বহরমপুর, 28 জুলাই : এক সময়ে বাংলা-বিহার-ওড়িশার রাজধানী মুর্শিদাবাদের ইতিহাস প্রসিদ্ধ জেলা । জেলার সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে নবাবি আমল এবং ব্রিটিশ আমলের ইতিহাসের নানা খুঁটিনাটি তথ্য । এমনই এক প্রাচীন ইতিহাস জড়িয়ে আছে বহরমপুর শহরের প্রাণকেন্দ্র ব্যারাক স্কয়্যার মাঠের সঙ্গে । 1857 সালের 26 ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ বাহিনীর 19 পদাতিক বাহিনী বা নেটিভ রেজিমেন্ট প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে । ইতিহাসে সেটিই ছিল সিপাহী বিদ্রোহের বা মহাবিদ্রোহের সূচনা । সেদিন বিদ্রোহী সেনাদের 4টি কামানের সামনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করেছিল গোরা সেনারা । ইতিহাসের সাক্ষ্য হিসেবে সেই কামানগুলি ব্যারাক স্কয়্যারের চারপাশে পড়ে রয়েছে অযত্নে, অবহেলায় । বারবার কামানগুলি সংরক্ষণের দাবি উঠেছে । ইতিহাসবিদদের দাবি, এই কামানগুলি ইতিহাসের অন্যতম সাক্ষ্য । সেগুলিকে পর্যটকদের সামনে মেলে ধরা হোক । কিন্তু নির্বাক মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসন ।
1757 সালের 23 জুন পলাশির প্রান্তরে ভারতের স্বাধীনতার শেষ সূর্য অস্তমিত হয় । ব্রিটিশ বাহিনীর সামনে সম্মুখ সমরে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যাওয়ার পথে রাজমহল থেকে ধরা পড়েন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদদৌলা ৷ 1757 সালের 24 জুন মিরজ়াফরকে বাংলা-বিহার-ওড়িশার নবাব হিসেবে ঘোষণা করেন রবার্ট ক্লাইভ । কিন্তু মির্জ়াপুর থেকে শুরু করে পরবর্তী নবাবরা কেউ স্বাধীন নবাবের আখ্যা পাননি । কারণ দেওয়ানি ছিল ব্রিটিশদের হাতে । 1765 সালে মিরজ়াফরের কাছ থেকে 400 বিঘা জমি চেয়ে নিয়ে বহরমপুর শহরে ক্যানটনমেন্ট গড়ে তোলে ব্রিটিশ বাহিনী । 1765 থেকে 1767-র মধ্যে গড়ে ওঠে বহরমপুর ৷ ব্রিটিশদের তৈরি কলকাতার পর এটি দ্বিতীয় পরিকল্পিত শহর । বহরমপুর ব্যারাক স্কয়্যারের পূর্ব প্রান্তে তৈরি করা হয় ওল্ড কালেক্টরেট বিল্ডিং । যেখানে 1869 থেকে 1874 সাল পর্যন্ত ডেপুটি কালেক্টর পদে নিযুক্ত ছিলেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় । তার উলটো দিকে ছিল ব্রিটিশদের গোলা-বারুদের ঘর ম্যাগাজ়িন বিল্ডিং । আর মাঠের চারদিকে সেনাদের থাকার জন্য শিবির তৈরি করা হয় । সেই বিল্ডিংগুলি আজও অক্ষত হয়ে ইতিহাসের সাক্ষ্য হিসাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে । 1857 সালের 26 ফেব্রুয়ারি এই মাঠে প্রথম ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন 19 নেটিভ রেজিমেন্ট বা পদাতিক বাহিনী । উত্তর 24 পরগনার ব্যারাকপুর থেকে মহা বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল এমনটা দাবি করা হলেও ইতিহাস কিন্তু ভিন্ন কথা বলে । ঐতিহাসিকদের মতে বহরমপুর ব্যারাক স্কয়্যার মাঠ থেকে সূচনা হয়েছিল সেদিনের মহাবিদ্রোহের । সেদিন এই মাঠে বিদ্রোহী সেনাদের কামানের সামনে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে হত্যা করেছিল ব্রিটিশরা । চেষ্টা করেছিল বিদ্রোহ দমনের । কয়েকশো পদাতিক বাহিনীকে সেদিন যে কামানগুলির সামনে প্রাণ দিতে হয়েছিল সেগুলি এখন মাটি আঁকড়ে পড়ে রয়েছে বহরমপুরে ৷ বহরমপুরের ফুসফুস ব্যারাক স্কয়্যার মাঠের পাশে গড়ে তোলা হয়েছে শহিদ বেদি । সেখানে মাল্যদান করে অনেকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন । কিন্তু ইতিহাস সম্পর্কে স্থানীয় মানুষজন একপ্রকার অজ্ঞাত ৷ বিলীন হতে বসেছে ইতিহাসের অন্যতম সম্পদ কামানগুলি ।
প্রায় দু'শো বছরের ইতিহাস বুকে আগলে রাখলেও কামানগুলি নিতান্ত অবহেলায় পড়ে রয়েছে মাঠের চার প্রান্তে । রোদ-বৃষ্টিতে মরচে পড়তে শুরু করেছে । খসে খসে পড়ছে আস্তরণ । একদিন হয়ত এভাবে মিটে যাবে মহাবিদ্রোহের অন্যতম প্রমাণ । জেলার বিভিন্ন মহল থেকে বারবার কামানগুলি সংরক্ষণ এবং সেগুলি পর্যটকদের সামনে তুলে ধরার দাবি উঠেছে । মুর্শিদাবাদ জেলা ইতিহাস ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রের সম্পাদক অরিন্দম রায় বলেন, ‘‘ইতিহাস নির্ভরশীল মুর্শিদাবাদ জেলা । কামানগুলি সংরক্ষণের কথা আমরা বারবার বলে আসছি । সেগুলি সংরক্ষণ করে পর্যটকদের সামনে তুলে ধরলে এই জেলা আরও সমৃদ্ধ হত ।’’ নুরুল হাসান কলেজের অধ্যাপক সমিত ঘোষ বলেন, ‘‘এইসব সাক্ষ্য প্রমাণের হাত ধরে ছাত্র-ছাত্রীরা ইতিহাসের অজানা দিকগুলি জানতে পারবে । সেই হিসেবে কামানগুলিকে সযত্নে সংগ্রহ করে পর্যটকদের সামনে তুলে ধরা উচিত বলে আমি মনে করি । সরকারি উদ্যোগের অভাবে কামানের সংরক্ষণ হচ্ছ না । জল কাদায় পড়ে পড়ে নষ্ট হতে বসেছে সেগুলি । কবে প্রশাসনের নজরে আসবে জানি না ।’’ বহরমপুর পৌরসভার প্রোজেক্ট কো-অর্ডিনেটর নাড়ুগোপাল মুখোপাধ্যায় জানান, ‘‘ব্যারাক স্কয়্যারের পাশের বিল্ডিংগুলির সংস্কারের কাজ শুরু করেছেন জেলাশাসক ৷ মাঠ ঘিরে দিয়েছে পৌরসভা ৷ ভবিষ্যতে ঐতিহাসিক তথ্যের সংস্কার করা হবে ৷ ব্যারাক স্কয়্যারের মধ্যে লাইট অ্যান্ড সাউন্ডের ব্যবস্থাও করা হবে ৷ কিছু স্পনসরশিপ পাওয়া গেছে ৷ বাকি কাজ চলছে ৷’’