মালদা, 20 অগাস্ট : মাত্র 3 কিলোমিটার দূরে একই থানার দুই গ্রাম । দুই গ্রামে এখন দুই ছবি । এক গ্রামে যখন ছেলে হারানোর যন্ত্রণা, অন্য গ্রামে তখন আশঙ্কার আবহ । শনিবার কলকাতার আলিপুর বডিগার্ড লাইন্সের ভিতরে এক জলাশয়ে ভেসে উঠেছিল রতুয়া 2 ব্লকের পুখুরিয়া থানার মুরচা গ্রামের যুবক প্রসেনজিৎ সিংহের (28) দেহ । পুলিশের বেষ্টনীতে থাকা জলাশয় থেকে তাঁর দেহ উদ্ধারের ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়ায় পুলিশ মহলে । সেই ঘটনায় রবিবার কলকাতার ওয়াটগঞ্জ থানায়, পুখুরিয়া থানারই হরিপুর গ্রামের দুই ভাই বিশ্বজিৎ মণ্ডল ও ইন্দ্রজিৎ মণ্ডল সহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে ছেলেকে খুনের অভিযোগ দায়ের করেছেন প্রসেনজিতের বাবা উত্তমকুমার সিংহ । তিনিও রাজ্য পুলিশের একজন কর্মী । বর্তমানে উত্তর দিনাজপুর জেলার ইটাহার থানায় কর্মরত । কলকাতা পুলিশ তদন্ত শুরু করলেও এখনও পর্যন্ত তদন্তের স্বার্থে মালদা জেলা পুলিশের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করেনি । আটক করা হয়েছে বিশ্বজিৎ ও ইন্দ্রজিৎ মণ্ডলকে ৷
মুরচা গ্রামের সিংহ পরিবার পুলিশ পরিবার হিসাবে পরিচিত এলাকায় । উত্তমবাবুরা 6 ভাই । সবাই পুলিশে কর্মরত । ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সুভাষচন্দ্র সিংহ কলকাতা পুলিশে 42 বছর কাজ করার পর গতবছর অবসর নিয়েছেন । বাকি ভাইরা রয়েছেন রাজ্য পুলিশে । প্রসেনজিতের ঠাকুরদাও ছিলেন পুলিশকর্মী । এমন এক পরিবারের ছেলে কী ভাবে ষড়যন্ত্রের শিকার হল, সেটাই ভাবাচ্ছে গ্রামবাসীদের । তবে কি টাকার বিনিময়ে চাকরি দেওয়ার চক্রের শিকার হলেন প্রসেনজিৎ?
কলকাতায় ময়নাতদন্তের পর গতকাল ভোর চারটেয় মৃতদেহ ঘরে ফিরে এসেছিল প্রসেনজিতের । ভোরেই দেহ সৎকারে নিয়ে যাওয়া হয় । দুপুরে শ্মশান থেকে ফিরে আসার পর কথা বলার অবস্থায় ছিলেন না উত্তমবাবু । আর মাত্র 8 মাস চাকরি রয়েছে তাঁর । ছেলের শোকে বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন প্রসেনজিতের মা'ও । তাঁদের এক নিকটাত্মীয় উত্তম সিংহ বলেন, "টাকা দেওয়ার ঘটনাটি 2017 সালের । কলকাতা পুলিশে সাব-ইন্সপেক্টর পদে চাকরি করে দেবে বলে প্রসেনজিতের কাছে 6 লাখ টাকা দাবি করে ইন্দ্রজিৎ ও তার দাদা বিশ্বজিৎ । তারা স্থানীয় হরিপুর গ্রামের বাসিন্দা । তিন দফায় প্রসেনজিৎ তাদের তিন লাখ টাকা দেয় । টাকা দেওয়ার কথা সে প্রথমে বাড়ির কাউকে বলেনি । ইন্দ্রজিৎ নিজেও কলকাতা পুলিশে চাকরি করে । কলকাতাতেই কর্মরত । তার দাদা সেখানে একটি পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার । পরে উত্তমবাবুরা জানতে পারেন, ছেলে চাকরির জন্য তিন লাখ টাকা দিয়েছে । কিন্তু টাকা দিলেও প্রসেনজিতের চাকরি হচ্ছিল না । তাই তিন লাখ টাকা ফেরত চায় সে । আজ দেব, কাল দেব বলে তাকে ঘোরাচ্ছিল ইন্দ্রজিৎরা । শেষ পর্যন্ত প্রসেনজিৎ তাদের বলে, টাকা ফেরত না দিলে তারা মুখ্যমন্ত্রীকে গোটা ঘটনা জানাবে । এরপরই ইন্দ্রজিৎ টাকা ফেরত দিতে রাজি হয় । 20 দিন আগে তারা প্রসেনজিতকে কলকাতায় ডাকে । শেষ পর্যন্ত 9 আগস্ট তারা শেষবার প্রসেনজিতকে কলকাতায় যেতে বলে । সেই মতো সে নির্দিষ্ট দিনে কলকাতা পৌঁছে যায় । 16 অগাস্ট রাত পৌনে একটা নাগাদ প্রসেনজিৎ তার বাবাকে ফোন করে জানায়, পরদিন সে বাড়ি ফিরে আসবে । এরপরই তার ফোন সুইচ অফ হয়ে যায় । শনিবার সকালে তার দেহ আলিপুর বডিগার্ড লাইন্সের ভিতরে একটি জলাশয় ভাসতে দেখা যায় । সম্ভবত ইন্দ্রজিতই প্রসেনজিৎকে বডিগার্ড লাইন্সে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল । এই ঘটনায় আমরা যথাযথ পুলিশি তদন্ত দাবি করছি ।"
