মালদা, 19 জুলাই : কোরোনার জন্য দিতে হয়নি তিনটি বিষয়ের পরীক্ষা ৷ অথচ সেই তিনটি বিষয়েই জুটেছে 100 নম্বর ৷ আর তাতেই কেল্লাফতে ৷ রাজ্যের মেধাতালিকায় নিশ্চিতভাবে নাম উঠতে চলেছে পুরাতন মালদার যাত্রাডাঙা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রত্যন্ত পোপড়া গ্রামের প্রাণগোবিন্দের ৷ তাঁর এমন সাফল্যে উচ্ছ্বসিত গোটা গ্রাম ৷ কিন্তু, তাঁর মতো আরও অনেকের এমন অভাবনীয় ফল নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠেছে শিক্ষামহলেও ৷
প্রাণগোবিন্দ মণ্ডল ৷ বাবা ফুটুল মণ্ডল ৷ পেশায় ভাগচাষি ৷ নিজের জমিজায়গা কিছু নেই ৷ বাড়ির প্রতিটি কোনায় অভাবের ছাপ স্পষ্ট ৷ সংসার চালাতে মা নিভাদেবী কৃষি শ্রমিকের কাজ করেন ৷ প্রাণগোবিন্দরা চার ভাইবোন ৷ বড় দুই দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে ৷ ছোট ভাই এবার মাধ্যমিক পাশ করেছে ৷ এই পরিস্থিতিতে সংসারের প্রায় সব কাজই করতে হয় তাঁকে ৷ বাবা-মা কাজে বেরিয়ে গেলে রান্না সহ সংসারের যাবতীয় কাজের দায়িত্ব তাঁর ৷ সংসারে দু’পয়সার জোগান দিতে সে এলাকার লোকজনের জামাকাপড়ও সেলাই করে ৷ দেখাশোনা করতে হয় বাড়ির গবাদি পশুরও ৷ অন্যদিনের মতো গতকাল দুপুরেও মাঠে ঘাস কাটতে গিয়েছিল সে ৷ মাঠ থেকে ফেরার পর দেখেন বাড়িতে এসেছেন জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা দপ্তরের লোকজন ৷ তাঁদের মুখেই প্রাণগোবিন্দ জানতে পারে, সে এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় 495 নম্বর পেয়েছে ৷ সেকারণে সরকারি কর্তারা তাঁকে সংবর্ধনা জানাতে এসেছেন ৷
স্থানীয় পোপড়া ঈশ্বরলাল হাইস্কুলের ছাত্র প্রাণগোবিন্দ ৷ স্কুলে বরাবরই প্রথম হয়ে এসেছে ৷ অভাবের জন্য কোনওদিন গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে পারেনি ৷ স্কুলের শিক্ষকরাই তাঁকে পড়াশোনায় সবরকম সাহায্য করে এসেছেন ৷ আর তাঁকে সবসময় সাহস জুগিয়ে গিয়েছেন তাঁর দিদি ৷ উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফল করার জেদটা ছিল বরাবরই ৷ সে সব কাজ সামলে দিনে 14 ঘণ্টা পড়াশোনা করত ৷ পরীক্ষার ফল বেরোলে দেখা যায়, সে বাংলায় 95, ইংরেজিতে 52, ইতিহাসে 100, শিক্ষাবিজ্ঞানে 100, ভূগোলে 100 ও সংস্কৃতে 100 নম্বর পেয়েছে ৷ তবে, কাউন্সিলের বিধিতে টপ ফাইভ সাবজেক্ট অনুযায়ী তাঁর ইংরেজির নম্বর বাদ চলে যায় ৷
প্রাণগোবিন্দ বলে, “সম্ভবত আমি রাজ্যে পঞ্চম স্থানে রয়েছি ৷ এমন ফলে খুব ভালো লাগছে ৷ গতকাল প্রথমে নিজের ফল জানতে পারিনি ৷ সেই সময় মাঠে ঘাস কাটছিলাম ৷ বাড়ি ফিরে যখন শুনলাম, আমি 495 নম্বর পেয়েছি, তখন খুব আনন্দ হয়েছিল ৷ খুশিতে রাতে ঘুম আসছিল না ৷ দিদিই আমাকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে ৷ অভাবের সংসারেও নিজের ইচ্ছাশক্তিতে যে ভালো ফল করা যায়, দিদি সেকথা বারবার আমাকে বলেছে ৷ ওর সাহসেই আমি পড়াশোনায় অনুপ্রেরণা পেয়েছি ৷ স্কুলের ভূগোল শিক্ষিকা