মালদা, 6 এপ্রিল : লকডাউনে অনিশ্চিত হয়েছে রোজগার । যেটুকু সঞ্চয় করে রাখা ছিল তাও শেষ হয়ে গেছে । একমাত্র ভরসা ছিল সরকার । তাই সরকারের বিনামূল্যে রেশনের কথা ঘোষণা করার পর নিশ্চিন্ত হয়েছিল তারা । ঘোষণা অনুযায়ী গিয়ে নিয়ে এসেছিল চাল । কিন্তু কয়েকদিন পর চাল ফুরোতে শুরু করে । মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয় । কখনও আধ পেটা, কখনও আবার না খেয়ে থাকতে শুরু করে বাড়ির অন্যান্যরা । কিন্তু পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে ক্ষুদেদের জন্য । খিদের জ্বালায় কাঁদতে শুরু করে তারা । অগত্যা খিদে মেটাতে কিছু উপায় খুঁজে না পেয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করে পাওয়া চালের সবটাই ক্ষুদেদের পাতে তুলে দেয় বাড়ির অন্যান্যরা । আর নিজেরা কচুপাতা সিদ্ধ করে তা খাদ্য হিসবে গ্রহণ করে । তাই এখন হরিশচন্দ্রপুরের 100টিরও বেশি পরিবারের কাছে পেটের জ্বালা মিটিয়ে বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা কচুপাতাই ।
হরিশচন্দ্রপুরের 1 ব্লকের গড়গড়ি, বাইশাবাগান-সহ বেশকিছু এলাকায় অনেক পরিবার থাকে । ওই পরিবারগুলির কেউ মুসাহার, কেউ বেদে, আবার কেউ বিন সম্প্রদায়ের৷ কারোর কাজ মধু বিক্রি করা, কেউ আবার তাবিজ-মাদুলি বিক্রি করে৷ অনেকে আবার মাদারির খেলা দেখায়৷ লকডাউনের জেরে তাদের রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে । প্রশাসনের তরফে তাদের পাঁচ কিলো করে চাল দেওয়া হয়েছিল ঠিকই । কিন্তু সেই চাল শেষ । তাই এখন ভিক্ষাবৃত্তি করে তাদের চাল সংগ্রহ করতে হচ্ছে । কিন্তু সেই চালেও সবার পেট ভরছে না । বাড়ির বড়রা কখনও আধপেটা , কখনও না খেয়ে দিন কাটিয়ে দিচ্ছে । কিন্তু সমস্যায় পড়ছে ছোটো ছোটো শিশুরা । খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে কাঁদতে শুরু করছে । তাই হরিশচন্দ্রপুরের 100 টি পরিবারের কাছে পেট ভরানোর একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে কচুপাতা । শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তির চাল রান্না করে কচুপাতা সিদ্ধর সঙ্গে পাতে দেওয়া হচ্ছে । আর ভাত না জোটায় শুধু কচুপাতা সিদ্ধ খেয়ে দিন কাটাচ্ছে বাকিরা ।
গড়গড়ি এলাকার বাসিন্দা জগদীশ বেদ বলেন, "খাবারের কোনও ব্যবস্থা নেই ৷ সরকার পাঁচ কিলো চাল দিয়েছিল৷ দু’দিনেই সেই চাল শেষ৷ এখন নিজেদের খাওয়া তো দূরের কথা, বাচ্চাদের মুখেও খাবার তুলে দিতে পারছি না ৷ সরকার এখন বাড়ির বাইরে বেরোতে দিচ্ছে না ৷ রোজগার পুরোপুরি বন্ধ ৷ প্রশাসন কিংবা রাজনৈতিক নেতারা কেউ আসছে না ৷ আমি মধু বিক্রি করি৷ এখন বাইরে যাওয়ার উপায় নেই ৷ তাই কারও খাবার জোগাড় করতে পারছি না । খিদের জ্বালায় বাচ্চারা কেঁদেই যাচ্ছে ৷ আমাদের অনেকের রেশন কার্ড নেই ৷ তাই কচুপাতা রান্না করেই বাচ্চাদের খাওয়াতে হচ্ছে ৷"
বাইশাবাগানে থাকেন ছোটোরানি । রান্না করতে করতে তিনি বলেন, "আমাদের রেশন কার্ড নেই ৷ তাই প্রশাসনের দেওয়া চালও পাইনি ৷ ঘরে একটি দানাও চাল নেই ৷ ফলে কচুপাতা সিদ্ধ করে লবণ মাখিয়ে বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছি ৷ নিজেরাও সেটাই খাচ্ছি ৷ এখনও পর্যন্ত কেউ আমাদের সাহায্য করতে আসেনি ৷"
দুর্গত পরিবারগুলির পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে গিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন হরিশ্চন্দ্রপুর গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান রিসবা খাতুনের শওহর আফজল হোসেন ৷ তিনি বলেন, "এই মুহূর্তে পঞ্চায়েত দপ্তর বন্ধ ৷ এখন পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে এই পরিবারগুলিকে কোনও সাহায্য করা যাবে না বলেই আমার ধারণা ৷ তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে এই পরিবারগুলিকে খাবারসহ অন্য সামগ্রী দিয়ে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি ৷"
এলাকার ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা অজিতকুমার সাহা বলেন, "হরিশ্চন্দ্রপুর 1 ও 2 ব্লকের বেশ কিছু জায়গায় মুসাহার গোষ্ঠীর বসবাস৷ বর্তমান পরিস্থিতিতে এই গোষ্ঠীর সদস্যরা সত্যিই প্রচণ্ড সমস্যায় রয়েছে ৷ লকডাউন ঘোষণার পর BDO ও IC এইসব মানুষের জন্য কিছু ত্রাণের ব্যবস্থা করেছিলেন ৷ তবে, সেই ত্রাণ সবাই পায়নি ৷ এদের অধিকাংশেরই রেশন কার্ড নেই ৷ যাদের সেই কার্ড রয়েছে তারাও পর্যাপ্ত খাদ্যসামগ্রী পাচ্ছে না ৷ আমরাও এই পরিবারগুলিকে যথাসাধ্য সাহায্যের ব্যবস্থা করছি ৷" একই আশ্বাস দিয়েছেন জেলার তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সহ-সভাপতি বুলবুল খান৷ তিনি দ্রুত ওই পরিবারগুলির হাতে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন ৷
এবিষয়ে হরিশ্চন্দ্রপুর 1-এর BDO অনির্বাণ বসু বলেন, "লকডাউন শুরু হতেই আমরা ওই পরিবারগুলির মধ্যে চাল, আলু, সাবান-সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছে দিয়েছিলাম ৷ পরিবারগুলিকে আগামীদিনে আরও ত্রাণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে ৷" একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এই অসহায় পরিবারগুলির সাহায্যে এগিয়ে এসেছে । হরিশচন্দ্রপুরের ওই সংস্থাটি আগামীকাল থেকে প্রতিদিন প্রায় 400 জনের হাতে খাবারের প্যাকেট তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৷