপুজোর জন্য প্রত্যেক বছর অপেক্ষা করে থাকে তারা । কিন্তু কেউ আশা ছাড়েননি । ফের একইভাবে পুজো কাটানোর অপেক্ষায় চক্রবর্তী পরিবার থেকে গ্রামবাসী ।