কল্যাণী, 11 জানুয়ারি: জন্মগত ভাবে পুরুষ ৷ কিন্তু মননে নারী ৷ সেই কারণেই কল্যাণীর গ্রামের ছাপোসা সন্তানের রঞ্জন থেকে সৃজা হয়ে ওঠার সফরটা সহজ হয়নি ৷ ঘরে-বাইরে নানা গঞ্জনার মুখে পড়তে হয়েছে ৷ তবে লক্ষ্যে অটুট ছিলেন আজকের সৃজা ৷ আর তাঁর দৃঢ়চেতা মনোভাব দেখে রূপান্তরকামী সন্তানকে মেনে নিয়েছিল পরিবার ৷ সৃজাকে তারা এগিয়ে দিয়েছিল স্বাভাবিক জীবনের পথে ৷ আজ সেই সন্তানই গ্ল্যামার দুনিয়ায় দেশের নাম উজ্জ্বল করেছে ৷ আন্তর্জাতিক ফ্য়াশন শোতে ভারত সেরার মুকুট উঠেছে সৃজার মাথায় ৷
নদিয়ার কল্যাণী 3 নং ওয়ার্ডের কাঁঠালতলার বাসিন্দা ছিলেন রঞ্জন ঘোষ । বাবা-মায়ের তিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে কনিষ্ঠ সন্তান ৷ রয়েছে এক দাদা ও দিদি ৷ অভাবের সংসারে কোনওরকমে শুরু করেছিলেন পড়াশোনা । মাধ্যমিকে দুইবার অসফল হওয়ার পর তিনি লেখাপড়া ছেড়ে দেন । মা ছোট ছেলের নাম রেখেছিলেন রঞ্জন ৷ তবে সে যত বড় হতে থাকে, ততই তাঁর মধ্যে প্রকট হয় নারীসুলভ মনোভাব ৷ পরিবারকে প্রথম দিকে কিছু জানাননি ৷
প্রথমে তিনি একটি দোকানে কাজের কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন । পরবর্তীকালে রূপান্তরকামী হয়ে নিজের নাম বদলে দেন ৷ রঞ্জনই হয়ে ওঠেন সৃজা ৷ প্রথমে কলকাতা আলপিন ওয়েলফেয়ার সোসাইটি পরিচালিত একটি ফ্যাশন শোতে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন । সেখানে মদন মিত্র, রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো গ্ল্যামার দুনিয়ার পরিচিত মানুষজনের কাছ থেকে দারুণ উৎসাহ পান তিনি । সেই শুরু ৷ আর ফিরে তাকাননি ৷ সমাজের যাবতীয় ট্যাবুকে পেছনে ফেলে সৃজা নিজের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেন ৷
দিনকয়েক আগে কানপুরে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন শোতে অংশগ্রহণ করে ভারতসেরা হয়েছেন । একজন রূপান্তরকামী হয়েও দেশকে সবার শীর্ষে তুলে ধরতে পেরে তিনি আপ্লুত ৷ সৃজা জানাচ্ছেন, সমাজে তাঁর মতো রূপান্তরকামীরা যেন হেরে না যান । লড়াই করে সমাজে নিজেকে নিজের পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে পারাটাই আসল লক্ষ্য হওয়া উচিত ৷
সৃজা বলেন, "এই সাফল্যের পিছনে অনেক বাধা-বিপত্তি এসেছে । একদিকে যেমন পরিবারের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে, অন্যদিকে সমাজের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে । আমি রূপান্তরকামী এ কথা বলায় অনেকে হাসি বিদ্রুপ করেছে, তা মেনে নিতে হয়েছে । কখনও কখনও মনে হয়েছে সমাজ আমাদের ভালোভাবে নিচ্ছে না । তবুও মনের জোর ছিল ৷ সমাজের বাধা-বিপত্তি পার করে আমি এই সাফল্য অর্জন করেছি ।" সমাজে যাঁর তাঁর মতো আছেন, তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন সৃজা ৷
তাঁর এই সাফল্যে খুশি সৃজার পরিবার ও প্রতিবেশীরাও ৷ সৃজার মা সুমনা ঘোষ বললেন, "প্রাথমিকভাবে ও সবকিছু আমাদেরকে না জানালেও পরবর্তীকালে আমরা তার যে ভাবনা সেটা বুঝতে পারি ৷ কিছু বাধার মুখে পড়তে হয়েছে ৷ তবে পরে আমরা ওর পাশে থেকেছি, সাহায্য করেছি ।"
সৃজা আরও একটা দৃষ্টান্ত ৷ তিনি আবারও প্রমাণ করলেন যে রূপান্তরকামীরাও সমাজেরই একটা অংশ ৷ দেশ ও সমাজের ভালো-মন্দের অংশীদার ৷ তাঁরাও আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো দেশকে গর্বিত করেন ৷ নিজের পরিবার ও সমাজকেও গর্বিত করেন ৷ ঠিক যেমনটা করেছিলেন স্মরণ্যা ঘোষ ৷ উচ্চমাধ্যমিকে সপ্তম স্থান অধিকার করেছিলেন এই রূপান্তরকামী ৷
আরও পড়ুন: