কালিয়াচক, 19 জুন : ইংরেজি থ্রিলার জিগ'শ-কে মনে করাচ্ছে কালিয়াচকের খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত আসিফ মেহবুব । সিনেমায় বাড়িটির সঙ্গে একটি সুড়ঙ্গ ছিল । সেই সুড়ঙ্গপথ দিয়েই যাতায়াত চলত । ছিল সিসিটিভি ক্যামেরার নজরদারি । বাড়ির ভিতরে তৈরি হত খুনের বিভিন্ন পন্থা । আসিফের কার্যকলাপেও অনেকটা একইরকম ।
বাড়িটাকে ঘিরে শুরু থেকেই কেমন একটা রহস্য রহস্য ভাব । সকালে পুলিশ বাড়ি ঢুকতে গিয়েই তাজ্জব বনে যায় । মৃতদেহ খুঁজে বের করবে কী, বাড়ির হালচাল দেখতে দেখতেই চক্ষু চড়কগাছ । বাড়ির গোডাউন লাগোয়া একটি সুড়ঙ্গপথ । প্লাইবোর্ড দিয়ে ঢাকা । চারিদিকে সিসিটিভি । বাড়ির প্রতিটি কোণায় লাগানো রয়েছে সিসিটিভি । সর্বক্ষণ চলে মনিটরিং । কে কখন আসছে, কে কখন যাচ্ছে সব নজরবন্দী করা হচ্ছে । যেন বাড়িটাকে ঘিরে রয়েছে কোনও এক অদ্ভুত গোপনীয়তা । বাড়িটাকে তৈরিও করা হয়েছে সেভাবেই । দোতলা প্লাস্টার করা বাড়িটায় বাইরের দিকে কোনও জানলা নেই । শুধুমাত্র লোহার পাত বসানো ঢালাও একটা দরজা । বাড়ির ভিতরে কী চলছে, বাইরে থেকে বোঝার কোনও উপায় নেই ।
সিসিটিভি ক্যামেরার সব তার গিয়ে মিশেছে দোতলার ঘরে । এই বাড়িটার দোতলার ঘরে বসেই সিসিটিভি ক্যামেরায় নজরদারি চালাত আসিফ ।
কালিয়াচকের এই বাড়িটাই এখন সংবাদ শিরোনামে । পরিবারের চার সদস্যকে বাড়ির মধ্যেই জলের ট্যাঙ্কে ডুবিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন । তারপর মা, বাবা, ঠাকুমা, বোন... চারজনের দেহ বাড়ির মধ্যেই পুঁতে দিয়েছিল ছোট ছেলে আসিফ মেহবুব । ফেব্রুয়ারির মাসের ঘটনা । জানাজানি হয় গতরাতে । এতদিন চুপ থাকার পর গতরাতে কালিয়াচক থানায় গিয়ে অভিযোগ জানায় বাড়ির বড় ছেলে । সেই মতো আজ সকালে বাড়িতে পুলিশ আসে । পুরো বাড়ি সিল করে দেওয়া হয়েছে ।
বাড়ির চারিদিকে অন্তত 16 টা সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো রয়েছে । সূত্রের খবর, পুলিশি তল্লাশিতে উদ্ধার রয়েছে চার-পাঁচটি ল্যাপটপ, কম্পিউটার । স্থানীয়রা বলছেন, বাড়ি থেকে খুব একটা বাইরে বেরোতে দেখা যেত না । খাবার দাবার বাড়িতে আসত অনলাইন অর্ডারে । পরিচারিকাকেও নাকি বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল না ।
বাড়িতে এই সিসিটিভিগুলি মাস ছয়েক আগে লাগানো হয়েছে । আসিফ নাকি কোনও হ্যাকিংয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল । এমন তথ্যও উঠে আসছে স্থানীয়দের কথায় । মাস দুয়েকে আগে নাকি পুলিশ এসে আসিফকে তুলেও নিয়ে গিয়েছিল । কিন্তু পরে আবার ছেড়ে দেওয়া হয় । সেই সময় পুলিশ ঘুরাক্ষরেও টের পায়নি বাড়ির মধ্যে চারজনের দেহ চাপা দেওয়া আছে ।
আরও পড়ুন : Malda Murder : চার মাস আগে পরিবারের চারজনকে খুন, বাড়িতে পুঁতে রেখে বাস ছেলের
