মালদা, 6 নভেম্বর: মালদা জেলায় নীরবে বেড়ে চলেছে ঘাতক থ্যালাসেমিয়া ৷ ছোট্ট এই জেলায় বর্তমানে এই রোগে আক্রান্ত এবং বাহকের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে ৷ এই রোগের সবচেয়ে বেশি দাপট বামনগোলা ব্লকে ৷ স্বাস্থ্য দফতরের তথ্য বলছে, জেলায় আক্রান্তদের মধ্যে 50 শতাংশের বেশি এই ব্লকেই ৷ সচেতনতার অভাবের জন্যই একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মধ্যে এই রোগ বেশি ছড়াচ্ছে বলে জানাচ্ছেন স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা ৷ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্কুল ও কলেজগুলিতে ভর্তির সময় থ্যালাসেমিয়া টেস্ট বাধ্যতামূলক করার দাবি তুলছে রক্ত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ৷ যদিও সরকারের নির্দেশ ছাড়া সেটা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দিয়েছে স্বাস্থ্য দফতর ৷ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তদের জন্য জেলায় ফেনোটাইপড ব্লাড ইউনিট দেওয়ার দাবিও তুলতে শুরু করেছে ৷
এই জেলায় রক্ত আন্দোলনের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত অনিলকুমার সাহা ৷ তিনি জানাচ্ছেন, মালদায় সবচেয়ে বেশি থ্যালাসেমিয়ার বাহক ও আক্রান্তের সন্ধান মিলেছে বামনগোলা ব্লকে ৷ কিছুদিন আগে এই ব্লকের বিভিন্ন স্কুলে থ্যালাসেমিয়ার স্ক্রিনিং টেস্ট করা হয়েছিল ৷ তার ফলাফল চমকে দেওয়ার মতো ৷ দেখা যায়, প্রতিটি স্কুলেই প্রচুর থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত ছেলেমেয়ে রয়েছে ৷ বাহক রয়েছে তারও বেশি ৷ এই জেলায় হাজারের কিছু বেশি থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রয়েছেন ৷ তাঁদের মধ্যে প্রায় 600 জনকে নিয়মিত রক্ত দিতে হয় ৷ মালদা জেলার একমাত্র ব্লাড ব্যাংকটি রয়েছে মালদা মেডিক্যাল কলেজে ৷ কিন্তু সেখানেও সবসময় রক্ত মজুত থাকে না ৷ বিশেষত গরম ও উৎসবের মরশুমে রক্তের আকাল চলে ৷ থ্যালাসেমিয়া রোগীদের সমস্যার মুখে পড়তে হয় ৷ তাঁদের ফেনোটাইপড রক্ত দেওয়া হলে এই সমস্যা অনেকটাই কমত ৷ তাতে তাঁদের বেশিদিন পরপর রক্তের প্রয়োজন হত ৷ থ্যালাসেমিয়া আক্রন্তের সংখ্যা কমাতে স্কুল-কলেজগুলিতে নিয়মিত স্ক্রিনিং করা প্রয়োজন ৷ দুঃখের বিষয়, বর্তমানে বামনগোলা ব্লকে সেই কাজ হচ্ছে না ৷ এটা স্বাস্থ্য দফতরের ব্যর্থতা ৷
এই প্রসঙ্গে জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সুদীপ্ত ভাদুড়ি বলেন,“বামনগোলায় থ্যালাসেমিয়ায় ক্লাস্টার রয়েছে ৷ এই রোগটি মূলত রাজবংশী এবং আদিবাসীদের মধ্যে বেশি দেখা যায় ৷ এই রোগ নিয়ন্ত্রণে সবার আগে প্রয়োজন সচেতনতা ৷ মূলত বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা ও কাউন্সেলিং খুব প্রয়োজন ৷ এই কাজ আমাদের সবসময়ই চলে ৷ এর দায়িত্বে রয়েছেন ডেপুটি সিএমওএইচ-২ ৷ তবে স্কুল-কলেজে ভর্তির সময় আমরা থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে পারি না ৷ এই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি সরকারি হতে হবে ৷ আর ফেনোটাইপড রক্ত রাজ্যের কোনও জেলায় সরাসরি পাওয়া যায় বলে আমার জানা নেই ৷ তবে থ্যালাসেমিয়া নিয়ে মালদায় সমস্যা রয়েছে৷”
আরও পড়ুন: চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গি, মালদা মেডিক্যাল চত্বরের অপরিচ্ছন্নতা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন
ডেপুটি সিএমওএইচ-২ অমিতাভ মণ্ডল জানান, এই জেলায় একটিমাত্র থ্যালাসেমিয়া কন্ট্রোল ইউনিট রয়েছে ৷ একটি ইউনিট নিয়ে খুব বেশি ক্যাম্প করা যায় না ৷ খুব বেশি হলে সপ্তাহে দুটি ক্যাম্প করা যায় ৷ মালদায় সবচেয়ে বেশি থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত এবং বাহক বামনগোলা ব্লকে ৷ নিজেদের রক্তের সম্পর্কের মধ্যে বিয়ে করার প্রচলন রয়েছে কি না জানা নেই, তবে দেখা গিয়েছে, রাজবংশী এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে এই রোগ সবচেয়ে বেশি হয় ৷ এটা মূলত জেনেটিক রোগ ৷ এই রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রক্ত পরীক্ষার ৷ বিভিন্ন স্কুল-কলেজে সেই পরীক্ষা করা হয় ৷ কিন্তু তাতেও ঝামেলা রয়েছে ৷ যাদের রক্তে থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ে, তাদের বেশিরভাগই বাড়িতে কিছু জানায় না ৷ তারা ভয়ে থাকে, এই রোগের কথা জানাজানি হলে তাদের বিয়ে আটকে যেতে পারে ৷ এতে আরও বেশি ক্ষতি হয় ৷ এই রোগ নিয়ন্ত্রণে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে ৷
মালদা মেডিক্যালের এমএসভিপি প্রসেনজিৎ বর দীর্ঘদিন প্যাথলজি নিয়ে কাজ করেছেন ৷ তিনি বলছেন, “দীর্ঘদিন ধরে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গিয়েছে, রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে এই রোগের প্রবণতা বেশি ৷ এই সম্প্রদায়ের মধ্যে রক্তের সম্পর্কে বিয়ে হয় বলেও জানা নেই ৷ তবু কেন এমনটা হয়, তা নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন ৷ তবে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে মানুষকে সচেতন করাই একমাত্র কাজ ৷”
আরও পড়ুন: উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাধীন বন্দির মৃত্যু ঘিরে চাঞ্চল্য
মালদা মেডিক্যালের অধ্যক্ষ পার্থপ্রতিম মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, বর্তমানে কলকাতার দু’একটি হাসপাতালে ফেনোটাইপড ব্লাডের ব্যবস্থা রয়েছে ৷ মালদা মেডিক্যালে এই ব্যবস্থা চালু করার প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো রয়েছে কি না সেটা সংশ্লিষ্ট বিভাগের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে জানা যাবে ৷ তবে এখানে হেমাটোলজি বিভাগ না থাকায় রক্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও নেই ৷ এক্ষেত্রে তাঁদের পরামর্শও জরুরি ৷ আগামী মাসে মেডিক্যালে রাজ্যের বেশ কয়েকজন রক্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আসবেন ৷ তাঁদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলা হবে ৷ তারপরেই এই ব্যবস্থা চালুর জন্য স্বাস্থ্য ভবনে প্রস্তাব পাঠানো যেতে পারে ৷