শুক্লা চক্রবর্তী আমাকে অসম্ভব সাহায্য করেছেন ৷ সাহায্য করেছেন অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকারাও ৷ তবে এক্ষেত্রে আমার বাবা-মায়ের ভূমিকাও অস্বীকার করা যায় না ৷ তাঁরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পয়সা উপার্জন করে আমার হাতে দিয়েছেন ৷ আমার বাবা-মা শিক্ষিত নন ৷ কিন্তু আমার উপর তাঁদের ভরসা রয়েছে ৷ আমার কোনও গৃহশিক্ষক ছিল না ৷ সেই সঙ্গতিও আমাদের পরিবারের নেই ৷ পড়াশোনা ছাড়াও আমাকে বাড়ির সব কাজ করতে হয় ৷ প্রতিদিন ঘাস কাটতে মাঠে যেতে হয় ৷ কখনও মায়ের সঙ্গে শ্রমিকের কাজও করতে যেতে হয় ৷ আমি সেলাই করতেও পারি ৷ সংসারের সব কাজই করতে পারি ৷ আপাতত ভূগোল নিয়ে পড়ার ইচ্ছে রয়েছে আমার ৷ ভবিষ্যতে IAS অফিসার হতে চাই ৷ কারণ, সমাজের জন্য আমাকে কিছু করতেই হবে ৷”
ছেলের রেজাল্টে খুশী মা নিভাদেবী ৷ তিনি বলেন, “ছেলের এই ফলে খুব ভালো লাগছে ৷ ও বাড়ির সব কাজই করে ৷ রাত জেগে পড়াশোনা করত ৷ অনেকদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেও ওকে পড়তে দেখেছি ৷ আমিই মাঝেমধ্যে গলা ধরে ওকে ঘুম পাড়িয়েছি ৷ এভাবেও যে ও এই ফল করেছে, তা ভাবতে পারছি না ৷ ও আরও বেশি পড়তে চাইছে ৷ আমাদের তেমন সঙ্গতি নেই ৷ এখন দেখি, সরকারের কাছ থেকে কোনও সাহায্য পাওয়া যায় কি না ৷ তবেই আমরা ওকে উচ্চশিক্ষা দিতে পারব ৷” গ্রামের ছেলের এমন ফল হওয়ায় খুশী গ্রামবাসীরাও ৷
কিন্তু, প্রশ্ন উঠেছে অন্য জায়গায় ৷ কোরোনার জন্য মাঝপথেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা ৷ তাই শিক্ষাবিজ্ঞান, ভূগোল ও সংস্কৃত বিষয়ে পরীক্ষাই দিতে পারেনি প্রাণগোবিন্দ ৷ বাংলা, ইংরেজি আর ইতিহাস পরীক্ষা দিতে পেরেছিল সে ৷ ওই তিনটি বিষয়ের মধ্যে ইতিহাসে সে 100 নম্বর পায় ৷ সেই কারণেই কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাকি তিনটি বিষয়েও তাঁর 100 নম্বর আসে ৷ সে ঢুকে পড়ে মেধা তালিকায় ৷ কিন্তু এভাবে পরীক্ষার্থীদের নম্বর দেওয়া হলে উচ্চশিক্ষায় রাজ্যের ভবিষ্যৎ কী ? তা নিয়ে চিন্তিত শিক্ষামহল ৷ শিক্ষাবিদ্ শক্তি পাত্র বলেন, “শুধু প্রাণগোবিন্দ নয়, গোটা রাজ্যে এমন ঘটনা অনেক ঘটেছে ৷ এবার একটা ভিন্ন পরিস্থিতিতে এভাবে নম্বর দেওয়া হয়েছে ৷ তবে এক্ষেত্রে কাউন্সিল ICSE কিংবা CBSE বোর্ডের মতো গড় হিসাবে প্রতি বিষয়ে নম্বর দিতে পারত ৷ কিন্তু যাই হোক, এরপর কলেজগুলোকে ভরতির ক্ষেত্রে অ্যাডমিশন টেস্ট নেওয়ার অনুমতি দেওয়া উচিত ৷ কোরোনা আবহে এই মুহূর্তে সেই টেস্ট নেওয়া সম্ভব নয় ৷ তাই সেশন পিছিয়ে দিয়েও এই কাজ করতে হবে ৷ যদি আগের মতো মার্কসের ভিত্তিতে কলেজগুলিতে অ্যাডমিশন নেওয়া হয়, তবে কিন্তু মুড়ি-মুড়কি এক হয়ে যাবে ৷ সেক্ষেত্রে ভালো কলেজগুলিতে ছাত্র সিলেকশন করাও সম্ভব হবে না ৷ অ্যাডমিশন টেস্টের খাতা পরীক্ষার জন্য সর্বস্তরের লোকজনকে রাখতে হবে ৷ তা না হলে নতুন জালিয়াতির রাস্তা দেখা দিতে পারে ৷”