এখানে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে । আসিফের বাড়ি থেকে না বেরানো, পরিচারিকাকে বাড়িতে ঢুকতে না দেওয়া... এসব কি শুধুই চারটে খুন চাপা দেওয়ার জন্য ? নাকি এর পিছনে অন্য কোনও কারণ রয়েছে ? সারাদিন বাড়িতে বসে কম্পিউটারে কী করত আসিফ ? এইসব প্রশ্নগুলির উত্তরই এখন খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে পুলিশ ।
মাধ্যমিক পরীক্ষার পর থেকে বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল আসিফ । দীর্ঘদিন বাড়ির বাইরে ছিল । কোথায় ছিল... কেউ জানে না । মাঝে মধ্যে বাবাকে ফোন করে টাকা চাইত । কীসের জন্য চাইত, জানা নেই । বাড়ির কাউকে সেবিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেনি আসিফ । বাবা টাকা দিলে সেই টাকা এটিএম থেকে তুলে নিত । এক জায়গায় বেশিদিন থাকতও না সে । মোবাইলের সিমও বদল করত ঘনঘন । কীসের থেকে লোকানোর চেষ্টা করছিল সে ? পুলিশের একাংশের প্রাথমিক ধারণা, সম্ভবত কোনও জঙ্গি গোষ্ঠীর পাল্লায় পড়েছে আসিফ । যদি তাই হয়, তাহলে কতদূর যোগ ছিল আসিফের ?
জঙ্গি-যোগের বিষয়টি যেমন উঠে আসছে, তেমনই উঠে আসছে আরও একটি তত্ত্ব । আসিফের বাবা জাওয়াদ আলি বিশাল সম্পত্তির মালিক । এলাকায় খুব একটা সুখ্যাতি ছিল না । নামে চাষবাস নিয়ে থাকলেও, দু'টি ডাম্পার ছিল তার । ছাইয়ের ব্যবসাও ছিল । তোলাবাজির অভিযোগও ছিল জাওয়াদের বিরুদ্ধে । কালিয়াচক এলাকার কুখ্যাত দুষ্কৃতী আনসারির দলের সদস্য ছিলেন জাওয়াদ ৷ আর জাওয়াদের বিষয়ে এই সংক্রান্ত তথ্যগুলি যখন প্রকাশ্যে আসছে, তখনও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে কী চলছিল ওই বাড়িতে ।
একটি সাধারণ বাড়িতে 16 টি সিসিটিভি ? একটি ছোটখাট বা মাঝারি আকারে কোনও অফিসেও হয়ত এতগুলি সিসিটিভি থাকে না । সেখানে শুধুমাত্র একটি বসতবাড়ির জন্য এতগুলি সিসিটিভি কীসের জন্য ? কী গোপন করার চেষ্টা চলছিল ওই বাড়িতে ? শুধুই কি তোলাবাজির সঙ্গে যুক্ত ছিল জাওয়াদ ? নাকি ছেলের মতো তারও হাত ছিল আরও অনেক দূর পর্যন্ত ? গোটা বিষয়টিই এখন ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছে ।
একইসঙ্গে আরও একটি প্রশ্ন উঠে আসছে । একজন 18-19 বছরের ছেলের পক্ষে একা একা কীভাবে বাড়ির চারজনকে এভাবে জলের মধ্যে মাথা ডুবিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করা সম্ভব ? আর তাও যখন চারজনের মধ্যে দু'জন বয়সের দিক থেকে যথেষ্টই শক্তসামর্থ্য হওয়ার কথা । গোটা কাজটা কি আদৌ একার হাতে করা সম্ভব ? আর আসিফের দাদাই বা এতদিন কেন চুপ করে ছিল ? যদি পুলিশকে জানানোরই হয়, তাহলে চার মাস পরে কেন ? কেন আগে কিছু জানাল না পুলিশকে ? এখনও পর্যন্ত যা খবর, তাতে আসিফের দাদা এতদিন কলকাতায় থাকছিল । তাহলে কলকাতার কোনও থানায় কেন জানাল না বিষয়টি ? তাহলে কি ঘটনার সঙ্গে সে নিজেও কোনওভাবে জড়িত ? কোনওকিছুই এখনও স্পষ্ট নয় । তদন্ত প্রক্রিয়া যত এগোবে তত এই ধোঁয়াশাগুলি কাটবে বলে আশা করছেন পুলিশের একাংশ ।