মালদা, 13 এপ্রিল : পরিবারের কথা ভেবে এলাকার আরও কয়েকজনের সঙ্গে পঞ্জাবের অমৃতসরে একটি কম্বল কারখানায় শ্রমিকের কাজ করতে গিয়েছিলেন হরিশ্চন্দ্রপুর থানার বরুই গ্রামের হরিজনপাড়ার সুকুমার দাস (27) ৷ বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী ও দেড় বছরের একমাত্র ছেলেকে ৷ এরই মধ্যে শুরু হয়ে যায় কোরোনার প্রকোপ ৷ শুরু হয় লকডাউন ৷ বন্ধ হয়ে যায় কারখানা ৷ এই পরিস্থিতিতে নিজেদের আস্তানা থেকে বাইরে বের হতে পারছিলেন না সুকুমার ৷ বাড়িতে টাকাপয়সা পাঠাতেও পারছিলেন না তিনি ৷ এদিকে ঘরে অভাবের কথা ফোনে বারবার সুকুমারকে জানাচ্ছিলেন তাঁর স্ত্রী ৷ শেষ পর্যন্ত নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে আজ ভোরে অমৃতসরে নিজের আস্তানাতেই গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মঘাতী হন তিনি ৷
সুকুমারের বাবা হারু দাসের বয়স 67 বছর ৷ বয়সজনিত কারণে এখন আর কাজ করতে পারেন না ৷ মা সাবিত্রীদেবীর বয়সও 60 পেরিয়েছে ৷ সুকুমারই ছিলেন তাঁদের শেষ বয়সের ভরসা ৷ পরিবারের অন্ন সংস্থানের কথা চিন্তা করে মাস দুয়েক আগে এলাকার আরও কয়েকজনের সঙ্গে অমৃতসরে পাড়ি দেন সুকুমার ৷ এবারই প্রথম ভিনরাজ্যে কাজ করতে গিয়েছিলেন তিনি ৷ ঘরে মা-বাবা ছাড়াও রেখে গিয়েছিলেন স্ত্রী সঞ্জুদেবী ও দেড় বছরের একমাত্র ছেলে রাকেশকে ৷ অমৃতসরে একটি কারখানায় তাঁর কাজ জোটে ৷ কাজ ভালোই চলছিল ৷ তবে কিছুদিনের মধ্যেই দেখা দেয় সমস্যা ৷ কোরোনার জেরে লকডাউন গোটা দেশে ৷ বন্ধ হয়ে যায় সেই কারখানা ৷ শুধু তাই নয়, বাড়ি থেকে বেরোনোও বন্ধ হয়ে যায় সুকুমারের ৷
সুকুমারের সঙ্গীদের বক্তব্য, পরিবারের কথা ভেবে তিনি ঘরে ফেরার অনেক চেষ্টা করেছিলেন ৷ একসময় হেঁটে মালদা ফেরার কথাও ভেবেছিলেন তিনি ৷ যদিও তাঁরা সুকুমারকে তা থেকে বিরত করে ৷ কিন্তু এই পরিস্থিতিতে দিনের পর দিন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি ৷ এদিকে বাড়ি থেকে সঞ্জুদেবীও প্রতিদিনই তাঁকে জানাতেন, ঘরে খুব অভাব ৷ খাবার শেষ ৷ চেয়েচিন্তে খেতে হচ্ছে ৷ বাচ্চার খাবারও নেই ৷ এসব নিয়ে চিন্তায় আরও ভেঙে পড়েছিলেন সুকুমার ৷ অবশেষে আজ ভোর পাঁচটা নাগাদ নিজের আস্তানাতেই গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মঘাতী হন ৷ সকালে সহকর্মীরা তাঁর ঝুলন্ত দেহ দেখতে পেয়ে সেখানকার পুলিশকে খবর দেয় ৷ সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ সুকুমারের মৃতদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তে পাঠায় ৷ লকডাউনে দেহ ঘরে ফেরানো সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেয় পঞ্জাব পুলিশ ৷ তাই ময়নাতদন্তের পর আজই সুকুমারের দেহ অমৃতসরে সৎকার করা হয়েছে ৷
হরিশচন্দ্রপুর থানার পুলিশ জানিয়েছে, এনিয়ে পঞ্জাব পুলিশের পক্ষ থেকে এখনও সরকারিভাবে কিছু জানানো হয়নি ৷ তবে ঘটনাটি পুলিশের কানে এসেছে ৷ থানার পক্ষ থেকে পঞ্জাব পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে ৷ এদিকে ঘটনার খবর পেয়েই আজ মৃত সুকুমারের বাড়িতে যায় CPI(M)-র একটি প্রতিনিধিদল ৷ নেতৃত্বে ছিলেন দলের জেলা কমিটির সদস্য জামিল ফিরদৌস ৷ দলের পক্ষ থেকে ওই পরিবারের হাতে কিছু ত্রাণসামগ্রী তুলে দেওয়া হয় ৷
জামিল সাহেব বলেন, "লকডাউনে বাড়িতে টাকাপয়সা পাঠাতে পারছিল না সুকুমার ৷ বাড়ির অভাবের কথাও প্রতিনিয়ত ওকে জানাতে বাধ্য হতেন সঞ্জু ৷ লকডাউন ঘোষণার পর একাধিকবার বাড়ি ফিরে আসার চেষ্টা করে সে ৷ কিন্তু ব্যর্থ হয় ৷ এসব নিয়ে সুকুমার প্রবল মানসিক অবসাদে ভুগছিল ৷ শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার রাস্তা বেছে নিতে বাধ্য হয় ৷ এই খবর পেতেই আজ আমরা তার বাড়িতে যাই ৷ তার পরিবারকে কিছু খাদ্যসামগ্রী ও জামাকাপড় দিয়ে এসেছি ৷ আগামী দিনেও পরিবারটির পাশে আমরা রয়েছি ৷ এই পরিবারটিকে যাতে সরকারিভাবে কিছু আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করা হয়, তার জন্য প্রশাসনের কাছে আবেদন জানাচ্ছি ৷" সুকুমারের স্ত্রী বলেন, "এখন কীভাবে ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখব সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না ৷ বাড়ির সবার খাবারই বা কোথা থেকে জুটবে? এখান থেকে তো অনেকেই অমৃতসরে কাজ করতে গিয়েছে ৷ কারও তো কিছু হয়নি ! আমার সঙ্গেই এমন হল কেন?"