এই সংক্রান্ত আরও পড়ুন : আলিপুর বডিগার্ড লাইন্সের জলাশয়ে ডুবে মৃত্যু প্রসেনজিতের ! আটক 2
এদিকে হরিপুর গ্রামে বিশ্বজিৎ ও ইন্দ্রজিতের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সামনে ভুট্টা ছড়াচ্ছেন তাঁদের মা চঞ্চলাদেবী ও ছোটো ভাই সত্যজিৎ । 11 মাসের ছেলে অংশুজিৎকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ইন্দ্রজিতের স্ত্রী অর্পিতা । মাত্র দু'বছর আগে বিয়ে হয়েছে তাঁর । তিনি এই ঘটনায় ক্যামেরার সামনে কিছু বলতে অস্বীকার করেন । তবে দুই ছেলের বিরুদ্ধে পুলিশে খুনের অভিযোগ দায়ের হওয়ার কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন চঞ্চলাদেবী । কেঁদে ফেলে সত্যজিৎও । সে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে সবে কলেজে ভরতি হয়েছে । চঞ্চলাদেবী কোনওরকমে বলেন, "আমার ছেলেরা কোনওদিন এমন কাজ করতে পারে না । গ্রামের কেউ আমাদের বিষয়ে কোনও অভিযোগ করতে পারবে না ।" সত্যজিৎ বলে, "গত সপ্তাহে বাবা কাঞ্চন মণ্ডল ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন । শুক্রবার সকালে তাঁকে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভরতি করা হয়েছে । আমার দুই দাদা তাঁকে দেখাশোনা করছে । আমার মেজো দাদা (ইন্দ্রজিৎ) থাকে পাতিপুকুরে । বড় দাদা (বিশ্বজিৎ) থাকে শ্যামবাজারে । আমার দাদারা কখনও কাউকে খুন করতে পারে না । টাকার জন্য আমরা বাবার চিকিৎসা ঠিকমতো করাতে পারছি না । বাড়িঘর ঠিক করতে পারছি না । আর আমার দাদারা অন্যের কাছ থেকে টাকা নেবে ৷ এসব অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যে । প্রসেনজিৎ কিংবা তার বাবাকে আমরা চিনি না । আমাদের সঙ্গে তাদের কোনও যোগাযোগও নেই । কেন আমাদের ফাঁসানো হচ্ছে জানি না ।"
তবে রতুয়া 2 এলাকায় টাকার বিনিময়ে চাকরি দেওয়ার একটি চক্র সক্রিয় থাকার অভিযোগ করছেন মুরচা গ্রামের লোকজন । গ্রামবাসীদের তরফে ধনঞ্জয় সিংহ বলেন, "প্রসেনজিৎ খুব ভালো ছেলে ছিল । সৎ হিসাবে এলাকায় তার পরিচিত ছিল । অন্যের বিপদে পাশে দাঁড়াত । কোনও নেশাও ছিল না তার । চাকরি পেতে সে কী লেনদেন করেছে তা জানি না । শুনেছি, সে 9 তারিখ কলকাতা গেছিল । শনিবার শুনতে পাই, সে মারা গেছে । এই গ্রামের ছেলেরা চাকরির জন্য অনেককে টাকা দিয়েছে । কিন্তু কারও চাকরি হয়নি । কেউ পুলিশে অভিযোগও দায়ের করেনি । আসলে প্রথমে আমরা এসব বিষয়ে জানতেই পারছি না । পরে জানতে পারছি । তাই আমরাও পুলিশ কিছু জানাতে পারছি না । প্রসেনজিতের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ।" গ্রামের আরেক বাসিন্দা জনার্দন সিংহ বলেন, "এখানে এই চক্র রমরমিয়ে কাজ করছে । এবার প্রথম এনিয়ে পুলিশে কোনও অভিযোগ দায়ের হল । আইনের মাধ্যমেই এই চক্রের ব্যবসা বন্ধ করা যাবে । এই চক্রের দালালদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করা উচিত ।"
পুখুরিয়া থানার পুলিশ জানিয়েছে, এই ঘটনায় শনিবার কলকাতা পুলিশের পক্ষ থেকে ওই যুবকের মৃতদেহ উদ্ধারের কথা তাঁর পরিবারকে জানিয়ে দিতে বলা হয়েছিল । তারপর কলকাতা পুলিশের পক্ষ থেকে আর কোনও যোগাযোগ করা হয়নি । কলকাতা পুলিশকে সবরকম সহযোগিতা করার জন্য থানা তৈরি রয়েছে ।