আসানসোল, 15 অগস্ট: ধুমধাম করে পালিত হচ্ছে 'আজাদি কা অমৃত মহোৎসব' । স্বাধীনতার উৎসবে সামিল আসানসোলের খনি, শিল্পাঞ্চলের মানুষও। অথচ পরাধীন ভারতে যে অসীম সাহসী মহিলা ব্রিটিশ অত্যাচারের হাত থেকে খনি অঞ্চলের শ্রমিকদের রেহাই দিয়েছিলেন (Bimal Pratibha Devi is forgotten in depths of time) । অথচ ব্রিটিশ পুলিশদের 'যম' হয়ে ওঠা সেই 'হান্টারওয়ালি' বিমলপ্রতিভা দেবীকে আর মনে রাখেনি আসানসোলের খনি ও শিল্পাঞ্চল । স্বাধীনতার 75 বছর পূর্তিতে কোথাও একবারের জন্য উচ্চারিত হল না বিমলপ্রতিভা দেবীর নাম । তাঁর ছবি তো দূরের কথা । কুইলাপুর, ঢাকেশ্বরী এলাকায় একটি রাস্তা শুধু তাঁর নামে করা হয়েছে । যার ফলকও মুছে যাচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে । তবে কি কালের অতলেই হারিয়ে গেলেন বিমল প্রতিভা দেবী? এ প্রজন্মের বেশীরভাগই জানে না তাঁর কথা ।
মুখে জ্বলন্ত সিগার । ঘোড়া ছুটিয়ে রানিগঞ্জ খনি এলাকায় ঘুরে বেড়াতেন 'হান্টারওয়ালি' বিমলপ্রতিভা । ব্রিটিশ আমলে কয়লাখনির শ্রমিকদের উপর অত্যাচারের খবর পেলেই ছুটে যেতেন তিনি । চাবুকের ঘায়ে জব্দ করতেন ব্রিটিশ অত্যাচারীদের । আসানসোলের প্রবীণ মানুষদের কাছে এ গল্প আকছার শোনা যেত । কিন্তু পুরনো মানুষজনেরা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্বাধীনতা সংগ্রামী বিমল প্রতিভাদেবীর ইতিহাস মুছে যাচ্ছে ।
আরও পড়ুন: স্বাধীন ভারতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইন এবং সুপ্রিম রায়
1901 সালে ডিসেম্বরে ওড়িশার কটক শহরে জন্ম হয়েছিল বিমলপ্রতিভা দেবীর । বাবা ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় । স্বদেশী আন্দোলন সমর্থন করতেন । নানাভাবে বিপ্লবীদের সাহায্য করতেন । বাবার আদর্শেই স্বদেশী আন্দোলনে আকৃষ্ট হওয়া বিমলপ্রতিভা দেবীর। শোনা যায় কলকাতায় একটি বনেদী রক্ষণশীল বাড়িতে তাঁর বিয়েও হয়েছিল । কিন্তু দেশপ্রেম তাঁকে বেশিদিন সংসারে আটকে রাখতে পারেনি । ভারত মায়ের শৃঙ্খলা মোচনে তিনি সশস্ত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন । পরবর্তীকালের ভগৎ সিংয়ের সংস্পর্শে এসে তিনি 'নওজওয়ান সভা'য় যোগ দেন । দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বোন ঊর্মিলা দেবীর প্রতিষ্ঠিত 'নারী কর্মমন্দির'-এও তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন বিমলপ্রতিভা। কংগ্রেসে যোগ দিলেও নরমপন্থী আন্দোলন মানেননি । 1930 আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দেন বিমলপ্রতিভা ।
1931-এ ভগৎ সিং-সহ তিন বিপ্লবীর ফাঁসির প্রতিবাদে বাংলায় সশস্ত্র গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন তিনি । 1931 উল্টোডাঙা ডাকাতি মামলা, 1932 কুমিল্লার ম্যাজিস্ট্রেট হত্যা মামলায় একাধিকবার গ্রেফতার হন বিমলপ্রতিভা । জেলে বসেই সাহিত্য রচনা করেন । লেখেন 'নতুন দিনের আলো' উপন্যাসটি । এই উপন্যাসটিতে তাঁর বামপন্থী মানসিকতার স্পষ্ট দিকগুলি লক্ষ্য করা যায় । সুভাষচন্দ্র বসু ফরওয়ার্ড ব্লক তৈরি করলে তাতেও যোগ দেন বামপন্থী বিমলপ্রতিভা ।
আরও পড়ুন: দেশ বদলে দিয়েছিল যে সব সিদ্ধান্ত, স্বাধীনতার হীরক জয়ন্তীতে ফিরে দেখা একনজরে
1942 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে গ্রেফতার হন বিমলপ্রতিভা । 1945-এ মুক্তি পাওয়ার পর তিনি যুক্ত হন বিএলপিআই সংগঠনের সঙ্গে । 1942-এ এই দলে যোগ দেওয়ার পর চলে আসেন রানিগঞ্জ খনি এলাকায় । থাকতে শুরু করেন রানিগঞ্জে কয়লাখনি মজুরদের বস্তিতে । সেইসময় ঘোড়া ছুটিয়ে চলতেন তিনি । কোমরে থাকত রিভলভার । হাতে চাবুক আর মুখে জ্বলন্ত সিগার । শ্রমিকদের উপর ব্রিটিশ অত্যাচারের কথা শুনলেই ছুটে যেতেন হান্টারওয়ালি বিমল প্রতিভা দেবী ।
ব্রিটিশ পুলিশদের কাছে ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন তিনি । স্বাধীনতার পর শ্রমিকদের দাবিদাওয়া আদায়ে নানান আন্দোলন সংগঠিত করেন তিনি । পাশাপাশি শ্রমিক কল্যাণে নানান সমাজসেবাও করেন । জীবনের শেষ বয়সে তিনি হীরাপুরের ঢাকেশ্বরী সূর্যনগর এলাকায় চলে আসেন । দামোদরের ধারে একটি আবাসনে থাকতেন তিনি । স্থানীয় মানুষজনদের কথায়, তাঁর শেষ জীবনটা ছিল বড়ই কষ্টের। কষ্ট নিয়েই চলে যেতে হয়েছিল তাঁকে । মৃত্যুর পর ঢাকেশ্বরী সূর্যনগর এলাকায় একটি রাস্তাকে বিমলপ্রতিভার নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছে বটে, কিন্তু আর তাকে মনে রাখে না শিল্পাঞ্চল খনি অঞ্চলের বিশিষ্টজনেরা । সবমিলিয়ে এই প্রজন্মের কাছে স্মৃতির অতলে হারিয়ে গিয়েছেন স্বাধীনতা সংগ্রামী বিমল প্রতিভা ।